১৩ বছরের আগে শিশুদের হাতে স্মার্টফোন নয়, বলছে নতুন গবেষণা

১৩ বছরের আগে শিশুদের হাতে স্মার্টফোন তুলে দেওয়া মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর হতে পারে—নতুন এক গবেষণায় উঠে এসেছে এমনই উদ্বেগজনক চিত্র। সোমবার (২১ জুলাই) প্রকাশিত ওই গবেষণায় বলা হয়েছে, অল্প বয়সে স্মার্টফোন ব্যবহারের সঙ্গে আত্মহত্যাপ্রবণতা, আবেগ নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতা, আত্মমূল্যবোধে ঘাটতি এবং বাস্তবতা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ার প্রবণতা বেড়ে যায়—বিশেষত কিশোরীদের ক্ষেত্রে।
জার্নাল অব দ্য হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড ক্যাপাবিলিটিজে প্রকাশিত এই গবেষণায় দেখা যায়, কেউ যত অল্প বয়সে স্মার্টফোন ব্যবহার শুরু করে, পরবর্তী জীবনে তার মানসিক সুস্থতা ততটাই খারাপ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। গবেষণা বলছে, ১৩ বছরের আগেই স্মার্টফোন ব্যবহারের কারণে শিশুদের ঘুমের ব্যাঘাত, সাইবার বুলিংয়ের শিকার হওয়া, পরিবারে টানাপোড়েন এবং অতিরিক্ত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার—এই সবকিছুর প্রভাব পড়ে তাদের মানসিক স্বাস্থ্যে।
গবেষণাটি সাপিয়েন ল্যাবস পরিচালিত এক জরিপের ওপর ভিত্তি করে তৈরি, যেখানে ১৬৩টি দেশের প্রায় ২০ লাখ অংশগ্রহণকারী নিজেদের অভিজ্ঞতা জানিয়েছেন।
গবেষণার প্রধান লেখক ও সাপিয়েন ল্যাবসের প্রধান বিজ্ঞানী তারা থিয়াগারাজান বলেন, 'এই ফলাফল আমাদের বলছে, ১৩ বছরের নিচে শিশুদের জন্য স্মার্টফোন ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ব্যবহার সীমিত করা জরুরি। পাশাপাশি, তরুণদের জন্য ডিজিটাল পরিবেশ নিয়ন্ত্রণে আরও সূক্ষ্ম নীতিমালা প্রয়োজন।'
এর আগে বেশিরভাগ গবেষণায় স্মার্টফোন ব্যবহারের সঙ্গে উদ্বেগ ও বিষণ্নতার সম্পর্ক খতিয়ে দেখা হয়েছিল। কিন্তু থিয়াগারাজান বলেন, এই গবেষণায় আরও অনালোচিত উপসর্গ যেমন—আবেগ নিয়ন্ত্রণ ও আত্মমূল্যবোধ—বিশ্লেষণ করা হয়েছে এবং দেখা গেছে, এসব উপসর্গও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
তবে তিনি সতর্ক করে বলেন, যেহেতু এটি আত্মপ্রকাশভিত্তিক জরিপ, তাই গবেষকেরা অংশগ্রহণকারীদের বক্তব্য স্বাধীনভাবে যাচাই করতে পারেননি। এ ছাড়া গবেষণাটি নির্দিষ্ট করে দেখাতে পারেনি, ঠিক কোন ধরনের স্মার্টফোন ব্যবহার এসব সমস্যার জন্য দায়ী বা প্রযুক্তি পরিবর্তনের সঙ্গে ফলাফলগুলো কীভাবে রূপ নিতে পারে।
১৬ বছরের আগে সোশ্যাল মিডিয়া নয়
এই গবেষণার ফলাফল দেখে অনেক বিশেষজ্ঞ বলছেন, শিশুদের ১৬ বছর বয়স না হওয়া পর্যন্ত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে দূরে রাখাই উত্তম। যুক্তরাজ্যের একটি গবেষণায়ও দেখা গেছে, কিশোর বয়সে সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করলে এক বছর পর তাদের জীবনের প্রতি সন্তুষ্টি কমে যায়।
সামাজিক মনোবিজ্ঞানী জনাথন হাইট তাঁর আলোচিত বই 'দ্য এংশিয়াস জেনারেশন'–এ একই পরামর্শ দিয়েছেন। তিনি লিখেছেন, শৈশবের এই প্রযুক্তিনির্ভর পুনর্গঠনই মানসিক রোগের বিস্তার ঘটাচ্ছে।
সমাধান হতে পারে অভিভাবকদের একযোগে সিদ্ধান্ত
অনেক অভিভাবকই সন্তানের হাতে স্মার্টফোন তুলে দিতে চান না, তবে আশপাশের অন্য শিশুরা ব্যবহার করায় তারা বাধ্য হন। এ সমস্যার সমাধান হিসেবে অভিভাবকদের একত্রিত হয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার পরামর্শ দেন বিশেষজ্ঞরা। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক 'ওয়েট আনটিল এইটথ' নামের একটি সংগঠন রয়েছে, যারা অভিভাবকদের অষ্টম শ্রেণির আগে সন্তানদের স্মার্টফোন না দেওয়ার অঙ্গীকারে উদ্বুদ্ধ করে।
প্রিন্সটনের ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট মেলিসা গ্রিনবার্গ বলেন, 'আপনার এলাকায় এমন কোনো উদ্যোগ আছে কি না খোঁজ নিন। না থাকলে আপনি নিজেই তা শুরু করতে পারেন।' স্কুল পর্যায়েও স্মার্টফোন ব্যবহারের বিষয়ে কঠোর নীতি গ্রহণে অভিভাবকদের সক্রিয় হতে উৎসাহ দেন তিনি।
সামাজিক পরিবর্তন ছাড়া সম্ভব নয়
তবে গবেষকরা সতর্ক করে বলেন, এককভাবে অভিভাবকরা এই সমস্যার সমাধান করতে পারবেন না, প্রয়োজন সমাজব্যাপী পরিবর্তন। কারণ, একজন অভিভাবক যদি নিজের সন্তানকে সোশ্যাল মিডিয়া থেকে দূরে রাখেন, তবুও সে অন্যদের মাধ্যমে এসব অ্যাপের সংস্পর্শে আসতে পারে—স্কুল বাসে বা বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডার সময়।
তাই অভিভাবকদের উচিত শিশুদের ডিজিটাল নিরাপত্তা বিষয়ক নীতিমালা তৈরির আন্দোলনেও সক্রিয় অংশগ্রহণ।
আপনার সন্তান ইতিমধ্যেই স্মার্টফোন ব্যবহার করে? চিন্তা করবেন না
যদি আপনার সন্তান ১৩ বছরের আগেই স্মার্টফোন ব্যবহার শুরু করে থাকে কিংবা আপনি গবেষণার ফলাফল দেখে দুশ্চিন্তা করছেন, তাহলে মনোবিজ্ঞানী গ্রিনবার্গ বলছেন—'ভয় পাবেন না।'
'যদি আপনি চিন্তিত হন কিন্তু সন্তানের মধ্যে এসব উপসর্গ না দেখেন, তাহলে তার সঙ্গে কথা বলুন এবং তাকে জানান যে, অনেকেই উদ্বেগ, আত্মমূল্যবোধের অভাব বা অতিরিক্ত আবেগে ভোগে,' বলেন তিনি। 'বলুন, সাহায্য চাইলে আপনি পাশে আছেন। কখনো তারা মানসিকভাবে চাপ অনুভব করলে যেন আপনার কাছে আসে।'
আর যদি এসব উপসর্গ লক্ষ করেন, তাহলে পেশাদার কাউন্সেলরের শরণাপন্ন হওয়ার পরামর্শ দেন তিনি।
প্রয়োজনে বদলে ফেলুন সিদ্ধান্ত
আপনার সন্তান ইতিমধ্যে স্মার্টফোন ব্যবহার করলে আপনি হয়তো মনে করতে পারেন—এখন আর কিছু করার নেই। কিন্তু গ্রিনবার্গ বলেন, 'এটি সত্য নয়। যদি মনে হয় এখনকার ব্যবস্থায় কোনো সমস্যা হচ্ছে, তাহলে পরিবর্তন করুন।'
তিনি বলেন, অভিভাবকেরা চাইলে প্যারেন্টাল কন্ট্রোল চালু করতে পারেন, স্মার্টফোনের বদলে ফ্লিপ ফোন দিতে পারেন, অথবা নির্দিষ্ট অ্যাপ মুছে দিতে পারেন।
শিশুরা এতে অখুশি হতে পারে, কিন্তু আপনি যদি মনে করেন এটি তাদের মঙ্গল বয়ে আনবে, তাহলে সিদ্ধান্ত নিতে পিছপা হবেন না।
কীভাবে শিশুকে বোঝাবেন সে কথোপকথনের একটি উদাহরণও বাতলে দেন তিনি:
'যখন তোমাকে স্মার্টফোন দিয়েছিলাম, তখন আমরা জানতাম না যে, এটা তোমার ওপর কী ধরনের প্রভাব ফেলতে পারে। এখন অনেক বিজ্ঞানী ও ডাক্তার গবেষণা করে বলছেন, স্মার্টফোন শিশুদের ওপর বড় ধরনের প্রভাব ফেলছে। তাই আমরা কিছু পরিবর্তন আনছি, যাতে তুমি সুস্থ ও ভালো থাকতে পারো।'
শিশুর প্রতিক্রিয়ায় সহানুভূতিশীল হোন
যদি সন্তান রেগে যায় বা কষ্ট পায়, তাহলে সহানুভূতির সঙ্গে তার কথা শুনুন। গ্রিনবার্গ বলেন, 'প্রাপ্তবয়স্করাও যখন কোনো জিনিস হারায় বা অভ্যাস বদলাতে বলা হয়, তখন তাদের প্রতিক্রিয়া সবসময় পরিণত হয় না। সুতরাং, শিশুরাও যে সহজে মেনে নেবে—এটা ভাবা ঠিক নয়।'
তিনি পরামর্শ দেন, আপনি নিজেও কীভাবে স্মার্টফোন ব্যবহারে লড়ছেন সে কথা সন্তানকে বলুন। এতে সম্পর্ক আরও ঘনিষ্ঠ হবে এবং সন্তানের বোঝা সহজ হবে যে, প্রযুক্তির লোভ সবার জন্যই কঠিন।
আপনার সন্তান যদি এখনো স্মার্টফোন ব্যবহার শুরু না করে থাকে, তাহলে আপনার কমিউনিটির অন্য অভিভাবকদের সঙ্গে কথা বলুন। একত্রে সিদ্ধান্ত নিন—এই বয়সে স্মার্টফোন নয়।
আমাদের সন্তানদের স্মার্টফোন থেকে দূরে রাখা—এটা হতে পারে আমাদের নেওয়া সবচেয়ে বুদ্ধিদীপ্ত সিদ্ধান্ত।