৮০ বছর পর বিক্রি হচ্ছে স্কটল্যান্ডের এই দ্বীপ; আছে ধ্বংসপ্রায় প্রাসাদ; পরিবার কিনেছিল না দেখেই!
যুদ্ধশেষ সময়ে এক নারী লন্ডনের এক এস্টেট এজেন্সিতে ঢুকে বলেছিলেন—"আপনারা কি কোনো দ্বীপ বিক্রি করছেন?" সেই দ্বীপ তিনি কখনও দেখেননি, তবু কিনে ফেলেছিলেন। এরপর কেটে গেছে আশিটি বছর। এবার সেই দ্বীপটাই বিক্রি করে দিচ্ছে তার পরিবার। খবর বিবিসির।
দ্বীপে বেড়ে ওঠা পরিবারের দ্বিতীয় প্রজন্মের সদস্য জিম গালি বলেন, "সাদা বালুর সৈকত আর পাথুরে উপকূল আমাদের এক স্বপ্নের শৈশব উপহার দিয়েছিল।"
স্কটল্যান্ডের পশ্চিম উপকূলে অবস্থিত ১,১১০ একরের দ্বীপ শুনা। সেখানে আছে ধ্বংসপ্রায় একটি প্রাসাদ, একটি কৃষিখামার ও ছয়টি হলিডে কটেজ। ১৯৪৫ সাল থেকে গালি পরিবারের বাস এই দ্বীপে। এখন এটি বিক্রি হচ্ছে ৫.৫ মিলিয়ন পাউন্ডে।
রিয়েল এস্টেট প্রতিষ্ঠানগুলো দ্বীপটিকে 'অত্যন্ত বিরল সুযোগ' হিসেবে বর্ণনা করেছে। তারা বলছে, অনেকেই আগ্রহ দেখাচ্ছে ব্যক্তিগত রিট্রিট, পর্যটন ব্যবসা বা প্রাকৃতিক পরিবেশ পুনরুদ্ধার প্রকল্প হিসেবে দ্বীপটি গড়ে তুলতে।
যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর ডাওয়াজার ভিসকাউন্টেস সেলবি , যিনি রাজনীতিবিদ স্যার উইলিয়াম কোর্ট গালির বংশধর, একজন জমির এজেন্টকে জিজ্ঞেস করেন, "আপনাদের কাছে বিক্রির জন্য কোনো দ্বীপ আছে?" সেই প্রশ্ন থেকেই শুরু। এরপর তিনি যেই দ্বীপটির খোঁজ পান, সেটিই গত ৮০ বছর ধরে গালি পরিবারের দখলে ছিল।
"যুদ্ধ মানুষকে এতটাই ক্লান্ত আর বিমর্ষ করেছিল যে সবাই একটা নতুন শুরু খুঁজছিল," বলেন জিম গালি। "তারা দ্বীপটি না দেখেই কিনে ফেলেন এবং পরিবারসহ সেখানে চলে যান।"
তার বাবা এডি গালি, পরিবারের চতুর্থ সন্তান, তিন মাস বয়সেই শুনায় চলে আসেন। বর্তমানে তিনি কাছেই সিল দ্বীপে থাকেন, যা মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে সড়কে যুক্ত।
"৮০ বছর ধরে বাবা শুনাকে আগলে রেখেছেন, চেষ্টা করেছেন নানা উদ্যোগ গড়ে তুলতে। দ্বীপটা তার জীবনের সবচেয়ে বড় ভালোবাসা ছিল," বলেন জিম।
জিম ও তার ভাইও শুনায় বড় হয়েছেন। তাদের পড়াশোনা হয়েছে দ্বীপে, দাদার হাতে। "সকালে পড়াশোনা, বিকেলে খামার আর কটেজে কাজ, সেই অভিজ্ঞতা এখনো আমাদের জীবনে জড়িয়ে আছে," বলেন জিম।
শুনার ভৌগোলিক অবস্থান মনকে শান্তি দেয়, কখনো কখনো আবার দ্বীপটি ঘূর্ণিঝড়ের কবলেও পড়ে যায়। আবার স্কটল্যান্ডের ওবান এলাকার পাশে থাকা শুনা নামে আরও একটি দ্বীপের সঙ্গে প্রায়ই বিভ্রান্তি ঘটে। "আমরা তাদের চিঠি পেয়ে ফিরিয়ে দিতাম। খুব সাধারণ ভুল," বলেন তিনি।
গত ১২ বছর ধরে রোব ও ক্যাথরিন জেমস দ্বীপটি দেখাশোনা করছিলেন। তারা এখন নতুন কাজে যেতে চাচ্ছেন, সেই কারণেই পরিবার বিক্রির সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
এই সপ্তাহেই দর্শনার্থীরা দ্বীপ দেখতে পারবেন। ততদিনে নিয়মিত অতিথিরা তাদের বছরের বাকি সময়ের বুকিং নিশ্চিত করছেন।
"এই দ্বীপ আমাদের সবার জীবনের বড় অংশ। বিক্রি করার সিদ্ধান্ত কষ্টের, তবে বাবার জন্য স্বস্তিও বটে। এখন আর প্রতি সপ্তাহে তিন-চারবার যেতে হবে না দ্বীপে," বলেন জিম।
দ্বীপের প্রাসাদটি তৈরি করেছিলেন নিউ জিল্যান্ডের অভিযাত্রী জর্জ আলেকজান্ডার ম্যাকলিন বাকলি, ১৯১১ সালে। তিনি অ্যারনেস্ট শ্যাকলটনের অ্যান্টার্কটিক অভিযানে অংশ নিয়েছিলেন।
জানা যায়, প্রাসাদের ডিজাইন ও নকশা যুক্তরাষ্ট্রে পাঠানোর কথা ছিল। তবে সেই নকশাগুলো ছিল টাইটানিক জাহাজে। জাহাজডুবিতে সেগুলো হারিয়ে যায়। তাই আর 'ফ্ল্যাট-রুফ' প্রাসাদ আমেরিকায় তৈরি হয়নি।
১৯৮০ সালের দিকে প্রাসাদের রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয় বেড়ে গেলে সেটি অবহেলায় ধ্বংস হতে থাকে।
"আমি জীবনের প্রথম ১০ বছর ছিলাম সেই প্রাসাদে। এখনো জানালা দিয়ে তাকালে তা চোখে ভাসে," বলেন জিম।
তারা সকালবেলা গণিত, ইংরেজি শিখতেন। তারপর পুরো দ্বীপ ঘুরে বেড়াতেন। প্রাসাদের তিন-চতুর্থাংশ তখন ব্যবহারই করা হতো না।
"ঘরের মেঝে ভেঙে পড়ার ভয় ছিল সবসময়। যখন ফার্নিচার সরিয়ে জায়গা খুঁজতাম, তখনই বুঝতাম সময় ফুরিয়ে আসছে," বলেন তিনি।
তবু ধ্বংসপ্রায় হলেও প্রাসাদটি এখনো 'দারুণ শোভাবর্ধক'। জানালা থেকে গাছ গজিয়ে উঠলেও রূপ হারায়নি।
শুনায় মানুষের বসতি ছিল অন্তত ৪৫০০ বছর আগে। এখানে পাওয়া গেছে পাথর ও লৌহযুগের কবরস্থান, ধ্বংসপ্রাপ্ত ফার্মহাউজ ও পুরনো চুনভাটার নিদর্শন। ১৭৫০ থেকে ১৮৫০ সালের মধ্যে এখানে প্রায় ৮০ জন মানুষ বাস করত বলে ধারণা।
গালি পরিবারের ২২০টি বেউলা জাতের ভেড়ার পাশাপাশি দ্বীপে আছে হরিণ, নানা প্রজাতির পাখি ও ওটার। সীল, ডলফিন, পোরপয়েজ এই সব সামুদ্রিক প্রাণীও প্রায়ই চোখে পড়ে।
দ্বীপের ছয়টি হলিডে কটেজে একসঙ্গে ৫২ জন অতিথি থাকতে পারেন। এখানে বিদ্যুৎ আসে টেকসই উৎস থেকে। মূল ভূখণ্ডের আর্দুয়েইন ঘাট থেকে ২০ মিনিটের নৌযাত্রায় অতিথিদের আনা-নেওয়া করা হয়। চাইলে হেলিকপ্টারেও পৌঁছানো যায়।
যুক্তরাজ্যের সোথেবিজ ইন্টারন্যাশনাল রিয়েলটি ও নাইট ফ্র্যাঙ্ক প্রতিষ্ঠান দ্বীপটি বিক্রয়ের ব্যবস্থাপনা করছে।
তারা বলছে, এটি একাধিক প্রজন্মের বসবাস, বিলাসবহুল হসপিটালিটি বা ওয়েলনেস রিট্রিটের জন্য আদর্শ স্থান।
