বিশ্বের সর্বনিম্ন জন্মহারের দেশ দক্ষিণ কোরিয়া, তবুও জমজমাট বন্ধ্যাত্ব চিকিৎসাকেন্দ্রগুলো

গেল বছর নভেম্বরে ইন ভিট্রো ফার্টিলাইজেশন (আইভিএফ) চিকিৎসা শুরু করেন দক্ষিণ কোরিয়ার কিম মি-এ। আইভিএফহলো বন্ধ্যাত্ব চিকিৎসার একটি পদ্ধতি, যেখানে নারীর ডিম্বাণু ও পুরুষের শুক্রাণু শরীরের বাইরে ল্যাবরেটরিতে নিষিক্ত করা হয় এবং তারপর নিষিক্ত ভ্রূণটি নারীর জরায়ুতে স্থাপন করা হয়। এটি সাধারণত তখন ব্যবহৃত হয় যখন স্বাভাবিকভাবে গর্ভধারণ সম্ভব না হয়।
ঠিক তিন বছর আগেও প্রথম সন্তানের সময় এই প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে গেছেন কিম। তাই ধৈর্যের পরীক্ষা কেমন হবে, তা তিনি ভাল করেই জানতেন।
বিশ্বে যেখানে দক্ষিণ কোরিয়ার জন্মহার সবচেয়ে কম, সেখানে আইভিএফ বা বন্ধ্যাত্ব চিকিৎসার চাহিদা ক্রমেই বাড়ছে। সরকারি তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে দেশে এই ধরনের চিকিৎসার সংখ্যা প্রায় ৫০শতাংশ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২ লাখে।
শুধু সিওল শহরেই গত বছর প্রতি ছয় শিশুর মধ্যে এক শিশুর জন্ম হয়েছে আইভিএফ পদ্ধতিতে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পরিবার নিয়ে কোরিয়ান সমাজে চিন্তাভাবনায় পরিবর্তন আসায় বন্ধ্যাত্ব চিকিৎসার দিকে ঝুঁকছে অনেকেই।
অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের জেরোন্টোলজি বিভাগের অধ্যাপক সারা হার্পার বলেন, 'বর্তমান তরুণ প্রজন্ম নিজেদের জীবন নিজেরাই নিয়ন্ত্রণ করতে চায়।' তার মতে, কেউ আগেভাগেই ডিম্বাণু সংরক্ষণ করছেন, আবার কেউ সন্তান না হলে আইভিএফ চিকিৎসার আশ্রয় নিচ্ছেন।
তিনি বলেন,'আগের প্রজন্মে সন্তান হওয়া না-হওয়াকে অনেকটা ভাগ্যের বিষয় বলে ধরে নেওয়া হতো, কিন্তু এখন কোরিয়ান নারীরা বলছেন, 'আমার জীবন আমি নিজে পরিকল্পনা করে চলতে চাই।'
দক্ষিণ কোরিয়া সরকারের জন্য এটি একটি ভালো দিক। দেশটি এখন মারাত্মক জনসংখ্যা সংকটে পড়েছে। দেশের প্রতি পাঁচজন মানুষের একজনের বয়স এখন ৬৫ বছরের বেশি। আর মোট জনসংখ্যার অনুপাতে শিশুর সংখ্যা কখনো এত কম ছিল না।
আবার, দক্ষিণ কোরিয়া বারবার বিশ্বের সর্বনিম্ন জন্মহারের রেকর্ড ভেঙেছে। ২০১৮ সালে প্রতি নারী গড়ে শূন্য দশমিক ৯৮ শতাংশ সন্তান জন্ম দিয়েছিলেন, যা ২০২০ সালে নেমে আসে দশমিক ৮৪-এ এবং ২০২৩ সালে কমে দাঁড়ায় মাত্র ০ দশমিক ৭২-এ। এই জন্মহার অব্যাহত থাকলে আগামী ৬০ বছরে দেশের জনসংখ্যা পাঁচ কোটির কাছাকাছি থেকে অর্ধেকে নেমে আসবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করছেন বিশেষজ্ঞরা।

তবে ২০২৪ সালে মিলেছে সামান্য আশার ইঙ্গিত। সেই বছর জন্মহার বেড়ে দাঁড়ায় ০ দশমিক ৭৫—টানা নয় বছর পর এই প্রথম সামান্য বৃদ্ধি।
কোরিয়া ডেভেলপমেন্ট ইনস্টিটিউটের পাবলিক পলিসি বিভাগের অধ্যাপক সেউলকি চোই বলেন, 'পরিমাণে ছোট হলেও এটি একটি ইতিবাচক পরিবর্তন।'
তবে এখনই এটিকে দীর্ঘমেয়াদি প্রবণতা বলা যাবে না। দেশটির জন্মহার এখনও বৈশ্বিক গড় ২ দশমিক ২ থেকে অনেক নিচে। তারপরও অধ্যাপক চোইসহ অনেকেই এ বিষয়ে সতর্কভাবে আশাবাদী।
অধ্যাপক চোই বলেন, 'যদি এই ধারা টিকে থাকে, তবে তা বড় ধরনের পরিবর্তনের ইঙ্গিত হতে পারে,' তিনি বলেন। 'তরুণ প্রজন্ম এখন বিয়ে ও সন্তানের মত বিষয়গুলোকে কীভাবে ভাবছে, সেটিই এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।'
পার্ক সু-ইনের জীবনে অনেক বছর ধরে সন্তান নেওয়ার ভাবনা ছিল একেবারেই পেছনের সারিতে। তিনি এক বিজ্ঞাপন সংস্থায় কাজ করতেন। প্রায়ই তাকে ভোর চারটা পর্যন্ত অফিস করতে হতো।
৩৫ বছর বয়সী সু-ইন বললেন, 'অফিসে এত বেশি ওভারটাইম করতে হতো যে সন্তান নেওয়ার বিষয়টি নিয়ে ভাবার কোনও সুযোগই ছিল না।'
তবে বিয়ের দুই বছর পর তার জীবনযাত্রায় পরিবর্তন আসতে শুরু করে। নতুন একটি চাকরি নেন, যেখানে কাজের সময়সূচি অনেকটাই নিয়ন্ত্রিত। এদিকে তার আশপাশের বন্ধুরা একে একে সন্তান নিচ্ছেন।
'তাদের সন্তানদের সঙ্গে মিশে বিষয়টা আর তত ভয়ানক মনে হয়নি,' বলেন সু-ইন। "আর সবচেয়ে বড় সাহস পেয়েছি যখন দেখেছি, আমার স্বামী নিজে থেকেই গর্ভাবস্থা ও সন্তান জন্ম নিয়ে পড়াশোনা করছে, খোঁজ নিচ্ছে। এতে আমারও আত্মবিশ্বাস এসেছে—আমরাও পারব।'
পার্ক সু-ইন ও তার স্বামী যখন সন্তান ধারণে সমস্যার মুখোমুখি হন, তখন তারা বন্ধ্যাত্ব চিকিৎসার আশ্রয় নেন। অনেকে একই পথে যাওয়ায় এই চিকিৎসা শিল্প ২০৩০ সালের মধ্যে দুই বিলিয়ন ডলারেরও বেশি মূল্যবান হয়ে উঠতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
ওয়াশিংটনের পপুলেশন রেফারেন্স ব্যুরোর প্রেসিডেন্ট জেনিফার সিয়ুবা বলেন, 'এটি নীতি নির্ধারকদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ইঙ্গিত যে এখনও অনেক নারী পরিবার শুরু করতে চান, কিন্তু নানা প্রতিবন্ধকতার কারণে পারছেন না।'
তিনি আরও বলেন, 'সবচেয়ে বড় কথা, এতে বোঝায় যাচ্ছে যে অনেকের সন্তান নেয়ার ইচ্ছা থাকলেও পূরণ হচ্ছে না।'

সন্তান ধারণের অসুবিধা মাত্র একটি বাধা। দক্ষিণ কোরিয়ার জনসংখ্যা সংকটের মূলে রয়েছে সামাজিক ও আর্থিক চাপ। পিতৃতান্ত্রিক সংস্কৃতির কারণে শিশু দেখভালের বেশিরভাগ কাজ পড়ে নারীদের ওপর, দীর্ঘ কর্ম-ঘণ্টা ও উচ্চশিক্ষার খরচ তরুণদের সন্তান নেওয়া থেকে বিরত রাখছে।
তবু অনেকের জন্য সন্তান নেওয়ার স্বপ্ন শুধু পিছিয়ে গেছে। জাতিসংঘের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অধিকাংশ দক্ষিণ কোরিয়ান সন্তান চাইলেও সামর্থ্য না থাকায় তা নিচ্ছে না। এছাড়া, প্রথম সন্তান নেওয়ার সময় দক্ষিণ কোরিয়ান নারীদের গড় বয়স প্রায় ৩৪ বছর।
পার্ক সু-ইন বলেন, 'পেছনে ফিরে তাকালে মনে হয় আরও আগে থেকেই শুরু করলে ভালো হতো। কিন্তু সত্যি বলতি, এখনই সঠিক সময় মনে হচ্ছে। সেসময় আমার আর্থিক ক্ষমতা ছিল না বিয়ে বা সন্তানের কথা ভাবার।'
ঠিক এমনটাই মনে করেন কিম মি-এ, যিনি বিয়ের জন্য তিন বছর এবং সন্তানের জন্য আরও চার বছর সঞ্চয় করেছেন।
'মানুষ তাদের তরুণবেলা পড়াশোনা, চাকরি খোঁজা এবং উন্নত জীবনযাপনের জন্য প্রস্তুতিতে ব্যয় করে কাটিয়ে দেয়। তবে যখন বিয়ে-সন্তান নিয়ে স্থির হওয়ার সময় আসে, তখন অনেক সময়ই দেখা যায় দেরি হয়ে যায়,' বলেন তিনি। 'আর যত বেশি অপেক্ষা করবেন, শারীরিক ও মানসিক দিক থেকে গর্ভধারণ তততাই কঠিন হয়ে ওঠে।"
আইভিএফ চিকিৎসা বেছে নিলে সন্তান ধারণের খরচও অনেক বেড়ে যায়।
'আইভিএফের খরচ নির্দিষ্ট করে বলা মুশকিল কারণ এটি ব্যক্তির পরিস্থিতি এবং চিকিৎসার চক্রভেদে ভিন্ন হয়,' জানান কিম।
জনসংখ্যা বৃদ্ধির লক্ষ্যে দক্ষিণ কোরিয়া সরকার বন্ধ্যাত্ব চিকিৎসার জন্য সহায়তা বৃদ্ধি করেছে। সিওল সরকার ডিম্বাণু সংরক্ষণের জন্য সর্বোচ্চ ২০ লাখ কোরিয়ান ওন (প্রায় ১ হাজার ৪৬০ ডলার) এবং প্রতি আইভিএফ চক্রে ১১ লাখ ওন পর্যন্ত ভর্তুকি দিচ্ছে।
তবে এসব ভর্তুকি পেলেও, কিম জানিয়েছেন এই জানুয়ারি মাসে আইভিএফ চিকিৎসার জন্য তার ব্যক্তিগত খরচ ২০ লাখ ওনের বেশি হয়েছে। এর বেশিরভাগ খরচ ভর্তুকির বাইরে থাকা ঔষধ, অতিরিক্ত পরীক্ষা-নিরীক্ষা ইত্যাদির জন্য হয়েছে।
আইভিএফ চক্রের অর্ধেকেরও কম সফল হওয়ায় চিকিৎসার খরচও দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে।
দক্ষিণ-পশ্চিমের জলা প্রদেশের ৩৭ বছর বয়সী জাং সে-রেয়নও এই বাস্তবতার মুখোমুখি। গত দুই বছরে তিনি পাঁচটি আইভিএফ চক্র সম্পন্ন করেছেন, যেখানে প্রতি চক্রের খরচ প্রায় ১৫ লাখ ওন।
তিনি বলেন, "এক বা দুইবার চেষ্টা করেই সফল হওয়া যেত—এই আশা থাকলেও অধিকাংশের জন্য তা সম্ভব হয় না। টাকার অভাব থাকলে চিকিৎসা এগোনো যায় না। এটাই সবচেয়ে হতাশাজনক।'

এছাড়া, অনেক নারী আইভিএফের চাপে কর্মক্ষেত্রে নানা চাপ ও বাধার মুখোমুখি হচ্ছেন, যা তাদের জন্য আরেকটি বড় চ্যালেঞ্জ।
দক্ষিণ কোরিয়ার অনেক কোম্পানি বন্ধ্যাত্ব চিকিৎসার জন্য ছুটির সুযোগ দিলেও নারীরা বলছেন, বাস্তবে তা নেওয়া বেশ কঠিন। কিম মি-এ তার প্রথম সন্তানের জন্য আইভিএফ করিয়েও একবারও ছুটি নেননি। অন্যদিকে, জাং সে-রেয়নের সহকর্মীরা তাকে চিকিৎসা পেছানোর পরামর্শ দিয়েছিলেন।
জাং বলেন, 'আইভিএফ ও ফুলটাইম চাকরি একসঙ্গে করা সম্ভব নয় বলে মনে হয়েছিল। তাই চাকরি ছেড়ে দিয়েছিলাম। তবে চাকরি ছাড়ার পর আর্থিক সংকটে পড়েছিলাম, যা আমাকে আবার নতুন করে চাকরি খুঁজতে বাধ্য করেছে।'
এই আর্থিক ও সাংস্কৃতিক চাপ অনেকের সন্তান নেওয়ার স্বপ্নকে বাধাগ্রস্ত করলেও, জাং এর ইচ্ছা এখনও আগের মতোই রয়েছে। বিয়ের শুরুর দিকে তার দু'বার গর্ভপাত হয়েছিল, যা মনে পড়লে এখনও চোখে জল আসে।
তিনি বলেন, 'বাচ্চা হলে সীমাহীন ভালোবাসা জন্মানোর কথা সবাই বলে। আমার মনে হয়, সন্তান নিয়ে একসঙ্গে নিজের পরিবার গড়াই একজন মানুষের সবচেয়ে বড় সুখ।'