ডেনমার্কের আকাশে উড়ল প্রথম সম্পূর্ণ বিদ্যুৎচালিত বিমান, চার্জ দিতে সময় লাগে মাত্র ২০ মিনিট
ডেনমার্কের আকাশে প্রথমবারের মতো উড়ল একটি সম্পূর্ণ বিদ্যুৎচালিত উড়োজাহাজ। কোনো জ্বালানি না পুড়িয়েই এটি অতিক্রম করেছে ২০০ কিলোমিটার পথ। সাধারণ বৈদ্যুতিক গাড়ির 'ফাস্ট চার্জার' ব্যবহার করে মাত্র ২০ থেকে ৪০ মিনিটের মধ্যেই চার্জ করা যায় এই প্লেন, এমনটাই জানিয়েছেন এর নির্মাতারা।
সন্ডারবর্গ থেকে কোপেনহেগেনে উড়ে যাওয়া ছোট এই বিমানটি দেখতে সাধারণ মনে হলেও—এটি ডেনমার্কের ইতিহাসের প্রথম সম্পূর্ণ বিদ্যুৎচালিত বিমান। ইউএস এরোস্পেস কোম্পানি বেটা টেকনোলোজিস-এর বানানো এই বিমানের নাম আলিয়া সিটিওএল।
মাত্র ১৫ মিটার ডানার বিস্তৃতির এই ছোট আকারের উড়োজাহাজটি দেখতে অনেকটা স্প্রিন্টার ভ্যানের মতো। এটি ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ২৮১ কিলোমিটার গতিতে উড়তে পারে এবং প্রতি চার্জে সর্বোচ্চ ৬২২ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে সক্ষম।
বেটা টেকনোলজিসের দাবি, প্রচলিত উড়োজাহাজ ও হেলিকপ্টারের তুলনায় এই ফিক্সড-উইং বৈদ্যুতিক উড়োজাহাজ বেশি নিরাপদ, নিঃশব্দ চলে এবং স্বল্প খরচে পরিচালিত।
বিমানটি প্রচলিত হেলিকপ্টারের তুলনায় প্রায় ৮৪ শতাংশ কম কার্বন ডাই-অক্সাইড নিঃসরণ করে, ফলে পরিবেশবান্ধব পরিবহনের সম্ভাবনা আরও বাড়ছে।
মূল চ্যালেঞ্জ ব্যাটারি ও চার্জিং
ড্যানফস ব্যাটারি সিস্টেম কোম্পানির চেয়ারম্যান এমেরিটাস ইয়োর্গেন ম্যাডস ক্লাউসেন মনে করেন, বড় আকারের বৈদ্যুতিক উড়োজাহাজের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যাটারি প্রযুক্তি আগামী দশকের মধ্যেই বাজারে আসবে। তিনি বলেন, 'একবার প্রযুক্তি পরিপক্ব হয়ে গেলে দ্রুতগতিতে উন্নয়ন ঘটবে, যেমনটি হয়েছিল বৈদ্যুতিক গাড়ির ক্ষেত্রেও।'
বিমানটিকে চার্জ দেওয়া যায় সাধারণ ইলেকট্রিক গাড়ির চার্জার দিয়েই, এবং এতে সময় লাগে মাত্র ২০ থেকে ৪০ মিনিট। তবে ইউরোপে এখনো স্থায়ী চার্জিং অবকাঠামো না থাকায় উড়োজাহাজটি নিজের চার্জার বহন করে নিয়ে যাচ্ছে, এবং স্থানীয় বিদ্যুৎ ইউনিটে যুক্ত হয়ে চার্জ নিচ্ছে, যা তুলনামূলকভাবে বেশি সময় নিচ্ছে।

কোপেনহেগেন বিমানবন্দরের সিইও ক্রিশ্চিয়ান পুলসেন জানিয়েছেন, বৈদ্যুতিক উড়োজাহাজের জন্য চার্জিং অবকাঠামো গড়ে তুলতে হবে, যাতে ভবিষ্যতে প্রচলিত ও বৈদ্যুতিক উভয় ধরনের উড়োজাহাজ একসঙ্গে পরিচালনা করা সম্ভব হয়।
বেটা টেকনোলজিসের প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা শন হল বলেন, 'যুক্তরাষ্ট্রে যেমন অবকাঠামো তৈরি হয়েছে, ইউরোপে এখনো তা গড়ে ওঠেনি।'
সন্ডারবর্গ বিমানবন্দরের পরিচালক জাকুপ স্ভেরি ক্যাস এই উড্ডয়নকে ডেনমার্কের বিমান শিল্পে নতুন যুগের সূচনা বলে উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন, 'অনেকে বলেন সবুজ বিমানচালনা ভবিষ্যতের বিষয়, কিন্তু আজ আমরা সেই ভবিষ্যতেরই বাস্তব রূপ দেখছি।'
উড়োজাহাজটি বর্তমানে ইউরোপ সফরে আছে। এটি মে মাসে আয়ারল্যান্ডের শ্যানন বিমানবন্দর থেকে যাত্রা শুরু করে ইউরোপের বিভিন্ন শহরের বিমানবন্দরে প্রদর্শনীমূলক অবতরণ করেছে। আগামী আগস্টে এটি নরওয়ের বার্গেন ও স্ট্যাভেঙ্গারের মধ্যে পণ্য পরিবহনের পরীক্ষামূলক ফ্লাইট পরিচালনা করবে, যা পরিচালনা করছে নরওয়ের বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ।
বিকল্প জ্বালানি প্রযুক্তির সমন্বয়
বিশেষজ্ঞদের মতে, শুধুমাত্র বৈদ্যুতিক উড়োজাহাজ নয়, বরং টেকসই ফ্লাইট বাস্তবায়নে হাইব্রিড ও হাইড্রোজেন জ্বালানির প্রযুক্তিও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
ড্যানিশ টেকনোলজিক্যাল ইনস্টিটিউটের নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবস্থার টিম ম্যানেজার লাসে স্টেনহয় ইনগভার্ডসেন বলেন, 'আমাদের একটি মাত্র প্রযুক্তিতে আটকে থাকার প্রয়োজন নেই। সাস্টেইনেবল এভিয়েশন জ্বালানি, ইলেকট্রিক, হাইব্রিড বা হাইড্রোজেন—সবগুলোই কাজে লাগাতে হবে।'

ডেনমার্ক সরকার ২০২৫ সালের মধ্যে প্রথম সম্পূর্ণ টেকসই অভ্যন্তরীণ ফ্লাইট চালু করতে চায়। ২০৩০ সালের মধ্যে সব অভ্যন্তরীণ রুটকে জীবাশ্ম জ্বালানিমুক্ত করার লক্ষ্যমাত্রাও নির্ধারণ করেছে। এই উদ্যোগ বাস্তবায়নে এ বছর যাত্রীপ্রতি ১৩ ড্যানিশ ক্রোনার (প্রায় ১.৭৪ ইউরো) ফি ধার্য করা হয়েছে।
নরওয়ে, সুইডেন, নেদারল্যান্ডস, ফ্রান্স ও যুক্তরাজ্যও একই পথে হাঁটছে।
নরওয়েতে ২০৪০ সালের মধ্যে সব অভ্যন্তরীণ ফ্লাইটকে বৈদ্যুতিক বা হাইব্রিডে রূপান্তরের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। আর সুইডেন জানিয়েছে, ২০৩০ সালের মধ্যে সব অভ্যন্তরীণ ফ্লাইট এবং ২০৪৫ সালের মধ্যে আন্তর্জাতিক ফ্লাইটগুলোও জীবাশ্ম জ্বালানিমুক্ত করা হবে।
সুইডেনের হার্ট অ্যারোস্পেস ৩০ আসনের ব্যাটারি চালিত প্লেন ইএস-৩০ তৈরি করছে, যেটি এক চার্জে ২০০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে পারে।