ইরানের ‘মিসিং ইউরেনিয়াম’ নিয়ে চলছে ‘ইঁদুর বিড়াল’ লুকোচুরি!

ইরানের গুরুত্বপূর্ণ পারমাণবিক স্থাপনাগুলোতে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের যৌথ বিমান হামলার পর জটিল এক পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছে জাতিসংঘের পরমাণু পর্যবেক্ষণ সংস্থা (আইএইএ)। প্রশ্ন উঠছে, মার্কিন বিমান হামলায় উন্নতমানের ইউরেনিয়ামের যে মজুদ ধ্বংস হওয়ার কথা বলা হচ্ছে, তা আসলেই ধ্বংস হয়েছে, না-কি আগেভাগেই সরিয়ে ফেলা হয়েছে?
গত সপ্তাহান্তে ইরানের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ পারমাণবিক স্থাপনা ফোরদো, নাতাঞ্জ ও ইসফাহানে চালানো বিমান হামলার পর মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প দাবি করেন, এসব স্থাপনায় বাংকার বাস্টার বোমা ব্যবহারের মাধ্যমে 'সম্পূর্ণ ধ্বংস' করে দেওয়া হয়েছে।
তবে জাতিসংঘের পারমাণবিক পর্যবেক্ষক সংস্থা (আইএইএ) বলছে, বিশেষ করে পাহাড়ের গভীরে অবস্থিত ফোরদো প্ল্যান্টে কী পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, তা এখনো স্পষ্ট নয়। এই স্থাপনাতেই ইরান সর্বোচ্চমাত্রার ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করত।
আইএইএ প্রধান রাফায়েল গ্রোসি সোমবার জানান, ফোরদোর অভ্যন্তরে থাকা স্পর্শকাতর সেন্ট্রিফিউজগুলো 'সম্ভবত' মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে ইরানের যে নয় টন সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম মজুদ রয়েছে, যার মধ্যে প্রায় ৪০০ কেজি ৬০ শতাংশ মাত্রায় সমৃদ্ধ (ওয়েপন গ্রেড), তা ধ্বংস হয়েছে কি না—সে বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
তথ্য অনুযায়ী, এই ইউরেনিয়ামকে ৯০ শতাংশ মাত্রায় সমৃদ্ধ করা হলে, তা দিয়ে অন্তত নয়টি পারমাণবিক বোমা তৈরি করা সম্ভব। ফলে এসব ইউরেনিয়াম নিখোঁজ থাকলে তা আন্তর্জাতিক নিরাপত্তার জন্য গুরুতর উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়াবে।
'চোর-পুলিশ' খেলা শুরু
রয়টার্সকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বর্তমান ও সাবেক অন্তত ডজনখানেক পশ্চিমা কর্মকর্তা বলেন, এই হামলা ইরানকে ইউরেনিয়াম মজুদ গোপনে সরিয়ে নেওয়ার জন্য আদর্শ সুযোগ করে দিয়েছে। আর তা যদি হয়ে থাকে, তবে আইএইএর অনুসন্ধান হবে দীর্ঘমেয়াদি ও কঠিন।
২০০৫-২০১০ সাল পর্যন্ত আইএইএর শীর্ষ পরিদর্শক হিসেবে দায়িত্ব পালন করা ওলি হেইনোন বলেন, 'ধ্বংসপ্রাপ্ত ভবন থেকে নমুনা সংগ্রহ, ফরেনসিক বিশ্লেষণ এবং পরিবেশগত নমুনা পরীক্ষা করতে অনেক সময় লেগে যাবে। ধ্বংসাবশেষের নিচে অনেক উপাদান চাপা পড়ে থাকতে পারে, আবার কিছু হয়তো পুরোপুরি হারিয়েও গেছে।'
ইউরেনিয়াম সরানোর আলামত
আইএইএ প্রধান গ্রোসি জানান, ইসরায়েল হামলা চালানোর দিন অর্থাৎ ১৩ জুন, ইরান জানায় তারা পারমাণবিক স্থাপনা ও উপাদান সুরক্ষার জন্য 'প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ' নিচ্ছে। যদিও কী ধরনের পদক্ষেপ, তা ইরান খোলাসা করেনি।
পশ্চিমা এক কূটনীতিক রয়টার্সকে বলেন, 'হামলার কয়েকদিন আগেই সম্ভবত ফোরদো থেকে অধিকাংশ ইউরেনিয়াম সরিয়ে ফেলা হয়েছিল। এমনটা মনে হচ্ছে যেন ইরান জানত যে হামলা হতে যাচ্ছে।'
স্যাটেলাইট চিত্রেও ফোরদোর বাইরে ট্রাকসহ একাধিক গাড়ির চলাচল দেখা গেছে, যা ইউরেনিয়াম স্থানান্তরের ইঙ্গিত দেয় বলে মনে করছেন কিছু বিশ্লেষক। যদিও যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী পিট হেগসেথ বৃহস্পতিবার বলেন, ইরান ইউরেনিয়াম সরিয়ে ফেলেছে—এমন গোয়েন্দা তথ্য তার কাছে নেই।
ডোনাল্ড ট্রাম্পও এই সম্ভাবনা নাকচ করে দেন। ফক্স নিউজকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, 'ওরা কিছুই সরায়নি। ওগুলো (ইউরেনিয়াম) খুব ভারী, সরানো খুব কঠিন। আর আমরা হঠাৎ করেই হামলা করেছি, তারা জানতেই পারেনি।'
হোয়াইট হাউস এই বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেনি। মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর কেবল ট্রাম্পের প্রকাশ্য বক্তব্যের দিকেই ইঙ্গিত করেছে।
একজন দ্বিতীয় পশ্চিমা কূটনীতিক রয়টার্সকে বলেন, অতীতে ঘোষণাবহির্ভূত স্থানে ইউরেনিয়ামের উপস্থিতি নিয়ে আইএইএর সঙ্গে ইরানের বিরোধের ইতিহাস বিবেচনায় ইরানের ইউরেনিয়াম মজুদের প্রকৃত অবস্থা নিরূপণ করা একটি বড় চ্যালেঞ্জ হবে।
'এটা এখন আসলেই এক ধরণের 'চোর-পুলিশ' খেলা,' বলেন তিনি।
অন্যদিকে, তেহরান দাবি করছে, তারা পরমাণু কর্মসূচি নিয়ে আইএইএর সঙ্গে সব ধরনের চুক্তি ও বাধ্যবাধকতা মেনে চলেছে।
ইসরায়েলের ১২ দিনের এই সামরিক অভিযান শুরু করার আগে পর্যন্ত ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে নিয়মিত পর্যবেক্ষণ চালানোর সুযোগ পেত আইএইএ। ১৯১-দেশের পরমাণু অস্ত্র বিস্তার রোধ চুক্তির (এনপিটি) আওতায় সদস্য দেশ হিসেবে তেহরান তার ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণের তথ্য প্রকাশে বাধ্য। আর সেই তথ্য যাচাই করতো আইএইএর পরিদর্শকরা।
কিন্তু এখন—সবকিছুই আক্ষরিক অর্থেই ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে।
এর মধ্যেই ইরান হুঁশিয়ারি দিয়েছে, তারা আইএইএর-এর কার্যক্রমে আর সহযোগিতা করবে না। দেশটির পার্লামেন্ট একটি প্রস্তাব পাস করে আইএইএর সঙ্গে কাজ স্থগিত করার পক্ষে ভোট দিয়েছে। তাদের অভিযোগ, আইএইএ-এর সম্প্রতি নেওয়া এক প্রস্তাব ইসরায়েলের বিমান হামলার জন্য কূটনৈতিক আচ্ছাদন তৈরি করেছে।
তেহরান বলছে, আইএইএ-এর ৩৫ সদস্যবিশিষ্ট বোর্ড সম্প্রতি ইরানকে পরমাণু চুক্তি লঙ্ঘনের দায়ে অভিযুক্ত করে যে প্রস্তাব পাস করেছে, তার পরদিনই ইসরায়েল হামলা শুরু করে। যদিও সংস্থাটি এই অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছে।
ইরান দীর্ঘদিন ধরেই দাবি করে আসছে যে তারা পরমাণু বোমা তৈরির কোনও কর্মসূচি চালাচ্ছে না। যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোও বলেছে, এর পক্ষে কোনও কার্যকর প্রমাণ নেই। তবে সামরিক কার্যক্রম ছাড়াই ৬০ শতাংশ মাত্রায় ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করার যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন বিশেষজ্ঞরা। কারণ, বেসামরিক চুল্লি পরিচালনায় ৫ শতাংশেরও কম ইউরেনিয়ামই যথেষ্ট।
আইএইএ জানায়, ইরান তাদের মজুদের হিসাব দিতে বাধ্য এবং সংস্থাটি তা যাচাই করে পরিদর্শনসহ নানা উপায়ে। তবে আইএইএর ক্ষমতা সীমিত। তারা কেবল ঘোষিত পরমাণু স্থাপনাগুলোতেই যেতে পারে, গোপন স্থানে হঠাৎ করে ঢুকতে পারে না।
এর মধ্যে আরও উদ্বেগের বিষয় হলো আইএইএ বলছে, ইরানের হাতে এমন আরও অনেক অতিরিক্ত সেন্ট্রিফিউজ রয়েছে, যেগুলোর অবস্থান আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের অজানা। এসব যন্ত্র দিয়ে তারা গোপনে নতুন সমৃদ্ধকরণ কেন্দ্র চালু করতে পারে।
ওয়াশিংটনভিত্তিক আর্মস কন্ট্রোল অ্যাসোসিয়েশনের কেলসি ড্যাভেনপোর্ট শুক্রবার এক্স-এ লিখেন, '৬০ শতাংশ সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম হয়তো হামলার প্রাথমিক লক্ষ্য ছিল না, কিন্তু এখন তা বিস্তার ঝুঁকির অন্যতম প্রধান উপাদান, বিশেষত যদি সেন্ট্রিফিউজগুলো হিসাববহির্ভূত থাকে।'
আইএইএ জানিয়েছে, তারা যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলসহ বিভিন্ন সদস্য রাষ্ট্র থেকে গোয়েন্দা তথ্য পায়, কিন্তু কোনও তথ্যই সরাসরি আমলে নেয় না, বরং নিজস্বভাবে যাচাই করে দেখে। অথচ, যেসব স্থাপনায় ইউরেনিয়াম রাখা ছিল, সেগুলোতেই হামলা চালিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল। এ কারণে তাদেরই এখন অভিযোগ তোলার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি বলে মনে করছেন কর্মকর্তারা।
ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর দপ্তর রয়টার্সের কাছে এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হয়নি।
ইরাকের ছায়া: আবারও 'শূন্যের পেছনে দৌড়'?
জাতিসংঘের পরিদর্শকরা ২০০৩ সালের ইরাক যুদ্ধের আগে 'গণবিধ্বংসী অস্ত্রের' খোঁজে অসফলতার অভিজ্ঞতা দেখিয়েছে, সামান্য তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে কোনও রাষ্ট্রের গোপন মজুদের সন্ধান কতটা কঠিন হতে পারে। এবারও, সেই ধরনের অনিশ্চয়তার পুনরাবৃত্তি হতে পারে।
'ইরান যদি তাদের ৪০০ কেজি উচ্চমাত্রায় সমৃদ্ধ ইউরেনিয়ামের ব্যাপারে স্বচ্ছ হয়, তাহলে এই সমস্যা সামাল দেওয়া যাবে। কিন্তু যদি না হয়, তাহলে কেউই নিশ্চিত হতে পারবে না, আসলে কী ঘটেছে,' বলেন এক পশ্চিমা কূটনীতিক।
আইএইএ একাধিকবার বলেছে, তারা পুরোপুরি নিশ্চিত করে বলতে পারছে না যে ইরানের পরমাণু কর্মসূচি পুরোপুরি শান্তিপূর্ণ। তবে কোনও সুসংগঠিত অস্ত্র তৈরির কর্মসূচির প্রমাণও তাদের হাতে নেই।
এই সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্র আইএইএ-এর পর্যবেক্ষণ কাজের প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানিয়েছে এবং তেহরানকে দেশটিতে থাকা পরিদর্শকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার আহ্বান জানিয়েছে।
প্রতি গ্রাম ইউরেনিয়ামের হিসাব চাওয়া আইএইএ-এর মানদণ্ড, কিন্তু…
আইএইএর হিসাব অনুযায়ী, ইরানের যে দুটি স্থাপনায় ৬০ শতাংশ মাত্রার ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ হতো, তার একটি নাতাঞ্জ। এটিকে সম্পূর্ণভাবে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। ফলে এটির মজুদ কিছুটা ধ্বংস হয়ে থাকতে পারে। অন্যদিকে, পাহাড়ের গভীরে এবং বৃহৎ পরিমাণ ইউরেনিয়াম তৈরিকারী ফোরদো স্থাপনাতে যুক্তরাষ্ট্র তাদের সবচেয়ে বড় বোমা হামলা করেছে। তবে এখানকার ভূগর্ভস্থ কক্ষগুলোর অবস্থা এখনো অস্পষ্ট।
ইসফাহানে ভূগর্ভস্থ একটি এলাকাতেও বোমাবর্ষণ করা হয়েছে। এখানে ইরানের সর্বোচ্চ মাত্রায় সমৃদ্ধ ইউরেনিয়ামের একটি বড় অংশ সংরক্ষিত ছিল। হামলায় এর টানেলের প্রবেশপথ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
আইএইএ জানায়, ইসরায়েলি বিমান হামলা শুরু হওয়ার পর থেকে সংস্থাটি এসব স্থাপনায় কোনও পরিদর্শন করতে পারেনি। ফলে বাইরে থেকে বিষয়টি বোঝার সুযোগ আরও কঠিন হয়ে পড়েছে।
আইএইএ প্রধান রাফায়েল গ্রোসি বুধবার বলেন, 'এসব স্থানে এখন অনেক ধ্বংসাবশেষ পড়ে আছে, এমনকি অবিস্ফোরিত বোমাও থাকতে পারে। এই অবস্থায় আমাদের পরিদর্শকদের জন্য কাজ করা খুব কঠিন হয়ে পড়বে।'
সংস্থাটির সাবেক প্রধান পরিদর্শক ওলি হেইনোন বলেন, 'আইএইএর উচিত দ্রুতই জানানো—তারা কী স্বাধীনভাবে যাচাই করতে পেরেছে, কোথায় সন্দেহ রয়েছে, আর কোন বিষয়গুলো এখনো অজানা রয়ে গেছে। এতে করে সদস্য রাষ্ট্রগুলো নিজেদের ঝুঁকি মূল্যায়ন করতে পারবে।'