অন্নপূর্ণা অভিযানের ৭৫ বছর: জয়ের আড়ালে চাপা পড়া এক নির্মম সত্যের গল্প

১৯৫০ সালের ৩ জুন। প্রথমবারের মতো আট হাজার মিটারের উপরে কোনো শৃঙ্গ জয় করে নতুন ইতিহাস রচনা করে ফরাসি দুই পর্বতারোহী। মরিস হারজোগ ও লুইস লাশেনাল পৌঁছান হিমালয়ের অন্নপূর্ণা (৮,০৯১ মিটার) শিখরে ।
সেই কীর্তির ৭৫ বছর পূর্তিতে ফ্রান্স জুড়ে স্মরণ করা হয় এই 'ঐতিহাসিক বিজয়কে'। ফরাসি সংবাদমাধ্যমগুলো পুরনো বইপত্র, স্মৃতি আর গৌরবগাথা টেনে আনতে ব্যস্ত। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই 'বীরত্বগাথা' যেন অনেকটাই পালটে গিয়েছে, জন্ম দিয়েছে নতুন বিতর্কের।
চূড়ায় ওঠার দিন, মরিস হারজোগ তার সঙ্গী লাশেনালকে বলেছিলেন, যেন একের পর এক ছবি তোলা হতে থাকে তার । ছবিগুলো সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়বে।
কিন্তু লাশেনাল ছবি তোলার জন্য দাঁড়াতে পারছিলেননা। তার পা জমে গিয়েছিল বরফে , ছিলনা তাতে কোন অনুভূতি। তিনি শুধু নিচে নেমে আসতে চেয়েছিলেন, প্রাণ বাঁচাতে। সেই অভিযানের একমাত্র সংরক্ষিত ছবিতে দেখা যায়, লাশেনাল কুঁকড়ে বসে আছেন বরফের মাঝে, যেন কোনো নির্দেশের অপেক্ষায় থাকা ক্লান্ত জীব।
কিন্তু লাশেনাল ছিলেন সে সময়কার সবচেয়ে সম্মানিত, দ্রুতগামী এবং অভিজ্ঞ পর্বতারোহী। পেশাদার 'হাই অলটিটিউড গাইড' হিসেবে তার খ্যাতি ছড়িয়েছিল চারদিকে।
আর হারজোগ? তিনি ছিলেন অপেশাদার, যার প্রধান লক্ষ্য ছিল গল্প লেখা, অন্নপুর্ণা বিজয়ের গল্প। লাশেনালের পাশাপাশি অভিযানে ছিলেন বিখ্যাত আরো দুই পর্বতারোহী লিওনেল তেরেই ও গাস্তোঁ রেবুফা। শর্ত ছিল পুরো অভিযান নিয়ে লিখবেন শুধু হারজোগ তার নিজের ভাষায়। বাকিদের অবশ্য এতে আপত্তি ছিল না। তারা চেয়েছিলেন শুধু নতুন একটা শৃঙ্গ ছুঁতে, জয়ের আনন্দ নিতে।
হারজোগের ছিল প্রয়োজনীয় অভিজ্ঞতার ঘাটতি । তবে লাশেনালের সাহস ও দক্ষতা সেসব ঘাটতি পুরণ করে দেয়। তবে হারজোগের ছিল এক ধরনের অন্ধ জেদ , তিনি চূড়া না ছুঁয়ে ফিরবেনই না।
৩ জুন সকালে, এই ভিন্ন মানসিকতার দুজন একসঙ্গে চলছিলেন চূড়ার দিকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই লাশেনাল বুঝলেন, যদি এভাবে চলেন, তবে তার পা নষ্ট হয়ে যাবে, আর পা মানেই তো একজন পর্বতারোহীর পুরো জীবন। তখন তিনি হারজোগকে বললেন তিনি ফিরতে চান। প্রত্যুত্তরে হারজোগ জানায়, "তাইলে আমি একাই চলব।"এটা ছিল একরকম জেদ।
লাশেনাল জানতেন, পাহাড়ে একজন আরোহীর জীবন তার সঙ্গীর ওপর নির্ভর করে। সাথে এটাও জানতেন হারজোগ একা উঠলে আর ফিরবেন না,কেননা তার সেই দক্ষতা নেই, আছে শুধু উন্মাদনা। সেই বোধ থেকেই লাশেনাল হার মানেননি, উঠে যান হারজোগের সাথে। প্রতিটি পদক্ষেপেই পা হারানোর সম্ভাবনা বাড়ছিল। কয়েক ঘণ্টা ধরে তার পায়ে কোনো অনুভূতি ছিল না।

চূড়া জয়ের পর আসল লড়াই শুরু হয় নামার পথে। চারদিক ঘিরে ফেলে ঘন কুয়াশা। দিক হারিয়ে ফেলে দুই অভিযাত্রী। তখনই লুইস লাশেনালের ভেতরে জেগে ওঠে এক ধরনের অব্যক্ত টিকে থাকার তাগিদ। শেষপর্যন্ত তারা খুঁজে পান তেরেই ও রেবুফার সহায়তা। লাশেনাল আকুতি করেন তার বন্ধু তেরেইয়ের কাছে, "আমার পা… আমাকে এখনই নিচে নামাও। ডাক্তার দরকার।"
কিন্তু কুয়াশা আবার তাদের গিলে ফেলে। তারা চারজন ঠাঁই নেন এক বরফ-চিড়ের গভীরে,নেমে আসে চরম ঠান্ডা আর দুর্ভোগের এক রাত। হারজোগ হারিয়ে ফেলেছিলেন গ্লাভস, আর তার পরিণতিতে হারান হাতের আঙুল।এদিকে লাশেনালের ক্ষেত্রে দুঃস্বপ্ন বাস্তব হয়, কেটে ফেলতে হয় তার পায়ের সব আঙুল।
নেপাল থেকে ফেরার পথে একটি দৃশ্য ধরা পড়ে ক্যামেরায়, তেরেইয়ের কোলে ভর করে বিমান থেকে নামছেন লাশেনাল। শরীর যেন কেবল হাড় ও চামড়া, পা মোটা সাদা ব্যান্ডেজে মোড়ানো। তখন তার বয়স মাত্র ২৮।
এর এক বছর পর, মরিস হারজোগ প্রকাশ করেন অন্নপূর্ণা: ফার্স্ট কঙ্কুয়েস্ট অফ এন ৮০০০-মিটার পিক- আনুষ্ঠানিক অভিযান কাহিনি। বইটি হয়ে ওঠে বিশ্বজুড়ে বেস্টসেলার। ২ কোটির বেশি কপি বিক্রি হয়, অনূদিত হয় ৬০টিরও বেশি ভাষায়। হারজোগ হয়ে ওঠেন 'জাতীয় বীর'। পরবর্তীতে মন্ত্রী হন, হন মেয়রও।
কিন্তু এই বইয়ে লাশেনালের উপস্থিতি ধোঁয়াটে, সেই অস্পষ্ট শৃঙ্গ জয়ের ছবির মতোই। অথচ পর্বতারোহণ বিষয়ক সাহিত্যে বইটি হয়ে ওঠে এক 'ক্লাসিক', যেটি পরবর্তী অনেক অভিযানের ভিত্তি গড়ে দেয়।
১৯৫৫ সালে হারজোগের একচেটিয়া গল্প বলার চুক্তির মেয়াদ শেষ হলে, লাশেনাল শুরু করেন নিজের লেখা। সেখানে তিনি তুলে ধরতে চেয়েছিলেন সব অপূর্ণতা, অপ্রকাশিত সত্য। কিন্তু বই ছাপা দেখে যেতে পারেননি। স্কিইং করতে গিয়ে তিনি পড়ে যান এক বরফ-চিড়ায়, আর ফিরে আসেননি।
১৯৫৬ সালে তার বই প্রকাশ পায়, তবে অনেক অংশ সেন্সর করে দেন হারজোগ। সত্যিকারের লাশেনাল তখনও অধরা। তার প্রকৃত কণ্ঠস্বর প্রকাশিত হয় বহু বছর পর ২০২০ সালে, পলসেন এডিশন থেকে 'র্যাপেলস' নামে, সম্পূর্ণ ও অবিকৃত।
এরই মাঝে, ২১শ শতকের শুরুতে গুঞ্জন শুরু হয়,তারা কি সত্যিই চূড়ায় পৌঁছেছিলেন? নাকি সেটি ছিল এক চুক্তিবদ্ধ মিথ্যা? হারজোগ যেই শৃঙ্গ জয়ের ছবিটি উপস্থাপন করেছিলেন, তা চূড়ার ছবি না হয়ে যে কোনো জায়গারই হতে পারে।
তবে স্যাটেলাইট ছবি ও তুলনামূলক গবেষণায় সম্প্রতি প্রমাণ মেলে লাশেনাল ও হারজোগ চূড়ায় পৌঁছেছিলেন ঠিকই। যদিও অন্নপূর্ণার চূড়া আসলে এক দীর্ঘ ৩০০ মিটার রিজ, যেখানে রয়েছে দু-তিনটি প্রায় একই রকম শিখর।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ফ্রান্সের পরাজয়ের পর যে সম্মান পুনরুদ্ধারের চেষ্টা চলছিল, তার অংশ হিসেবে অন্নপূর্ণা অভিযানকে ব্যবহার করা হয়। হারজোগ যেখানে চেয়েছিলেন ছবির মাধ্যমে 'ফ্রান্সের গৌরব' দেখাতে।লাশেনালের লেখায় উঠে আসে নিজের স্পষ্ট অবস্থান, তিনি ছিলেন না সেই জাতীয়তাবাদী আবেগের অংশ। লাশেনালের কাছে গুরুত্বপূর্ণ ছিল সুরক্ষিতভাবে ফিরে আসা। যেমনটা হয় অন্য কোনো সাধারণ অভিযানে।
পর্বত তার কাছে ছিল না কোনো পতাকা ওড়ানোর জায়গা। না কোনো বীরত্বগাথা রচনার কারখানা। না কোনো রাজনীতি বা আত্মপ্রচারের মঞ্চ। পর্বত মানেই নিজেকে জানার, বাঁচিয়ে রাখার এক অভিজ্ঞতা।
হারজোগের লেখা তাই অনেকটাই একতরফা। এক ধরনের আবেগে মোড়া বিজয়গাথা যা পরবর্তী কয়েক দশক ধরে পর্বতারোহণের মূল চিত্র হয়ে দাঁড়ায়: মানুষ বনাম পাহাড়, অসম্ভবকে জয়, পুরুষত্বের প্রতীক, গৌরব, বিজয়।
কিন্তু আজকের দুনিয়ায় সেই গল্প প্রাসঙ্গিকতা হারায়। আজ আর পর্বতজয় মানে 'জয় কিংবা মৃত্যু' নয় বরং 'জীবনের জন্যই জয়'। ঠিক একইরকম কথাই বলেছিলেন বিখ্যাত আমেরিকান পর্বতারোহী স্টিভ হাউস - "একজন পর্বতারোহীর সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা হলো - ফিরে না আসা।"
বাকি সব, কেবল সাহিত্য।
অনুবাদ : নাফিসা ইসলাম মেঘা