যুক্তরাষ্ট্রের বৃহত্তম শহর নিউইয়র্কের প্রথম মুসলিম মেয়র কে এই জোহরান মামদানি?
৩৩ বছর বয়সী দক্ষিণ এশীয় বংশোদ্ভূত মুসলিম জোহরান মামদানি মঙ্গলবার নিউইয়র্কের রাজনীতিতে আলোড়ন সৃষ্টি করেছেন। সাবেক গভর্নর অ্যান্ড্রু কুমো ও রিপাবলিকান পার্টির প্রার্থী কার্টিস স্লিওয়াকে পরাজিত করে শহরটির মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন তিনি।
এই জয়ের মধ্য দিয়ে অনেকগুলো 'প্রথমের' জন্ম দিয়ে ইতিহাসে নাম লেখাতে যাচ্ছেন এ ডেমোক্রেটিক সোশ্যালিস্ট নেতা। তিনি হতে যাচ্ছেন নিউইয়র্ক সিটির প্রথম মুসলিম, প্রথম দক্ষিণ এশীয় বংশোদ্ভূত এবং আফ্রিকায় জন্মগ্রহণকারী প্রথম মেয়র।
শুধু তা-ই নয়, আগামী ১ জানুয়ারি যখন দায়িত্ব গ্রহণ, তখন মামদানি হবেন এক শতাব্দীরও বেশি সময়ের মধ্যে শহরটির সর্বকনিষ্ঠ মেয়র।
কে এই মামদানি?
৩৩ বছর বয়সী জোহরান কোয়ামে মামদানি একজন ডেমোক্র্যাটিক সোশ্যালিস্ট। তিনি উগান্ডার প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ মাহমুদ মামদানি ও ভারতীয় চলচ্চিত্র নির্মাতা মীরা নায়ারের ছেলে।
মামদানির জন্ম উগান্ডার কামপালায়। তিনি সাত বছর বয়সে নিউইয়র্কে চলে আসেন। পরে যুক্তরাষ্ট্রের মেইনের বোডিন কলেজ থেকে আফ্রিকান স্টাডিজে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। রাজনীতিতে আসার আগে তিনি কম আয়ের পরিবারের বাসাবাড়ি হারানো ঠেকাতে 'হাউজিং কাউন্সেলর' হিসেবে কাজ করতেন।
২০২০ সালে নিউইয়র্ক স্টেট অ্যাসেম্বলির ৩৬ নম্বর আসন থেকে নির্বাচিত হন মামদানি। তিনি কুইন্সের আস্টোরিয়া এলাকা প্রতিনিধিত্ব করেন।
চলতি বছরের শুরুতে মামদানি বিয়ে করেছেন ২৭ বছর বয়সী সিরীয় শিল্পী রামা দুয়াজিকে। তিনি ব্রুকলিনে থাকেন। রামার কাজ দ্য নিউইয়র্কার, দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট ও ভাইস-এর মতো আন্তর্জাতিক প্রকাশনায় প্রকাশিত হয়েছে। তিনি অ্যানিমেশন ও সিরামিক শিল্পেও কাজ করেন।
নির্বাচনী প্রচারে তিনি উর্দু ভাষায় ভিডিও, বলিউড ক্লিপ এবং স্প্যানিশ ভাষায় বক্তব্য ব্যবহার করে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের ভোটারদের কাছে পৌঁছাতে সক্ষম হন।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন তিনি, বিশেষ করে জেনজি-দের মাঝে।
ইতিহাস গড়ে মেয়র
জোহরান মামদানি নিউইয়র্ক সিটির পরবর্তী মেয়র হিসেবে নির্বাচিত হয়ে ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন। তিনি শুধু এই শহরের প্রথম মুসলিম মেয়রই নন, প্রথম দক্ষিণ এশীয় এবং আধুনিক সময়ের অন্যতম কনিষ্ঠ মেয়র হিসেবেও দায়িত্ব গ্রহণ করবেন।
২০২৬ সালের ১ জানুয়ারি মামদানি আনুষ্ঠানিকভাবে মেয়রের দায়িত্ব নেবেন। তিনি ৮৫ লক্ষ মানুষের এই বিশাল শহরের দায়িত্ব নিচ্ছেন, যেখানে প্রায় ৩ লক্ষ কর্মী এবং ১১৫ বিলিয়ন ডলারের বাজেট রয়েছে।
অভিবাসী ও ট্যাক্সি চালকদের সঙ্গে সম্পর্ক
একজন অভিবাসী এবং দক্ষিণ এশীয় নিউইয়র্কার হিসেবে মামদানির পরিচয় তার প্রচারণার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল। তবে সিটি হলের জন্য দৌড় শুরু করার অনেক আগে থেকেই এই সম্প্রদায়ের সাথে তার সম্পর্ক গড়ে ওঠে।
২০২১ সালে তিনি ঋণের বোঝা থেকে মুক্তির দাবিতে নিউইয়র্ক সিটির ট্যাক্সি চালকদের সাথে ১৫ দিনের অনশন করে প্রথমবারের মতো পার্লামেন্টে আসেন।
নিউইয়র্ক সিটির ট্যাক্সি চালক সম্প্রদায়ের সাথে মামদানির একটি শক্তিশালী সংযোগ রয়েছে। এই সম্প্রদায়ের বেশিরভাগই অভিবাসী, যাদের মধ্যে হাজার হাজার দক্ষিণ এশীয় তার কট্টর সমর্থক ছিলেন।
প্রচারণার শেষ দিনগুলোতে মামদানি মধ্যরাতে লাগার্ডিয়া বিমানবন্দরের ট্যাক্সি স্ট্যান্ডে গিয়েছিলেন, শিফট পরিবর্তনের সময় চালকদের সাথে দেখা করতে।
গাজা যুদ্ধ নিয়া অবস্থান
মামদানি আমেরিকার নির্বাচিত নেতাদের মধ্যে সবচেয়ে স্পষ্ট ভাষায় ইসরায়েলের গাজা যুদ্ধে সমালোচনা করেছেন। ২০২৪ সালের ৩১ অক্টোবর এক্সে এক পোস্টে তিনি লিখেছিলেন, 'আমি সবসময় স্পষ্ট এবং সত্যের ওপর ভিত্তি করে বলি: ইসরায়েল গণহত্যা করছে।'
তিনি 'বয়কট, ডাইভেস্টমেন্ট, এবং স্যানকশনস' (বিডিএস) আন্দোলনের প্রবল সমর্থক। এই মাসের শুরুতে ম্যানহাটনে এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেছিলেন, 'আমার রাজনীতির মূল কথা হল অপ্রতিরোধ্য অহিংসা' — এ কারণে তিনি বিডিএস সমর্থন করেন।
মামদানির প্রচারের একটি আলোচিত ঘটনা ছিল ২০২৪ সালের ডিসেম্বর মাসে মেহেদি হাসানের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে, যেখানে তাকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু যদি নিউইয়র্ক আসেন, তিনি কী করবেন। মামদানি সরাসরি বলেছিলেন, 'আমি যদি মেয়র হতাম, নেতানিয়াহুকে নিউইয়র্ক আসলে গ্রেপ্তার করতাম।'
তিনি বলেন, 'এই শহরের নীতি আন্তর্জাতিক আইনের সঙ্গে মিলে যায়। আমাদের কর্মেও এটা প্রতিফলিত হওয়া উচিত।'
মামদানি 'গ্লোবালাইজ দ্য ইনতিফাদা' স্লোগান থেকে নিজেকে দূরে সরাতে অস্বীকার করেছেন। অনেক ইহুদি নেতা ও রক্ষণশীলরা এই স্লোগানকে উসকানিমূলক এবং ইহুদি বিরোধী বলে সমালোচনা করেছে।
২০২৫ সালের জুনে 'দ্য বালওয়ার্ক' পডকাস্টে তিনি বলেছিলেন, 'আমি একজন মুসলিম, ৯/১১ পড়ে বেড়ে উঠেছি, আরবি শব্দগুলো কীভাবে ভুল অর্থে ব্যবহার কড়া হতে পারে আমি জানি।' তিনি যোগ করেন, ওই স্লোগানটি মূলত দুনিয়ার নিপীড়িত মানুষের প্রতি সংহতি জানানোর কথা বলে, কোনো সহিংসতার আহ্বান জানায় না।
কুমোর প্রচারাভিযান মামদানির মুসলিম পরিচয় ও ফিলিস্তিনপন্থী অবস্থানের বিরুদ্ধে আক্রমণ করেছে, তাকর বিরুদ্ধে ইহুদি বিরোধিতার অভিযোগও আনা হয়েছে। নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সদর দপ্তর থাকায় বিশ্বের বৃহত্তম ইহুদি সম্প্রদায় বসবাস করে।
২০২৫ সালের জুনে এক সাক্ষাৎকারে ইসলামবিরোধী হুমকি পাওয়ার কথা জানিয়ে মামদানি বলেন, 'এই শহর ও দেশে ইহুদি বিরোধিতার কোনো স্থান নেই।' তিনি বার বার জোর দিয়ে বলেছেন, তার সমালোচনা মার্কিন ও ইসরায়েলি সরকারের নীতির বিরুদ্ধে, ইহুদিদের বিরুদ্ধে নয়।
মামদানির প্রচারণায় ছিল ২২ হাজারের বেশি স্বেচ্ছাসেবক এবং বার্নি স্যান্ডার্স, আলেকজান্দ্রিয়া ওকাসিও-কোর্টেজ ও ওয়ার্কিং ফ্যামিলিজ পার্টির মতো প্রগতিশীল নেতাদের সমর্থন।
নির্বাচনী প্রচারণায় তিনি যেসব প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন
জোহরান মামদানির নির্বাচনী প্রচার ছিল মানুষের জীবন সহজ ও সাশ্রয়ী করে তোলার প্রতিশ্রুতিতে ভরা। তিনি চাইছেন নিউইয়র্ক সিটিকে এমন এক শহরে রূপ দিতে, যেখানে বাস, আবাসন, খাবার ও শিক্ষা সবার জন্য আরও সহজলভ্য হবে।
তিনি প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, ২০২৭ সালের মধ্যে শহরের সব বাস ফ্রি করে দেবেন। তার মতে, যেখানে এই ব্যবস্থা পরীক্ষামূলকভাবে চালু হয়েছে, সেখানকার মানুষ উপকৃত হয়েছেন—বাসে যাত্রীর সংখ্যা বেড়েছে, চালকদের ওপর হামলা কমেছে।
আবাসনের ক্ষেত্রেও তিনি বড় পরিকল্পনা দিয়েছেন। রেন্ট-স্ট্যাবিলাইজড ফ্ল্যাটে ভাড়া বৃদ্ধি বন্ধ করার পাশাপাশি তিনি একটি নতুন সরকারি সংস্থা গড়ার প্রস্তাব দিয়েছেন, যারা সাশ্রয়ী দামে সরকারি মালিকানার ফ্ল্যাট বানাবে। শহরের মালিকানাধীন ভবনের ভাড়াও কমানোর কথা বলেছেন তিনি। ভাড়াটিয়াদের অধিক সুরক্ষা দেওয়ার কথাও তাঁর পরিকল্পনায় রয়েছে।
খাবার ও শিক্ষার ক্ষেত্রেও তার পরিকল্পনা স্পষ্ট। তিনি প্রতিটি বরোতে (স্বতন্ত্র প্রশাসনিক উপ-অঞ্চল) একটি করে সরকারি মুদি দোকান খোলার কথা বলেছেন, যেন যেসব এলাকায় বেসরকারি দোকান নেই, সেখানকার মানুষও সস্তায় স্বাস্থ্যকর খাবার পায়। তিনি চাচ্ছেন, সিটি কলেজের শিক্ষার্থীরাও যেন বিনা খরচে খাবার পায়। পাশাপাশি সার্বজনীন চাইল্ডকেয়ার ও প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা চালুর প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তিনি।
এসব কিছু বাস্তবায়নের জন্য মামদানি বড় কর সংস্কারের প্রস্তাব দিয়েছেন। তিনি চাইছেন বড় কোম্পানির ওপর বেশি কর বসাতে এবং যাদের আয় বছরে ১০ লাখ ডলারের বেশি, তাদের কাছ থেকে অতিরিক্ত কর আদায় করতে। তার প্রচার শিবির বলছে, এতে প্রতিবছর প্রায় ৯.৪ বিলিয়ন ডলার তোলা যাবে।
জননিরাপত্তার ক্ষেত্রেও তিনি বদল আনতে চান। পুলিশের বাজেট কমিয়ে তিনি একটি নতুন বিভাগ গড়তে চান, যেখানে মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ, সংকট মোকাবেলায় অভিজ্ঞ মানুষ ও সমাজকর্মীরা কাজ করবেন।
মামদানি প্রচার ছিল পুরোপুরি সাধারণ মানুষের ওপর নির্ভরশীল—স্বেচ্ছাসেবক, ছোট ছোট দানের টাকা আর তরুণ ভোটারদের সক্রিয় অংশগ্রহণই তাকে জিতিয়ে দিয়েছে। তিনি মূলত কুইন্স, ব্রুকলিন আর ম্যানহাটনের কিছু অংশে শ্রমজীবী মানুষের মধ্যে কাজ করেছেন।
কুমোসহ ডেমোক্র্যাটদের অনেকে বলেছিলেন, মামদানি মেয়র হওয়ার মতো যোগ্য নন, কারণ তার প্রশাসনিক অভিজ্ঞতা কম। তবে মঙ্গলবার দেখা গেল, এসব অভিযোগ ভোটারদের কাছে তেমন কাজ করেনি।
