জাহাজ চলাচলে বাধা, প্রক্সিদের হামলা- ইরান যেভাবে পাল্টা আঘাত হানতে পারে

ইসরায়েলের বোমা হামলায় ডোনাল্ড ট্রাম্পের অংশগ্রহণ ঠেকাতে ভয়াবহ প্রতিশোধের হুমকি দিয়েছিল ইরান। ইরানি কর্মকর্তারা স্পষ্টভাবে জানিয়েছেন যে মার্কিন যুদ্ধজাহাজ ও সামরিক ঘাঁটিগুলো হবে তাদের প্রতিশোধের লক্ষ্যবস্তু।
তবে বাস্তবতা হলো এখন তাদের প্রতিক্রিয়ার পথ সীমিত এবং প্রতিটি বিকল্পই উচ্চমাত্রার ঝুঁকিপূর্ণ।
গত কয়েকদিনে ইসরায়েলের ধারাবাহিক বিমান হামলায় ইরানের সামরিক সক্ষমতা বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কেননা ইরানে ইসরায়েলের হামলার মূল লক্ষ্য ছিল দেশটির দূরপাল্লার ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপক কেন্দ্রগুলো। তবে ইরানের কাছে এখনও বিপুল সংখ্যক স্বল্পপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন মজুত রয়েছে।
গত কয়েক সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্র উপসাগরীয় অঞ্চলে নিজের অবস্থান আরও শক্তপোক্ত করেছে। তারা মার্কিন সংযুক্ত উপসাগরীয় অঞ্চলগুলোয় নৌবাহিনী ও আকাশ প্রতিরক্ষা জোরদার করেছে।
ট্রাম্প হুঁশিয়ারি দিয়েছেন, ইরান পাল্টা আক্রমণ করলে যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি যুদ্ধে অংশ নেবে। এমনকি সম্প্রতি তিনি ইঙ্গিত দিয়েছেন, ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামিনিও মার্কিন বোমারু বিমানের লক্ষ্যবস্তু হতে পারেন।
ইরানের আরেকটি দীর্ঘমেয়াদি প্রতিরক্ষা কৌশল হলো 'প্রতিরোধের অক্ষ' নামে পরিচিত একটি আঞ্চলিক জোট, যা বিভিন্ন সশস্ত্র মিলিশিয়াকে নিয়ে গঠিত। তবে সেটিও বর্তমানে দুর্বল।
গত বছর ইসরায়েলি বিমান বাহিনী হিজবুল্লাহর বিশাল ক্ষেপণাস্ত্র ভাণ্ডার ধ্বংস করে। এবার এপ্রিল মাসে দক্ষিণ বৈরুতে একটি সন্দেহভাজন ক্ষেপণাস্ত্র গুদামে ফের বিমান হামলা চালানো হয়েছে, যাতে লেবাননের শিয়া সংগঠনটির শক্তি আরও সীমিত হয়েছে।
ইরাকের তেহরান-সমর্থিত শিয়া মিলিশিয়া কাতায়েব হিজবুল্লাহ হুমকি দিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র যদি ইসরায়েলের পক্ষে অবস্থান নেয়, তবে তারা মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন 'স্বার্থে' আঘাত হানবে। সংগঠনটির এক কমান্ডার আবু আলি আল-আসকারি সিএনএন-এ বলেছেন, মধ্যপ্রাচ্যের মার্কিন ঘাঁটিগুলো এখন থেকে 'হাঁস শিকারের মাঠে' পরিণত হবে। যুক্তরাষ্ট্রের ওই অঞ্চলে অন্তত ১৯টি সামরিক স্থাপনা রয়েছে, যার মধ্যে ৮টি স্থায়ী।
তেহরানের আরও এক মিত্র ইয়েমেনের হুথি বিদ্রোহীরা। তারা গত মে মাসে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে একটি অস্ত্রবিরতি চুক্তিতে সম্মত হয়।
তবে তারা সতর্ক করেছে, ট্রাম্প যদি ইরানের ওপর হামলায় অংশ নেন, তবে তারা এই অস্ত্রবিরতি চুক্তি ভঙ্গ বলে গণ্য করবে এবং লোহিত সাগরে মার্কিন জাহাজগুলোকে লক্ষ্য করে হামলা করবে।
এই ধরনের যেকোনো মিলিশিয়ার যুদ্ধে প্রবেশ যুক্তরাষ্ট্রের এক ভয়াবহ প্রতিক্রিয়া ডেকে আনবে, যার জন্য ওয়াশিংটন গত কয়েক মাস ধরে প্রস্তুতি নিচ্ছে।
এছাড়া, ইরানের আরেকটি বিকল্প হলো সমুদ্রপথে আক্রমণ। যেমন- মাইন পোঁতা, জাহাজ ডুবিয়ে দেওয়া বা হরমুজ প্রণালী বন্ধের হুমকি দেওয়া। পারস্য উপসাগরের প্রবেশদ্বার এই প্রণালীর কিছু অংশ মাত্র ৫৫ কিলোমিটার প্রশস্ত এবং এই পথ দিয়ে প্রতিদিন প্রায় ২০ মিলিয়ন ব্যারেল তেল ও প্রচুর পরিমাণ তরল গ্যাস সরবরাহ হয়; যা বিশ্বের মোট জ্বালানি সরবরাহের এক-পঞ্চমাংশ।
গত কয়েকদিন ধরে ইরানের কট্টরপন্থী রাজনীতিবিদরা হরমুজ প্রণালী বন্ধের দাবি জানিয়ে আসছেন। এটি সরাসরি ট্রাম্প প্রশাসনের ওপর চাপ সৃষ্টির একটি কৌশল হিসেবে দেখা হচ্ছে, কারণ এতে বিশ্ববাজারে তেলের দাম হঠাৎ বেড়ে গিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে মূল্যস্ফীতি তৈরি করতে পারে—যা আগামী কংগ্রেস নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক চাপ তৈরি করবে।
তবে এটি একইসঙ্গে ইরানের জন্যও ভয়াবহ আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত হবে। কারণ ইরানের নিজস্ব তেল রপ্তানিও এই প্রণালী দিয়েই হয়। এছাড়া, হরমুজ বন্ধ হয়ে গেলে উপসাগরীয় আরব দেশগুলোর স্বার্থ ক্ষতিগ্রস্ত হবে, যারা এখন ইরানে ইসরায়েলের হামলার সমালোচনায় সোচ্চার' তারাও নিজেদের স্বার্থ রক্ষার্থে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে পারে।
এই কারণগুলো বিবেচনায় এনে ইরান হয়তো এখনই পাল্টা হামলা না করে ভবিষ্যতে সময় নিয়ে বড় প্রতিশোধ নিতে পারে। অতীতেও দেখা গেছে, ইরান অনেক সময় বহিরাগত আক্রমণের জবাব দিতে বিলম্ব করেছে।
রবিবার ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সৈয়দ আব্বাস আরাঘচি এমন প্রতিক্রিয়ার ইঙ্গিত দিয়ে বলেছেন, 'ট্রাম্পের সিদ্ধান্তের চিরস্থায়ী পরিণতি থাকবে।'