যুক্তরাষ্ট্রের এক ফোনকলেই যুদ্ধ থামতে পারে: ইরানের রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তা

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প চাইলেই একটি ফোনকলের মাধ্যমে ইসরায়েলকে হামলা বন্ধে নির্দেশ দিতে পারেন, আর তাতেই ইরানের সঙ্গে কূটনৈতিক আলোচনা 'সহজেই' আবার শুরু হতে পারে—এমনটাই জানিয়েছেন ইরানি প্রেসিডেন্টের কার্যালয়ের এক কর্মকর্তা।
শুক্রবার সিএনএন-কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ইরানি রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তা মাজিদ ফারাহানি বলেন, 'ইরান বেসামরিক সংলাপের মাধ্যমে সমাধানে বিশ্বাসী। সেটা সরাসরি হোক বা পরোক্ষ—তা বড় কথা নয়।'
তিনি বলেন, 'প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প চাইলে কেবল একটি ফোনকলেই এই যুদ্ধ থামাতে পারেন।' তবে ইসরায়েলের চলমান হামলা অব্যাহত থাকলে কোনো আলোচনাই সম্ভব নয় বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে ফারাহানি জানান, ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ পুরোপুরি বন্ধের প্রস্তাব ইরান মেনে নেবে না। কিছুটা ছাড় দেওয়া যেতে পারে, পরিমাণও কমানো সম্ভব—কিন্তু পুরোপুরি থামানো নয়।
তবে ইরানের এমন অবস্থানের বিপরীতে পশ্চিমা দেশগুলো—বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল—চায় 'শূন্য সমৃদ্ধকরণ' নীতি। যদিও ইরানের দাবি, ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ তাদের শান্তিপূর্ণ কর্মসূচির অংশ।
এদিকে ইরানের ওপর সরাসরি হামলার আগে দুই সপ্তাহের একটি 'আলোচনার সুযোগ' রেখেছেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। যদিও এর বাস্তবতা প্রশ্নবিদ্ধ, তবু এটিকে একটি ক্ষীণ সম্ভাবনা হিসেবে দেখছেন পর্যবেক্ষকেরা।
এই প্রেক্ষাপটে গেল শুক্রবার জেনেভায় ইরান, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, জার্মানি ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের মধ্যে একটি মুখোমুখি বৈঠক হয়েছে। সংঘাত শুরু হওয়ার পর সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর এটাই প্রথম আনুষ্ঠানিক সাক্ষাৎ।
যদিও আলোচনায় কোনো অগ্রগতি হয়নি। ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ইসরায়েল হামলা বন্ধ না করলে পারস্পরিক সমঝোতার সম্ভাবনা নেই।
এদিকে, ট্রাম্প প্রশাসনের একের পর এক কড়া বার্তার পর এখন সামরিক পদক্ষেপ এড়ানোর একটি সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। যদিও ট্রাম্প প্রশাসনের ভেতরেই ইরান ইস্যুতে দ্বিধাবিভক্তি স্পষ্ট।
ফারাহানি হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, 'যদি যুক্তরাষ্ট্র এই যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে, আমাদের সামনে অনেক বিকল্প থাকবে—এবং এর সবকটাই আমাদের বিবেচনাধীন।'

গত শুক্রবার তেহরানের রাস্তায় সরকারপন্থি বিক্ষোভকারীরা ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ব্যাপক ক্ষোভ প্রকাশ করেন। সিএনএন-এর প্রতিবেদনে বলা হয়, রাস্তায় নেমে আসা বিপুল সংখ্যক মানুষ ইরানি, ফিলিস্তিনি ও হিজবুল্লাহর পতাকা হাতে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের পতাকা পুড়িয়ে প্রতিবাদ জানায়।
স্লোগান ওঠে—'আমেরিকার মৃত্যু হোক, ইসরায়েলের মৃত্যু হোক'। এক নারী সিএনএন-কে বলেন, 'ট্রাম্প, আপনি আমার নেতাকে হুমকি দিচ্ছেন? আপনি কি জানেন না, এই জাতি মনে করে, মৃত্যুই মধুরতর?'
জাতিসংঘে তীব্র বাকবিতণ্ডা, যুদ্ধ বন্ধে কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারেনি নিরাপত্তা পরিষদ
এদিকে গেল শুক্রবার জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের উত্তপ্ত বৈঠকে ইসরায়েল ও ইরান সংঘাতের পেছনে একে অপরকে দায়ী করে। গভীর বিভাজনের মধ্য দিয়ে পরিষদ কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারেনি।
ইসরায়েলের দাবি, ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি ইসরায়েলের জন্য হুমকি, তাই হামলা করছে। ইরানও অন্যদিকে ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন দিয়ে পাল্টা আঘাত করছে।
ইরানের রাষ্ট্রদূত আমির সাইয়েদ ইরবানি ইসরায়েলকে 'নির্দোষ মানুষ হত্যা ও সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘনকারী' দেশ বলে আখ্যায়িত করেন এবং 'সন্ত্রাসী শাসকগোষ্ঠীর' আগ্রাসনের নিন্দা জানান।
অন্যদিকে, ইসরায়েলের রাষ্ট্রদূত ড্যানি ড্যানন ইরানকে 'ভুক্তভোগী ভান করার' অভিযোগে অভিযুক্ত করে বলেন, 'আপনি কী করে আপনার গণহত্যার এজেন্ডার জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহানুভূতি আশা করেন?'

নিরাপত্তা পরিষদের সদস্যরা যুদ্ধ শেষ করে কূটনৈতিক সমাধানের ওপর একমত হলেও পুরো সময়টটুকুই দোষারোপ আর ঝগড়ায় কাটিয়েছেন।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি ডরোথি শিয়া ইরানকে মধ্যপ্রাচ্যের 'অস্থিতিশীলতা ও সন্ত্রাসের মূল উৎস' বলে উল্লেখ করে ইসরায়েলের পাশে থাকার ঘোষণা দিয়েছেন। অন্যদিকে, ব্রিটেন ও ফ্রান্স উত্তেজনা কমানো ও আলোচনার ওপর জোর দিয়েছে।
রাশিয়ার রাষ্ট্রদূত ভাসিলি নেবেঞ্জিয়া পশ্চিমা দেশগুলোর ওপর ইরানের পারমাণবিক অস্ত্র পরিকল্পনার 'মিথ্যা রচনা' ছড়ানোর অভিযোগ এনে তাদের 'ইসরায়েলি হামলার সহযোগী' এবং 'বিপজ্জনক' আখ্যা দেন।
গত ১২ জুন আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থা (আইএইএএ) ঘোষণা করে যে ইরান পারমাণবিক অস্ত্র বিস্তার রোধ চুক্তির লঙ্ঘন করেছে। সংস্থার প্রতিবেদন অনুসারে, ইরান ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ দ্রুত বাড়িয়েছে—যা পারমাণবিক বোমা তৈরির জন্য ব্যবহৃত হতে পারে।
যদিও প্রতিবেদনটি সরাসরি উল্লেখ করেনি যে ইরান পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করছে, তবু অন্যান্য উচ্চমাত্রার ইউরেনিয়াম ধারণকারী দেশগুলো পারমাণবিক অস্ত্রধারী।
রাশিয়ার রাষ্ট্রদূত ভাসিলি নেবেঞ্জিয়া আইএইএএ প্রতিবেদনটিকে পক্ষপাতমূলক ও ভিত্তিহীন বলে অভিযোগ করেছেন। অন্যদিকে চীনের প্রতিনিধি ফু কং যুদ্ধবিরতি দাবি করে ইসরায়েলের হামলার নিন্দা জানিয়েছেন, তবে আইএইএএ বা যুক্তরাষ্ট্রকে সমালোচনা থেকে বিরত রয়েছেন।
যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো মনে করছে, ইরান এখনও পারমাণবিক বোমা তৈরিতে অগ্রসর হচ্ছে না। তবে এক বছরের মধ্যে সক্ষমতা অর্জন করতে পারে। এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে গত শুক্রবার প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প মন্তব্য করেন, 'তাহলে আমার গোয়েন্দা সংস্থা হয়ত ভুল বলেছে।'
ইরানের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, বৃহস্পতিবার পর্যন্ত ইসরায়েলের হামলায় অন্তত ২২৪ জন নিহত এবং ২৫০০'র বেশি আহত হয়েছেন। ইসরায়েলি রাষ্ট্রদূত ড্যানি ড্যাননের ভাষ্য অনুযায়ী, ইরানের হামলায় ইসরায়েলে অন্তত ২৯ জন নিহত ও প্রায় ৯০০ জন আহত হয়েছেন। দুই দেশের অধিকাংশ হতাহতই বেসামরিক।