ইসরায়েল–ইরান যুদ্ধ যেভাবে বদলে দিচ্ছে বৈশ্বিক তেলবাণিজ্যের মানচিত্র

ইসরায়েল-ইরান যুদ্ধের আকস্মিক উত্তেজনা বৃদ্ধি বিশ্বব্যাপী তেলের বাজারে অনিশ্চয়তা সৃষ্টি করেছে, কারণ এটি বিশ্বের দুটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জাহাজ চলাচলের পথকে অস্থিতিশীল করে তুলেছে। হরমুজ প্রণালীর চারপাশে ইরানের সামরিক প্রস্তুতির বার্তা এবং কৌশলগত শক্তি প্রদর্শন ইতোমধ্যেই বৈশ্বিক বাণিজ্য প্রবাহে প্রভাব ফেলেছে।
সম্প্রতি উপসাগরীয় অঞ্চলে ইলেকট্রনিক জ্যামিংয়ের ঘটনা বেড়েছে, যার ফলে পণ্যবাহী জাহাজের ট্র্যাকিং সিস্টেম অকার্যকর হয়ে পড়েছে।
গত ১৭ জুন হরমুজের কাছে দুটি তেলবাহী ট্যাঙ্কারের মধ্যে সংঘর্ষ হয়, এতে আগুন ধরে যায় এবং একটি ক্রু দলকে উদ্ধার করা হয়।
তেল ছড়িয়ে না পড়লেও, এই ঘটনাগুলোর ফলে বোঝা যায় দৈনিক ১৮–২০ মিলিয়ন ব্যারেল তেল পরিবাহিত হওয়া এই জলপথে সামান্য ভুলও বড় ধরনের সংকট সৃষ্টি করতে পারে।
ইরানের উদ্দেশ্য প্রতিরোধমূলক হলেও আঞ্চলিক উত্তেজনা বাড়ছে। অতীতে দেখা গেছে, হরমুজ প্রণালী বন্ধ হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিলেই বৈশ্বিক তেলের দাম আকাশচুম্বী হয়ে ওঠে।
ইসরায়েল ও ইরানের মধ্যে চলমান বিমান হামলা পাল্টাহামলার মধ্যে জাহাজ চলাচল এখনও অনিশ্চিত। বন্দর আব্বাস বন্দরের কাছে নৌচালনায় ব্যাঘাত ঘটার অভিযোগও উঠেছে।
গ্রিসের কর্তৃপক্ষ, যাদের শিপিং কোম্পানিগুলো বিশাল সংখ্যক ট্যাঙ্কার পরিচালনা করে, হরমুজ প্রণালীর প্রতিটি যাত্রা নথিভুক্ত করার নির্দেশ দিয়েছে, যা বর্তমান উত্তেজনার মাত্রা নির্দেশ করে।
একটি ভুল পদক্ষেপ—হোক সেটা একটি বিপথগামী ক্ষেপণাস্ত্র বা হুথিদের পাল্টা হামলা—এই গুরুত্বপূর্ণ জলপথ সাময়িকভাবে বন্ধ করে দিতে পারে। এর ফলে তেলের দাম ও সরবরাহে তাৎক্ষণিক প্রভাব পড়বে।
সম্পূর্ণ অবরোধ ছাড়াও অর্থনৈতিক প্রভাব ইতোমধ্যে দেখা দিচ্ছে। উপসাগরমুখী ট্যাঙ্কারগুলোর জন্য যুদ্ধ-ঝুঁকি বীমা প্রিমিয়াম বেড়ে গেছে। জুনের মাঝামাঝি আরব উপসাগর থেকে এশিয়াগামী বৃহৎ তেলবাহী জাহাজের (ভিএলসিসি) ভাড়া এক লাফে ২০ শতাংশের বেশি বেড়েছে এবং উত্তেজনা আরও বাড়লে এ হার আরও বাড়তে পারে।
বিশ্লেষকরা সতর্ক করে দিয়েছেন, যদি ইরান হরমুজ সংলগ্ন অবকাঠামোতে আঘাত হানে বা নৌপথে সংঘর্ষ বাড়ে, তাহলে বীমা প্রিমিয়াম আরও বেড়ে যেতে পারে।
লন্ডনের এক ব্রোকারের হিসাবে, ঝুঁকি বিবেচনায় প্রতি ব্যারেল তেলের দামে অতিরিক্ত ৩–৮ ডলার যোগ হতে পারে। এই খরচ শেষমেশ ভোক্তা এবং আমদানি-নির্ভর দেশগুলোর ওপরই এসে পড়ে, এসব দেশ ইতোমধ্যেই মুদ্রাস্ফীতির সঙ্গে লড়ছে।
রেড সি সংকট
এছাড়া রেড সি এবং সুয়েজ খাল অঞ্চলেও অস্থিরতা বিরাজ করছে। ২০২৩ সালের শেষ দিক থেকে ইয়েমেনভিত্তিক হুথি বিদ্রোহীরা বাব আল-মান্দেব প্রণালীতে বাণিজ্যিক জাহাজে হামলা চালাচ্ছে, যা পূর্ব-পশ্চিম নৌচলাচলে বাধা সৃষ্টি করছে।
বেশিরভাগ কনটেইনার জাহাজ ও কিছু তেলবাহী জাহাজ এখন সুয়েজ রুট এড়িয়ে দক্ষিণ আফ্রিকার কেপ অফ গুড হোপ হয়ে যাত্রা করছে। এতে ভ্রমণের সময় ১০–১৪ দিন বাড়ছে, আফ্রিকান বন্দরগুলোতে ভিড় বাড়ছে এবং সরবরাহ শৃঙ্খল আরও চাপে পড়ছে।
সুয়েজ খাল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, এক বছরের ব্যবধানে তাদের আয় ২৪০ কোটি ডলার থেকে নেমে ৮৮ কোটি ডলারে নেমে এসেছে। মিশর বর্তমানে জাহাজগুলোকে ফেরানোর জন্য সর্বোচ্চ ১৫ শতাংশ ছাড় দিচ্ছে, তবু অনেক শিপিং কোম্পানি ঝুঁকি বিবেচনায় এখনও সতর্ক অবস্থানে রয়েছে।
বীমা খাতেও এই সতর্কতা প্রতিফলিত হচ্ছে। রেড সি দিয়ে চলাচলকারী জাহাজের জন্য যুদ্ধ-ঝুঁকি বীমা প্রিমিয়াম এখনও বেশি।
১৭ জুনের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ইসরায়েলগামী জাহাজের জন্য বীমা প্রিমিয়াম জাহাজের মূল্যের ০.৭% থেকে ১.০% পর্যন্ত হয়ে থাকে। ১০০ মিলিয়ন ডলারের একটি ট্যাঙ্কারের জন্য এক সপ্তাহের যাত্রায় যুদ্ধ-ঝুঁকি বীমা খরচ প্রায় ১০ লাখ ডলার পর্যন্ত হতে পারে। এই ব্যয়বহুল পরিবহন খরচ বৈশ্বিক অর্থনীতিতে সমষ্টিগত প্রভাব ফেলছে।
জ্বালানি নিরাপত্তার নতুন বাস্তবতা
ইসরায়েল-ইরান যুদ্ধ বৈশ্বিক জ্বালানি নিরাপত্তার বিদ্যমান দুর্বলতাগুলোকে প্রকাশ্যে তুলে ধরেছে। এটা এখন স্পষ্ট যে বিশ্বের জ্বালানি রুটগুলো আগের চেয়ে অনেক বেশি ভঙ্গুর।
সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং ইরাকসহ উপসাগরীয় দেশগুলো বাজারে আস্থা ফিরিয়ে আনতে কূটনৈতিক ও কারিগরি প্রচেষ্টা চালাচ্ছে।
রিয়াদ অতিরিক্ত তেল সরবরাহের প্রস্তাব দিয়েছে, আর তেহরান এখনও পর্যন্ত রপ্তানি বন্ধ না করলেও উত্তেজনার মাত্রা বাড়াচ্ছে।
নীতিনির্ধারক ও জ্বালানি বিশ্লেষকদের মতামত হচ্ছে, আধুনিক জ্বালানি নিরাপত্তা শুধু ঘরোয়া মজুদ বা মূল্য নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। বৈশ্বিক সহযোগিতা এখন জরুরি। নৌ-নিরাপত্তায় আঞ্চলিক সমন্বিত অভিযান, তাৎক্ষণিক তথ্য বিনিময় এবং সংঘাত এড়ানোর ব্যবস্থা করা উচিত।
পাশাপাশি, সমুদ্রের নিচ দিয়ে পাইপলাইন, স্থলভিত্তিক করিডর এবং ঝুঁকিমুক্ত অঞ্চলে নতুন বন্দর স্থাপনসহ দীর্ঘমেয়াদি অবকাঠামো বিনিয়োগকেও গুরুত্ব দিতে হবে।
কূটনীতিও এই সংকটে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। আন্তর্জাতিক জলপথ নিরাপদ রাখতে আস্থা গড়ে তোলা, সংকটকালে যোগাযোগের পথ খোলা রাখা এবং সংঘর্ষ এড়ানোর প্রতিশ্রুতি এখন সময়ের দাবি।
এই যুদ্ধ স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে—জ্বালানি রুটগুলোই বৈশ্বিক অর্থনীতির লাইফলাইন। এই পথগুলোর ওপর হুমকি অব্যাহত থাকলে কেবল দাম নয়, বরং বিশ্বব্যাপী জ্বালানি ব্যবস্থার অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি হতে পারে।
বর্তমান প্রেক্ষাপটে, নৌ-চলাচলের স্বাধীনতা কেবল মতাদর্শের বিষয় নয়—এটি এখন বৈশ্বিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য বাস্তব প্রয়োজন।