ইরানে ড্রোন অভিযান নিয়ে দাবি মোসাদের ‘দুধর্ষ’ ভাবমূর্তিকেই সমর্থন করছে
শুক্রবার দিনভর ইসরায়েলের জনগণ তাদের বহুল আলোচিত গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের নতুন এক 'সাফল্য' উদযাপন করেছে—যেটিকে অনেক ইসরায়েলি বলছেন, সংস্থাটির ইতিহাসে একটি সাহসী পালক।
ইরানের উপর একযোগে ২০০ যুদ্ধবিমান দিয়ে অভিযান চালানোর কয়েক ঘণ্টা পর, ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ এমন একটি ভিডিও প্রকাশ করে যেখানে দেখা যায়, মোসাদের এজেন্টরা ইরানের ভেতরে অবস্থান নিয়ে ক্ষেপণাস্ত্র ও বিস্ফোরক ড্রোন প্রস্তুত করছে—যার লক্ষ্য ছিল তেহরানের কাছাকাছি কিছু স্থান।
ইসরায়েলি গণমাধ্যমকে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক নিরাপত্তা কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, একই ধরনের অস্ত্র ট্রাকে করে ইরানে প্রবেশ করানো হয়েছিল এবং তেহরানের কাছে কোনো এক অজ্ঞাত স্থানে "ড্রোন ঘাঁটি" স্থাপন করা হয়েছিল, যেখান থেকে এই ড্রোনগুলো ব্যবহৃত হয়েছে ইরানের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ধ্বংসে। কর্মকর্তারা বলেন, শুক্রবারের হামলার অনেক আগেই এই প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়।
'ইনস্টিটিউট ফর ইন্টেলিজেন্স অ্যান্ড স্পেশাল অপারেশনস' বা হিব্রুতে মোসাদ নামে পরিচিত এই গুপ্তচর সংস্থাটি প্রায় ৮০ বছরের বেশি সময় ধরে গোপন কর্মকাণ্ড চালিয়ে এসেছে। তাদের খ্যাতি বা কুখ্যাতি যাই বলুন—তৈরি হয়েছে দুঃসাহসী গোয়েন্দা তৎপরতা, প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন এবং প্রয়োজনে নির্মম সহিংসতার কৌশলের কারণে।
মাত্র ১০ মাস আগেই মোসাদ লেবাননে হিজবুল্লাহর হাজার হাজার পেজার ও ওয়াকি-টকির বিস্ফোরণ ঘটায়, যার ফলে সংগঠনটি বড় রকমের ক্ষতির মুখে পড়ে—৩৭ জন নিহত হয় এবং আহত হয় প্রায় ৩ হাজার। পরে তারা হিজবুল্লাহর শীর্ষ নেতৃত্বকে টার্গেট করে সফল বিমান হামলাও চালায়। এতে নিহত হন হাসান নাসরাল্লাহ-সহ হিজবুল্লাহর শীর্ষ কম্যান্ডাররা।
দীর্ঘ সময় ধরে মোসাদ ইরানে-ও একটি শক্তিশালী গুপ্তচর নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছে, যেখানে এজেন্ট, তথ্যদাতা ও লজিস্টিক সাপোর্ট–সবই আছে। এই নেটওয়ার্কের মাধ্যমেই ইরানে একাধিক আলোচিত অভিযান পরিচালিত হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে—রিমোট কন্ট্রোল মেশিনগান দিয়ে গাড়িতে থাকা একজন শীর্ষ পরমাণু বিজ্ঞানীকে হত্যা, ইরানের পরমাণু কর্মসূচির কম্পিউটার সিস্টেমে ম্যালওয়্যার সংক্রমণ এবং পরমাণু নথি সংরক্ষিত একটি গোডাউন থেকে গুরুত্বপূর্ণ দলিল চুরি।
গত বছর তেহরানে একটি সরকারি গেস্ট হাউসের কক্ষে স্থাপন করা বোমার মাধ্যমে হামাসের রাজনৈতিক প্রধান ইসমাইল হানিয়াকে হত্যার ঘটনাও মোসাদের পরিকল্পনায় হয়েছে।
ইসরায়েলি নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও সাংবাদিক ইয়োসি মেলম্যান বলেন, "এই সর্বশেষ অভিযান নিঃসন্দেহে চমকপ্রদ, তবে বাস্তবতা হচ্ছে, গত এক দশকেরও বেশি সময় ধরে ইরান ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থার কাছে যেন খোলা বই।"
তিনি আরও বলেন, ভিডিওতে যাদের ক্ষেপণাস্ত্র প্রস্তুত করতে দেখা গেছে, তারা সম্ভবত ইরানি নাগরিক। "মাঠপর্যায়ে যারা কাজ করছেন, তারা ইসরায়েলি নন। তাদের নিয়োগ, প্রশিক্ষণ, অস্ত্র সরবরাহ—সবকিছুই অত্যন্ত দক্ষতা ও পেশাদারিত্বের দাবি রাখে।"
অস্বাভাবিকভাবে, ইসরায়েল এবার তার সেনাবাহিনীর গোয়েন্দা শাখা 'আমান'-এর ভূমিকা প্রকাশ্যে তুলে ধরেছে। এই সংস্থা হামলার লক্ষ্য নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য জোগাড় করেছে।
যদিও মোসাদ ও আমান প্রায়শই একসঙ্গে কাজ করে, কিন্তু আন্তর্জাতিক পরিসরে মোসাদই সাধারণত বেশি মনোযোগ পায়—এবং অধিকাংশ সময়ই সংস্থাটির কর্মকাণ্ড গোপন থাকে।
১৯৪৯ সালে প্রতিষ্ঠার পর দীর্ঘদিন মোসাদ এতটাই গোপন ছিল যে, সংস্থার সাবেক সদস্যদের এমনকি পরিবারকেও বলা নিষেধ ছিল তাদের কর্মস্থল সম্পর্কে। কোনো অভিযানে অংশ নেওয়ার বিষয়েও প্রকাশ্যে কিছু বলা হতো না।
১৯৭০-এর দশকে মোসাদের বিখ্যাত/ কুখ্যাত কিছু অভিযানে অংশ নেওয়া ইয়োসি আলফার বলেন, "তখন মোসাদ সম্পর্কে কেউ কিছু জানত না। আমরা যেভাবে গোপনে কাজ করতাম, এখন তা কল্পনাও করা কঠিন। এখন তো সংস্থাটির নিজস্ব ওয়েবসাইটও রয়েছে।"
আগের মতো মাঠপর্যায়ে গুপ্তচর নিয়োগ বা সরাসরি অভিযান পরিচালনার বদলে—বর্তমানে মোসাদের সিনিয়র কর্মকর্তারা বেশি সময় কাটান কূটনৈতিক মিশন, সরকারকে গোয়েন্দা ব্রিফিং এবং বিদেশি সংস্থার সঙ্গে সম্পর্ক তৈরিতে।
গত কয়েক দশকজুড়ে সংস্থাটি গোপনে বহু "শত্রুর শত্রুদের" সহায়তা দিয়েছে—যেমন: ইরান, ইরাক ও সিরিয়ার কুর্দি গোষ্ঠী এবং দক্ষিণ সুদানের সশস্ত্র খ্রিস্টান বিদ্রোহীদের। তবে সব প্রচেষ্টা সমানভাবে সফল হয়নি।
১৯৮২ সালে ইসরায়েলের লেবানন অভিযান ও মোসাদের সমর্থনে মারোনাইট খ্রিস্টান মিলিশিয়াদের পাশবিক হত্যা, ধর্ষণের অভিযোগসহ মোসাদকে ঘিরে রয়েছে প্রচুর সমালোচনা। ফিলিস্তিনি স্বাধীনতা সংগ্রামী ও তাদের আত্মীয়-পরিজনদের বিরুদ্ধে দেশে-বিদেশে নির্যাতন, হত্যায় রক্তের বন্যা বইয়েছে মোসাদ। আবার অনেকক্ষেত্রেই যেখানে সাধারণ মানুষের প্রাণহানি এড়ানো যেত, সেখানে যথাযথ পূর্বাভাস না দিয়ে মোসাদ দায়িত্বহীন ভূমিকা পালন করেছে।
মোসাদ ইরান-কনট্রা কেলেঙ্কারির সময় আয়াতুল্লাহ খোমেনির শাসিত ইরানকে গোপনে অস্ত্র সরবরাহে সহায়তা করে—যা ছিল যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যানের সময়কার একটি বিতর্কিত অধ্যায়।
মোসাদের কিংবদন্তিতুল্য সুনাম গড়ে তোলার জন্য অনেকটাই দায়ী পশ্চিমা চলচ্চিত্র ও টেলিভিশনের মাধ্যম। তাদের বিখ্যাত অভিযানের কাহিনি বারবার ফিরে এসেছে পর্দায়।
তাদের অন্যতম বিখ্যাত অভিযান হলো—১৯৬০ সালে আর্জেন্টিনায় নাৎসি নেতা অ্যাডলফ আইখম্যানকে অপহরণ করে ইসরায়েলে নিয়ে আসা। ১৯৬৯ সালে ফরাসি নৌবাহিনী থেকে যুদ্ধজাহাজ চুরি, ১৯৭৩ সালে মিশর ও সিরিয়ার হামলার পূর্বাভাস দেওয়া, এবং ১৯৭৬ সালে উগান্ডার এনতেব্বে বিমানবন্দরে জিম্মিদের উদ্ধার অভিযানে গোয়েন্দা সহায়তা—এসবই ইতিহাসে স্মরণীয়।
১৯৮০ সালে তারা সুদানের লোহিত সাগরের উপকূলে একটি ডাইভিং রিসোর্ট পরিচালনা করে—গোপনে ইথিওপিয়ার ইহুদি সম্প্রদায়ের হাজার হাজার সদস্যকে ইসরায়েলে আনার জন্য। পর্যটকদের ভেতরে মিশে থাকা গুপ্তচরেরা পাঁচ বছর পর এ অভিযান বন্ধ করতে বাধ্য হয়।
১৯৭২ সালে মিউনিখ অলিম্পিকে ফিলিস্তিনি জঙ্গিদের হামলায় ইসরায়েলি ক্রীড়াবিদ নিহত হওয়ার পর মোসাদ একটি "বিচারবহির্ভূত" হত্যা অভিযান চালায়, যার শেষাংশ ছিল ভুলবশত নরওয়েতে এক মরক্কোর ওয়েটারকে হত্যা। পরে দোষীদের ধরা পড়তে হয় এবং স্থানীয় আদালতে বিচার হয়।
এই সব ঘটনাই মোসাদের কর্মকাণ্ডকে নিয়ে তৈরি করেছে রহস্যময়, বিতর্কিত ও পশ্চিমাদের কাছে প্রশংসিত এবং মুক্তিকামী বাকি বিশ্বের কাছে নিন্দিত, ঘৃণিত— এক শক্তিশালী সংস্থার ছায়া শিকারির ইতিহাস, যা একইসঙ্গে আতঙ্কের।