ইরানের প্রধান পারমাণবিক স্থাপনাগুলো কোথায়, কী কাজে সেগুলো ব্যবহৃত হয়?

গত শুক্রবার ভোরে তেহরানে ইরানের গুরুত্বপূর্ণ পারমাণবিক ও সামরিক স্থাপনা লক্ষ্য করে ইসরায়েল বড় ধরনের সামরিক অভিযান চালায়।
ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বলেন, অভিযানের লক্ষ্য ছিল ইরানের পারমাণবিক অবকাঠামো, ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র কারখানা এবং সামরিক ক্ষমতা ধ্বংস করা।
ইরানি গণমাধ্যম ও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, বিস্ফোরণের শব্দ শোনা গেছে বিভিন্ন স্থানে। এর মধ্যে রয়েছে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণের প্রধান কেন্দ্র 'নাতানজ'।
এদিকে, আগামীকাল রোববার (১৫ জুন) ওমানের মাসকাটে যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের মধ্যে ষষ্ঠ দফায় পারমাণবিক আলোচনা হওয়ার কথা ছিল। তবে ইরান এই হামলার পৃষ্ঠপোষকতার জন্য যুক্তরাষ্ট্রকে দায়ী করার পর আলোচনার ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। তবুও ট্রাম্প এখনও ইরানের সঙ্গে একটি পরমাণু চুক্তিতে আগ্রহী।
ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলোকে ঘিরে পশ্চিমা বিশ্বে যেমন শঙ্কা তেমনি কৌতূহলও তুঙ্গে, তবে এসব স্থাপনাগুলো কোথায়, কীভাবে-কী কাজে সেগুলো ব্যবহৃত হয়, তা নিয়ে বিস্তারিত জানা যাক।
ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলো কোথায়?
ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলো দেশটির অনেক জায়গায় ছড়িয়ে আছে। ইসরায়েল বহু বছর ধরে এসব স্থাপনায় হামলার হুমকি দিলেও, নিরাপত্তার জন্য কেবল কিছু স্থাপনাই মাটির নিচে তৈরি করা হয়েছে।
ইরান কি পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করছে?
আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থা (আইএইএ) এবং যুক্তরাষ্ট্রের মতে, ইরান ২০০৩ সাল পর্যন্ত একটি গোপন ও সমন্বিত পারমাণবিক অস্ত্র কর্মসূচি চালু রেখেছিল, যা পরে বন্ধ করা হয়। তবে ইরান বরাবরই এই অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে। ইরানের দাবি, তাদের পারমাণবিক কর্মসূচি শুধুই শান্তিপূর্ণ উদ্দেশ্যে।
২০১৫ সালে আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের বিনিময়ে ইরান পারমাণবিক কার্যক্রম সীমিত রাখার চুক্তি করে। কিন্তু ২০১৮ সালে যুক্তরাষ্ট্র চুক্তি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পরপরই ইরান সেই শর্ত লঙ্ঘন করতে শুরু করে।
ইরান কি ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ বাড়াচ্ছে?
হ্যাঁ। ২০১৫ সালের পরমাণু চুক্তি ভাঙার পর থেকে ইরান দ্রুত তার ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কর্মসূচি সম্প্রসারণ করেছে। এর ফলে 'ব্রেকআউট টাইম' অর্থাৎ ওয়েপেন-গ্রেড ইউরেনিয়াম তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় সময় এক বছরের বদলে এখন কয়েক দিন কিংবা এক সপ্তাহের মতো কমে এসেছে।
তবে শুধু ইউরেনিয়াম থাকার মাধ্যমে পারমাণবিক বোমা তৈরি সম্ভব নয়; এর জন্য আরও জটিল প্রযুক্তি ও প্রস্তুতির প্রয়োজন হয়। এই প্রস্তুতির জন্য সময় কত লাগবে, তা নিয়ে বিশেষজ্ঞদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে।
আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থা (আইএইএ) জানায়, ইরান বর্তমানে দুইটি কেন্দ্রে সর্বোচ্চ ৬০ শতাংশ মাত্রায় ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করছে, যা ওয়েপেন-গ্রেড (৯০ শতাংশ) এর কাছাকাছি। সংস্থাটির হিসাব অনুযায়ী, এই মাত্রার ইউরেনিয়াম আরও সমৃদ্ধ করলে ইরানের কাছে ছয়টি পারমাণবিক বোমা তৈরির মতো উপাদান থাকতে পারে।
নাতানজ: ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচির কেন্দ্রবিন্দু
ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু জানান, শুত্রবারের হামলায় ইরানের প্রধান ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কেন্দ্র 'নাতানজ'কে লক্ষ্য করা হয়।
তেহরানের দক্ষিণে, কুম শহরের কাছে পাহাড়ঘেরা সমতলে অবস্থিত এই স্থাপনাটি দুটি প্রধান ইউনিট নিয়ে গঠিত—ভূগর্ভস্থ ফুয়েল এনরিচমেন্ট প্ল্যান্ট (এফইপি) ও ভূপৃষ্ঠের পাইলট ফুয়েল এনরিচমেন্ট প্ল্যান্ট (পিএফইপি)।
২০০২ সালে নির্বাসিত এক ইরানি বিরোধীদল নাতানজের অস্তিত্ব ফাঁস করলে, পশ্চিমা বিশ্ব ও ইরানের মধ্যে পারমাণবিক উত্তেজনার সূচনা হয়, যা এখনও চলমান।
এফইপি বানানো হয় বাণিজ্যিক পর্যায়ে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করার জন্য, যেখানে ৫০ হাজার সেন্ট্রিফিউজ (ইউরেনিয়াম পরিশোধনযন্ত্র) বসানোর সক্ষমতা রয়েছে। বর্তমানে সেখানে প্রায় ১৬ হাজার সেন্ট্রিফিউজ বসানো রয়েছে, যার মধ্যে ১৩ হাজার সক্রিয়ভাবে ৫ শতাংশ মাত্রায় ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করছে।
এই স্থাপনাটি মাটির প্রায় তিন তলা নিচে অবস্থিত। ফলে ইসরায়েলি বিমান হামলায় এর কতটা ক্ষতি হতে পারে, তা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে।
এর আগে ২০২১ সালে সেখানে বিস্ফোরণ ও বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্নতার ঘটনা ঘটে, যা ইরান ইসরায়েলের হামলা বলে দাবি করে।
অন্যদিকে, নাতানজের পিএফইপি তুলনামূলক ছোট এবং সেখানে মাত্র কয়েকশ সেন্ট্রিফিউজ রয়েছে, কিন্তু সেগুলোর মাধ্যমেই ইরান ৬০ শতাংশ মাত্রায় ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করছে।

ফরদো
কুম শহরের উল্টো দিকে একটি পাহাড়ে নির্মিত ফরদো কেন্দ্রটি ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণের একটি গোপন ও সুরক্ষিত স্থাপনা। এটি ভূমির নিচে থাকায় ইসরায়েলি হামলার মতো বাহ্যিক আঘাত থেকে তুলনামূলকভাবে সুরক্ষিত বলে মনে করা হয়।
২০১৫ সালের চুক্তি অনুযায়ী ফরদোতে সমৃদ্ধকরণ নিষিদ্ধ ছিল। তবে এখন সেখানে প্রায় ২ হাজার সেন্ট্রিফিউজ চালু রয়েছে, যার বেশিরভাগই উন্নত আইআর-৬ মডেল। এদের মধ্যে প্রায় ৩৫০টি যন্ত্র ৬০ শতাংশ মাত্রায় ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করছে।
২০০৯ সালে যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন ও ফ্রান্স প্রকাশ করে, ইরান বহু বছর ধরে ফরদো গোপনে নির্মাণ করেছে এবং তা আইএইএ-কে জানায়নি। যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা তখন মন্তব্য করেন, এই কেন্দ্রের আকার ও কাঠামো শান্তিপূর্ণ কর্মসূচির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।
ইসফাহান
ইরানের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর ইসফাহানে অবস্থিত একটি বড় পরমাণু প্রযুক্তি কেন্দ্রে ইউরেনিয়াম প্রক্রিয়াজাত ও সংরক্ষণ করা হয়। এখানে রয়েছে ফুয়েল প্লেট ফ্যাব্রিকেশন প্ল্যান্ট (এফপিএফপি) ও ইউরেনিয়াম কনভার্সন ফ্যাসিলিটি (ইউসিএফ), যেখানে ইউরেনিয়ামকে গ্যাসে রূপান্তর করে সেন্ট্রিফিউজে ব্যবহারের উপযোগী করা হয়।
কূটনীতিকদের মতে, ইরান এখানে সমৃদ্ধ ইউরেনিয়ামও সংরক্ষণ করে। পাশাপাশি রয়েছে ইউরেনিয়াম ধাতু তৈরির যন্ত্রপাতি, যা পারমাণবিক বোমার কেন্দ্রীয় অংশ তৈরির জন্য ব্যবহারযোগ্য হওয়ায় উদ্বেগের বিষয়।
আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থা (আইএইএ) জানায়, ইসফাহানে সেন্ট্রিফিউজ যন্ত্রাংশ তৈরির নতুন সুবিধাও গড়ে তোলা হয়েছে, যেটিকে সংস্থাটি ২০২২ সালে 'নতুন স্থাপনা' হিসেবে চিহ্নিত করে।
খোন্দাব
ইরানের খোন্দাব এলাকায় (আগের নাম আরাক) একটি ভারী-পানির রিঅ্যাক্টর তৈরি করা হচ্ছিল, যা প্লুটোনিয়াম উৎপাদনে সক্ষম—এই উপাদান পারমাণবিক বোমার কেন্দ্রবিন্দুতে ব্যবহারযোগ্য।
২০১৫ সালের চুক্তি অনুযায়ী এর নির্মাণকাজ বন্ধ করা হয় এবং রিঅ্যাক্টরের মূল অংশ তুলে কংক্রিট দিয়ে ভরে ফেলা হয়। পরে পরিকল্পনা নেওয়া হয় রিঅ্যাক্টরটি এমনভাবে পুনর্গঠন করার, যাতে সাধারণ ব্যবহারে অস্ত্র-মানের প্লুটোনিয়াম তৈরি না হয়। ইরান জানিয়েছে, ২০২৬ সাল থেকে এটি চালু করার ইচ্ছা রয়েছে।
তেহরান গবেষণা কেন্দ্র
তেহরানে অবস্থিত পারমাণবিক গবেষণা কেন্দ্রে একটি ছোট গবেষণা রিঅ্যাক্টর রয়েছে। এটি প্রধানত বৈজ্ঞানিক গবেষণার কাজে ব্যবহৃত হয়।
বুশেহর
পারস্য উপসাগরের তীরে বুশেহরে অবস্থিত ইরানের একমাত্র সচল পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রটি চলে রাশিয়ার জ্বালানিতে। ব্যবহৃত জ্বালানি রাশিয়াই ফেরত নিয়ে যায়, ফলে এটি থেকে বিস্তার ঝুঁকি তুলনামূলকভাবে কম।