বাণিজ্যযুদ্ধের ধাক্কা: বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস কমাল বিশ্বব্যাংক

যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য নীতির অস্থিরতা ও শুল্ক বাড়ানোর কারণে ২০২৫ সালের বৈশ্বিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস ০.৪ শতাংশ কমিয়ে ২.৩ শতাংশে নামিয়েছে বিশ্বব্যাংক। আজ মঙ্গলবার (১০ জুন) প্রকাশিত বিশ্বব্যাংকের অর্ধবার্ষিক গ্লোবাল ইকোনমিক প্রোসপেক্টাস প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্র, চীন, ইউরোপসহ প্রায় ৭০ শতাংশ দেশ ও ছয়টি উদীয়মান অর্থনৈতিক অঞ্চলের প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস কমানো হয়েছে, যা গত ছয় মাস আগের হিসাব থেকে একেবারে ভিন্ন। বিশ্লেষকরা বলছেন, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নেতৃত্বে ওঠানামা করা শুল্কনীতিই এই দুরবস্থার অন্যতম কারণ।
বিশ্বব্যাংক বলছে, ট্রাম্পের সময়ে কার্যকর হওয়া একের পর এক শুল্ক বৃদ্ধির ফলে যুক্তরাষ্ট্রে গড় শুল্কহার শতবর্ষের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে, যা ৩ শতাংশ থেকে বেড়ে মধ্য-দশকের ঘরে পৌঁছেছে। যুক্তরাষ্ট্রের জবাব দিতে এরই মধ্যে চীনসহ বিভিন্ন দেশও মার্কিন পণ্য আমদানির ওপর পাল্টা শুল্ক আরোপ করেছে।
মন্দার পূর্বাভাস না দিলেও দুর্বল প্রবৃদ্ধির শঙ্কা
বিশ্বব্যাংক যদিও বৈশ্বিক মন্দার সরাসরি পূর্বাভাস দেয়নি, তবে তারা বলেছে ২০০৮ সালের পর এই প্রথম মন্দা ছাড়া কোনো বছরে এত দুর্বল প্রবৃদ্ধি দেখা যাবে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৭ সাল নাগাদ বৈশ্বিক মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) গড়ে বছরে ২.৫ শতাংশ হারে বাড়বে, যা ১৯৬০-এর দশকের পর ধীরগতির সর্বনিম্ন হার।
২০২৫ সালে বৈশ্বিক বাণিজ্য প্রবৃদ্ধি কমে হবে মাত্র ১.৮ শতাংশ, যেখানে ২০২৪ সালে এই হার ছিল ৩.৪ শতাংশ এবং ২০০০-এর দশকে গড় হার ছিল ৫.৯ শতাংশ। এই পূর্বাভাসে এপ্রিলের শুল্কবৃদ্ধির ঘোষণাগুলো ধরা হয়নি, যা ট্রাম্প জুলাই ৯ পর্যন্ত স্থগিত রেখেছেন।
বিশ্বব্যাংক জানিয়েছে, শুল্ক ও শ্রমবাজারের চাপে ২০২৫ সালে বৈশ্বিক মুদ্রাস্ফীতি ২.৯ শতাংশে পৌঁছাতে পারে, যা কোভিড-পূর্ববর্তী সময়ের চেয়ে অনেক বেশি।
বিনিয়োগে বড় বাধা নিরাপত্তাহীনতা
বিশ্বব্যাংকের উপ-প্রধান অর্থনীতিবিদ আইহান কস বলেন, "বাণিজ্য ঘিরে অনিশ্চয়তা যেন রানওয়েতে কুয়াশা। এটি বিনিয়োগকে মন্থর করে এবং (বিনিয়োগকারীদের) দৃষ্টিপথ ঝাপসা করে দেয়।"
তবে তিনি আশা প্রকাশ করেন, বর্তমান অনিশ্চয়তা ধীরে ধীরে কেটে যাবে এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও সরবরাহ শৃঙ্খলে নতুন অভিযোজন— বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের প্রবৃদ্ধি কমার পূর্বাভাস
বিশ্বব্যাংকের হিসাবে, ২০২৫ সালে উন্নত দেশগুলোর গড় প্রবৃদ্ধি দাঁড়াবে মাত্র ১.২ শতাংশ, যা ২০২৪ সালে ছিল ১.৭ শতাংশ। যুক্তরাষ্ট্রের প্রবৃদ্ধি পূর্বাভাস জানুয়ারির তুলনায় ০.৯ শতাংশ কমিয়ে ১.৪ শতাংশ করা হয়েছে। ২০২৬ সালের জন্যও পূর্বাভাস কমিয়ে ১.৬ শতাংশ করা হয়েছে।
ইউরো জোনে প্রবৃদ্ধি ০.৭ শতাংশে এবং জাপানে ০.৭ শতাংশে নেমে আসবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
উদীয়মান অর্থনীতির দেশগুলোতেও ধাক্কা
উদীয়মান ও উন্নয়নশীল অর্থনীতির দেশগুলো ২০২৫ সালে ৩.৮ শতাংশ হারে প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে পারে, যা জানুয়ারির ৪.১ শতাংশ পূর্বাভাস থেকে কম।
প্রতিবেদনে বলা হয়, দরিদ্র দেশগুলো সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ২০২৭ সাল নাগাদ, এসব দেশের মাথাপিছু জিডিপি কোভিড-পূর্ব স্তরের তুলনায় প্রায় ৬ শতাংশ কম থাকবে। চীনকে বাদ দিলে, এসব দেশের ২০২০ দশকের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে দুই দশক লেগে যেতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রনির্ভর অর্থনীতির দেশ মেক্সিকো সবচেয়ে বড় ধাক্কা খেয়েছে, যেখানে প্রবৃদ্ধি পূর্বাভাস ১.৩ শতাংশ কমিয়ে মাত্র ০.২ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়েছে।
চীনের পূর্বাভাস অপরিবর্তিত
বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহৎ অর্থনীতি চীনের প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস জানুয়ারির ৪.৫ শতাংশেই অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে। বিশ্বব্যাংক জানিয়েছে, বেইজিংয়ের হাতে এখনও আর্থিক ও মুদ্রানীতিগত সহায়তার পর্যাপ্ত সুযোগ রয়েছে।
বিশ্বব্যাংকের এই পূর্বাভাস স্পষ্টভাবে ইঙ্গিত দিচ্ছে যে, বিশ্ব অর্থনীতি এই মুহূর্তে বাণিজ্যকে কেন্দ্র করে অনিশ্চয়তার ভারে চরম চাপের মুখে পড়েছে। উন্নত ও উন্নয়নশীল উভয় ধরনের অর্থনীতি এখন দিশেহারা। যার থেকে উত্তরণে আন্তর্জাতিক সংলাপ ও দীর্ঘমেয়াদি নীতিগত স্থিতিশীলতা অপরিহার্য।