ঢাকার তাপমাত্রা বাড়ছে: সবুজ হারিয়ে চার দশকে বেড়েছে ১.৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস

রাজধানী ঢাকায় গত চার দশকে তাপমাত্রা বেড়েছে ১ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। তবে 'হিট ইনডেক্স'-এর হিসাবে 'ফিলস লাইক' বা অনুভূত তাপমাত্রা বেড়েছে ২ দশমিক ৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস। বিশ্বব্যাংকের পৃষ্ঠপোষকতায় করা এক প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ঢাকায় তাপমাত্রা বৃদ্ধির অন্যতম কারণ হলো সবুজ স্থান কমে যাওয়া এবং তাপ আটকে রাখা কংক্রিটের দ্রুত বিস্তার। এসব কারণে শহরের পৃষ্ঠ আরও বেশি গরম হয়ে উঠছে।
১৯৮০ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে নগরায়ণের ফলে রাজধানী তার ৪৭ শতাংশ ঘন সবুজ হারিয়েছে। এর প্রভাবে ঢাকার সর্বোচ্চ তাপমাত্রা জাতীয় গড়ের চেয়েও দ্রুত বেড়েছে। একই সময়ে দেশজুড়ে তাপমাত্রা বেড়েছে ১ দশমিক ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস।

২০২৩ সালে বাংলাদেশের মানুষ ১৯৮০ সালের তুলনায় ৭ দশমিক ৭ শতাংশ বেশি 'হিট স্ট্রেস' বা তাপজনিত অস্বস্তির মুখোমুখি হয়েছেন। 'অ্যান আনসাসটেইনেবল লাইফ: দ্য ইমপ্যাক্ট অব হিট অন হেলথ অ্যান্ড দ্য ইকোনমি অব বাংলাদেশ' শীর্ষক প্রতিবেদনে এ তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ঢাকার সামগ্রিক হিট ইনডেক্সের বৃদ্ধি এ সময়ে জাতীয় গড়ের চেয়ে সামান্য কম ছিল। এর কারণ আর্দ্রতা কিছুটা কম থাকা। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ঢাকার পরিস্থিতি দ্রুত খারাপ হচ্ছে।
২০১৫ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে ঢাকার তাপমাত্রা প্রতিবছর গড়ে ০ দশমিক ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়েছে, যা তাপ বৃদ্ধিতে জাতীয় প্রবণতা ০ দশমিক ২ ডিগ্রির তুলনায় বেশি।
রাজধানীতে তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ার কারণ হিসেবে গবেষকেরা 'আরবান হিট আইল্যান্ড' (ইউএইচআই) প্রভাবকে চিহ্নিত করেছেন। এর ফলে কংক্রিটঘেরা উন্নয়ন, বাতাস চলাচলে বাধা, যানবাহন ও শীতলীকরণ যন্ত্রের অপচয়কৃত তাপ এবং প্রাকৃতিক শীতলীকরণ উৎস হারিয়ে ফেলা শহরকে আশপাশের এলাকার চেয়ে বেশি উষ্ণ করছে। বৈশ্বিক প্রবণতার সঙ্গে মিল রেখে জুলাই মাস ঢাকার সবচেয়ে উষ্ণ মাস হিসেবে রেকর্ড হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, গরমের সূচক বা হিট ইনডেক্সে তাপমাত্রা ও আর্দ্রতার প্রভাব একসঙ্গে প্রকাশ পায়। উচ্চ আর্দ্রতায় ঘামের বাষ্পীভবন ধীর হয়ে শরীরে তাপজনিত অস্বস্তি বাড়ে। এতে স্বাস্থ্যের ঝুঁকি যেমন বাড়ে, তেমনি কমে উৎপাদনশীলতাও।

অন্য এক গবেষণার উদ্ধৃতি দিয়ে প্রতিবেদনে জানানো হয়, ইউএইচআই প্রভাবের পেছনে রয়েছে—প্রাকৃতিকভাবে শীতল রাখে এমন গাছপালা ও জলাশয়ের কমে যাওয়া, তাপ শোষণ ও ধরে রাখে এমন নির্মাণসামগ্রীর ব্যবহার বৃদ্ধি, ঘনবসতিপূর্ণ অবকাঠামোয় বাতাস চলাচলের বাধা, এবং যানবাহন ও শীতলীকরণ যন্ত্র থেকে নির্গত অপচয়কৃত তাপ।
বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঢাকায় সুস্থ সবুজ উদ্ভিদের পরিমাণ ১৯৮৯ সালে ৫ হাজার ২০২ হেক্টর বা ১৭ শতাংশ থেকে ২০২০ সালে নেমে এসেছে মাত্র ৬১২ হেক্টর বা ২ শতাংশে। দ্রুত নগরায়ণের ফলে শহরের সবুজ এলাকা খণ্ডিত হয়ে কমে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৫ হাজার ৬০০ হেক্টরে, যা একই সময়ে ছিল ১২ হাজার ৭৪৫ হেক্টর। ২০০১ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে ঢাকার আয়তন বেড়েছে ১৯ শতাংশ। কিন্তু একই সময়ে শহরের জনসংখ্যা বেড়েছে প্রায় ৭৭ শতাংশ।
আরও পড়ুন: তীব্র গরমে ২০২৪ সালে বাংলাদেশের ক্ষতি ১.৭৮ বিলিয়ন ডলার: বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন
ইফফাত মাহমুদ, ওয়ামেক আজফার রাজা ও সায়েদ শাবাব ওয়াহিদের যৌথ রচিত প্রতিবেদনে বলা হয়, দক্ষিণ এশিয়ার শহরগুলোতে তাপ ধারণ করে এমন নির্মাণসামগ্রীর কারণে ঘরের ভেতর রাতের বেলা তাপমাত্রা দিনের তুলনায় বেশি থাকে। বিশেষ করে টিনের ছাউনি দেওয়া ঘরে এ অবস্থা মানবস্বাস্থ্যের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে।
প্রতিবেদনটি সতর্ক করে জানায়, ঢাকার হিট ইনডেক্স জাতীয় গড়ের তুলনায় প্রায় ৬৫ শতাংশ বেশি। এর প্রভাব স্বাস্থ্য ও অর্থনীতির ওপর গভীরভাবে পড়ছে। তবে এখনো সমাধানের পথ খোলা রয়েছে।
বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশ ও ভুটান বিষয়ক বিভাগীয় পরিচালক জঁ পেসমে বলেছেন, 'সুখবর হলো—এটি করা সম্ভব। সিঙ্গাপুরসহ কয়েকটি দেশে আমরা তা দেখেছি।' তিনি মনে করেন, জলবায়ু অভিযোজনের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশ সমন্বিত পদক্ষেপ নিতে পারে। বিভিন্ন খাতের সমন্বিত উদ্যোগে তীব্র গরমের প্রভাব মোকাবিলা করা সম্ভব হবে, আর একই সঙ্গে দীর্ঘস্থায়ী প্রবৃদ্ধিও বজায় রাখা যাবে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, ভবন নকশায় ছাদ ও দেয়ালের উপকরণ, জানালার ধরন ও বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা, ভেতর-বাইরের ছায়া ইত্যাদি বিষয় বিবেচনায় নিতে হবে। এতে ঘরের ভেতরে তাপ জমে থাকা রোধ করা যাবে।
এ ছাড়া স্থানীয় প্রয়োজন অনুযায়ী অঞ্চলভিত্তিক বা শহরভিত্তিক 'হিট অ্যাকশন প্ল্যান' প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এতে নিশ্চিত করা যাবে—শহরের স্থাপনা যেন তাপ বৃদ্ধিকারীর বদলে তাপ হ্রাসকারীর ভূমিকা রাখে।