বৈশ্বিক উষ্ণায়নে আফ্রিকার পরিবেশবান্ধব স্থাপত্যশৈলী

আফ্রিকার সাহেল অঞ্চলের তপ্ত রোদে হাঁটতে হাঁটতে আপনি যখন বুরকিনা ফাসোর রাজধানী ওয়াগাদুগুর লেটারাইট পাথরের গম্বুজে ঢুকে পড়বেন, তখন প্রথমেই যে বিষয়টি আপনি টের পাবেন, তা হলো এর ভেতরের হিমশীতল পরিবেশ।
আশপাশে কোথাও এসির দেখা নেই, দেয়ালে নেই কোনও প্লাস্টারের প্রলেপ। শুধু ছায়া আর প্রাকৃতিকভাবে বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা—তাতেই ভেতরটা এত শীতল।
এই অনাড়ম্বর স্থাপনার স্থপতি দিয়েবেদো ফ্রান্সিস কেরে। স্থানীয় উপকরণ ব্যবহারের প্রবক্তা কেরে নিজেকে পরিচয় দেন 'নির্মাণ উপকরণের সুযোগসন্ধানী' হিসেবে। তার মূল নীতি, আশপাশ থেকে যতটুকু সম্ভব উপকরণ সংগ্রহ করে তা দিয়ে কাজ সম্পন্ন করা।
তিনি বলেন, 'আমি চারপাশে দেখি, কোন উপকরণ সবচেয়ে সহজে পাওয়া যায়, মানুষ সেগুলো কীভাবে ব্যবহার করে। এই পর্যবেক্ষণ থেকেই নতুন কিছু তৈরি করার চেষ্টা করি।'
অতি সাধারণ, প্রযুক্তির ছোঁয়া খুবই কম কিন্তু শৈল্পিকতায় পূর্ণ এবং এক ধরনের আধ্যাত্মিক পরিবেশ—কেরের ডিজাইনে তৈরি এই সমাধিস্তম্ভে প্রবেশ করলে মনে হবে যেন আপনি প্রাচীন কোনো মন্দিরের অন্দরমহলে পা রেখেছেন।
২০২২ সালে প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ স্থপতি হিসেবে স্থাপত্যের 'নোবেল' খ্যাত প্রিৎজকার পুরস্কার জেতেন দিয়েবেদো । তিনি এখন আফ্রিকার সবচেয়ে পরিচিত স্থপতিদের একজন, যারা জলবায়ু পরিবর্তনের এই যুগে পরিবেশবান্ধব এবং সাশ্রয়ী নির্মাণচর্চাকে এগিয়ে নিচ্ছেন।
আজকের দিনে যেমন আফ্রিকান সঙ্গীত, শিল্প ও টেলিভিশন বিশ্বসংস্কৃতির অংশ হয়ে উঠেছে, তেমনি আফ্রিকান স্থাপত্যও বিশ্বজুড়ে ক্রমবর্ধমান প্রভাব বিস্তার করছে। তবে দীর্ঘদিন ধরেই আফ্রিকান স্থাপত্যের মূল ধারণাগুলো এসেছে পশ্চিমা দেশ থেকে।
১৯৫০-এর দশক থেকে আফ্রিকার বহু গুরুত্বপূর্ণ সরকারি স্থাপনা নির্মিত হয়েছে আধুনিকতাবাদী (মডার্নিস্ট) রীতিতে, বিশালাকৃতির নকশায়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ–পরবর্তী কালে 'ট্রপিক্যাল মডার্নিজম' নামে পরিচিত এক ধরনের স্থাপত্য ধারা জনপ্রিয় হয়ে ওঠে, যা মূলত সুইস স্থপতি লে করবুজিয়ের নকশা থেকে অনুপ্রাণিত। নাইজেরিয়ান স্থপতি তোসিন ওশিনোও জানান, সদ্য স্বাধীন আফ্রিকান রাষ্ট্রগুলো নিজেদের আত্মপ্রতিষ্ঠার জন্য এই নকশাকে বেছে নেয়।
তবে এসব ভবনের অধিকাংশ স্থপতি আফ্রিকান ছিলেন না। ফলে তারা এমন উপকরণ ব্যবহার করতেন, যা এখানকার স্থানীয় জলবায়ুর সঙ্গে মানানসই নয়। যেমন—কংক্রিট, যা আর্দ্র পরিবেশে সহজেই ফেটে যেতে পারে বা প্লেট গ্লাস, যা ভবনের ভেতর অসহনীয় তাপ তৈরি করে।
যদিও চকচকে আধুনিক ভবন এখনো আফ্রিকার কিছু অভিজাতদের পছন্দের বিষয়। নাইজেরিয়ার স্থপতি কুনলে আদেয়েমি জানান, অনেকেই ভবন নির্মাণে দুবাই কিংবা পশ্চিমা ঘরানার ঝকঝকে ডিজাইন চান। এতে স্থাপনাগুলোতে একঘেয়েমি আসে, কখনো কখনো তা হয়ে ওঠে সস্তা অনুকরণ।
যেমন, ইথিওপিয়ার রাজধানী আদ্দিস আবাবার ঐতিহাসিক কেন্দ্র ধ্বংস করে এখন তৈরি হচ্ছে ঊপসাগরীয় দেশগুলোর মতো অবিকল সাদামাটা উঁচু দালান।
অন্যদিকে, দিয়েবেদো কেরে ও তার মতো সহকর্মী স্থপতিরা দেখাচ্ছেন ভিন্ন এক পথ। বিদেশি অনুকরণ নয়, বরং স্থানীয় সংস্কৃতি, পরিবেশ ও উপকরণ থেকে ধারণা নিয়ে তারা গড়ে তুলছেন টেকসই ভবিষ্যৎ।
নাইজেরিয়ার লেগোস শহরে সম্প্রতি উদ্বোধিত জন র্যান্ডল সেন্টার জাদুঘরের গাঁথুনিতে ব্যবহৃত হয়েছে ইউরোবা জাতিগোষ্ঠীর ঐতিহ্যবাহী মাটির প্লাস্টারের ছাপ, যা প্রাচীন কাদামাটির নির্মাণশৈলির আদলে তৈরি।
স্থপতি সেউন ওদুওলে বলেন, বর্তমানে অধিকাংশ ভবন 'প্রাকৃতিক পরিবেশ থেকে বিচ্ছিন্ন সাদা বাক্সের মতো'। তিনি এমন স্থাপনা তৈরিতে বিশ্বাসী, যা প্রকৃতি ও পরিবেশের সঙ্গে সম্পূর্ণ সামঞ্জস্যপূর্ণ থাকবে।
দক্ষিণ আফ্রিকার স্থপতি সুমায়া ভ্যালি তার সাম্প্রতিক কিছু প্রকল্পে অনুপ্রেরণা নিয়েছেন উইপোকা ঢিবির প্রাকৃতিক শীতলীকরণ পদ্ধতি থেকে।
অন্যদিকে, নাইজারের মারিয়াম ইসুফু লাইবেরিয়ায় নির্মাণ করছেন এলেন জনসন সারলিফ প্রেসিডেনশিয়াল সেন্টার, যার নকশা নেওয়া হয়েছে ঐতিহ্যবাহী পালাভা কুটির থেকে। এই ধরনের কুটিরে ভারী বৃষ্টিপাতের পানি সরিয়ে নেওয়ার কার্যকর ব্যবস্থা থাকে। ২০২২ সালে মারিয়াম ইসুফু আগা খান পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়েছিলেন।
২০১৭ সালে বুরকিনা ফাসোর বিপ্লবী নেতা থমাস সানকারা যেখানে খুন হয়েছিলেন, সেখানেই তার স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করেছেন দিয়েবেদো ফ্রান্সিস কেরে। এই প্রকল্পে ব্যবহৃত হয়েছে মাটির তৈরি ইট, যা কংক্রিটের তুলনায় ২০ থেকে ৭০ শতাংশ পর্যন্ত সাশ্রয়ী।
এই আঞ্চলিক ভাবনার আফ্রিকান স্থাপত্য এখন বিশ্বব্যাপী দৃষ্টি আকর্ষণ করছে। ২০২৩ সালে বিশ্বের অন্যতম প্রভাবশালী স্থাপত্য উৎসব ভেনিস আর্কিটেকচার বিয়েনালে অংশগ্রহণকারীদের অর্ধেকের বেশি আফ্রিকা ও এর অভিবাসী সম্প্রদায় থেকে এসেছিলেন।
নিউ ইয়র্কের মিউজিয়াম অব মডার্ন আর্টের মার্টিনো স্টিয়ারলি বলেন, 'এটা এক অনন্য সময়। স্থানীয়ভাবে গড়ে ওঠা এক প্রজন্মের স্থপতিরা এখন বৈশ্বিক প্রভাব ফেলছেন।'
দিয়েবেদো কেরের প্রথম বড় আন্তর্জাতিক প্রকল্প হচ্ছে লাস ভেগাস মিউজিয়াম অব আর্ট, যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেভাদা মরুভূমির অনুপ্রেরণায় নির্মাণাধীন। এই জাদুঘরটি ২০২৮ সালে উদ্বোধনের কথা।
অপরদিকে, দক্ষিণ আফ্রিকার স্থপতি সুমাইয়া ভ্যালি বেলজিয়ামে একটি সেতু ডিজাইন করছেন, যা ঐতিহ্যবাহী কঙ্গোলিজ নৌকার আদলে তৈরি হবে।
শহর পরিকল্পনাকারীরা ভবিষ্যতকে মাথায় রেখে আফ্রিকার স্থানীয় নির্মাণ উপকরণ ও পদ্ধতিগুলো ব্যবহার করছেন। সিমেন্ট শিল্প একাই বিশ্বে প্রায় ৮ শতাংশ কার্বন ডাই অক্সাইড নির্গমনের জন্য দায়ী।
নাইজেরিয়ার স্থপতি কুনলে আদেয়েমির "ওয়াটার সিটিজ" প্রকল্প বিশ্বজুড়ে স্বীকৃতি পেয়েছে। এটি একটি ভাসমান শহর, যা জমির সংকট ও সমুদ্রস্তরের বৃদ্ধি মোকাবেলায় ডিজাইন করা হয়েছে।
আফ্রিকায় উদ্ভাবিত টেকসই নির্মাণ পদ্ধতিগুলো অন্য দেশেও ছড়িয়ে পড়ছে। কেরের নির্মিত স্মৃতিসৌধে ব্যবহৃত 'প্যাসিভ কুলিং' প্রযুক্তি উষ্ণ তাপমাত্রার দেশগুলোতে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। ২০২৩ সালে প্রিত্ৎজকার পুরস্কারজয়ী পশ্চিমা স্থপতি ডেভিড চিপারফিল্ডও একই ধরনের মাটি ও কাদা ব্যবহার করছেন।
কেরে বলেন, '১৯৭০-৮০-এর দশকে বুরকিনা ফাসোতে এই পদ্ধতিগুলোকে 'পুরনো' মনে করে অবজ্ঞা করা হত, কিন্তু এখন এটাই স্থাপত্যশৈলীর ভবিষ্যত।'
অনুবাদ: আয়েশা ওয়ারেসা