২০২৪ সালে আগুনে বিশ্বে বন ধ্বংসের হার রেকর্ড সর্বোচ্চ, দাবানলে আমাজনে ধ্বংস ৬০% বন
বিশ্বজুড়ে বন ধ্বংসের হার ২০২৪ সালে ইতিহাসের সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে। গবেষকদের মতে, বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ফলে দাবানলের প্রকোপ বেড়ে যাওয়াই এই ধ্বংসযজ্ঞের মূল কারণ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মেরিল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের এক বিশ্লেষণ এমন ভয়াবহ তথ্য সামনে এনেছে, যা 'ভীতিকর' বলে আখ্যা দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
বিশ্লেষণটি 'গ্লোবাল ফরেস্ট ওয়াচ' প্ল্যাটফর্মে প্রকাশিত হয়েছে। এতে দেখা গেছে, ব্রাজিলের আমাজন বন থেকে শুরু করে সাইবেরিয়ার তাইগা পর্যন্ত—২০২৪ সালে বিশ্বজুড়ে রেকর্ড পরিমাণ বন উজাড় হয়েছে। কৃষিকাজ, দাবানল, কাঠ সংগ্রহ ও খনি প্রকল্পের কারণে ইতালির আয়তনের সমান বনভূমি হারিয়েছে পৃথিবী।
বিশ্লেষণটির নেতৃত্ব দিয়েছেন মেরিল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্ল্যাড ল্যাবের সহ-পরিচালক অধ্যাপক ম্যাট হ্যানসেন। তিনি বলেন, 'এই পরিসংখ্যান সত্যিই ভয়ংকর।' গ্লোবাল ফরেস্ট ওয়াচের সহ-পরিচালক এলিজাবেথ গোল্ডম্যান বলেন, 'গত ২০ বছরের তথ্যভাণ্ডারে এমন কিছু আমরা আগে কখনও দেখিনি।'
বিশ্বের যে অঞ্চলগুলোতে সবচেয়ে বেশি জীববৈচিত্র্য ও কার্বন জমা থাকে—সেসব ক্রান্তীয় বনাঞ্চলে এ বছর প্রথমবারের মতো বন ধ্বংসের প্রধান কারণ হয়ে উঠেছে দাবানল। অথচ, এই অঞ্চলের প্রকৃতি অনুযায়ী আগুন কোনও প্রাকৃতিক উপাদান নয়। অন্যদিকে, কানাডা ও সাইবেরিয়ার উপক্রান্তীয় বনভূমিতেও আগুন লাগার প্রবণতা অব্যাহত রয়েছে।
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে তাপমাত্রা বাড়ছে, বাতাস হচ্ছে শুষ্ক। এতে অ্যামাজনের রেইনফরেস্ট এখন আগুন লাগার মতো পরিস্থিতিতে পৌঁছেছে। ২০২৩ সাল ছিল ইতিহাসের সবচেয়ে উষ্ণ বছর। এর সঙ্গে এল নিনো আবহাওয়ার প্রভাব যুক্ত হয়ে আমাজন অঞ্চলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়।
চাষিরা সয়াবিন বা গবাদি পশুর জন্য জমি পরিষ্কার করতে আগুন দিলে, তা অনেক সময় নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়।
গ্লোবাল ফরেস্ট ওয়াচ-এর হিসাব অনুযায়ী, ২০২৩ সালে এসব আগুন থেকে ১.১৫ গিগাটন কার্বন ডাই-অক্সাইড বাতাসে ছড়িয়েছে—যা পুরো দক্ষিণ আমেরিকার জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়ানোর চেয়েও বেশি।
২০২৪ সালে ব্রাজিলে বন ধ্বংসের হার অতীতের সব রেকর্ড ছাপিয়ে গেছে, এমনকি কট্টর ডানপন্থি প্রেসিডেন্ট জাইর বলসোনারোর শাসনামলেও এত বেশি হার দেখা যায়নি। ভয়াবহ খরা ও দাবানলের কারণে এই ধ্বংস ত্বরান্বিত হয়েছে। আমাজনে এটাই ছিল রেকর্ডকৃত ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহ খরা।
বিশ্বের সবচেয়ে বড় ক্রান্তীয় বন আমাজনের বড় অংশ ব্রাজিলে। ২০২৪ সালে দেশটি হারিয়েছে প্রায় ২৮,২০০ বর্গকিলোমিটার বন। ২০১৬ সালের পর এটিই সবচেয়ে বেশি ক্ষতি। পরিবেশবান্ধব প্রেসিডেন্ট লুইজ ইনাসিও লুলা দা সিলভার জন্য এটি বড় ধাক্কা। যদিও তার উদ্যোগে ২০২২ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে বন ধ্বংস এক-তৃতীয়াংশ কমেছিল।
তবে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে এ ক্ষতি ঠেকানো যায়নি। ২০২৪ সালে বন ধ্বংস কমেছে—এমন তথ্য দেখে অনেকে আশাবাদী হয়েছিলেন। কিন্তু সেই তথ্য দাবানলের হিসাব রাখেনি। অথচ দাবানলেই গত বছর আমাজনের ৬০ শতাংশ বন ধ্বংস হয়। এটি ছিল ইতিহাসের সবচেয়ে বড় খরা। আগুন ছিল ভয়াবহ, নিয়ন্ত্রণ করাও কঠিন। বিজ্ঞানীরা বলছেন, এমন অবস্থা ভবিষ্যতে আরও বাড়বে।
অর্থনৈতিক উন্নয়নের চেষ্টাও বন ধ্বংস বাড়াচ্ছে। ব্রাজিলের কিছু রাজ্য কৃষি বাড়াতে বন রক্ষা নীতিতে ছাড় দিচ্ছে। মাতো গ্রোসো রাজ্য বন রক্ষা করা কোম্পানিগুলোর কর-ছাড় তুলে দিয়েছে। রন্ডোনিয়া রাজ্যে 'ক্ষমা আইন' পাশ হয়েছে, যা আগের বন ধ্বংস মাফ করে দিচ্ছে। এতে গবাদি পশুর খামারিরা আগুন দিয়ে জমি দখল করতে উৎসাহ পাচ্ছেন।
এই প্রবণতা আরও পরিষ্কার বোঝা যায় বলিভিয়ার দিকে তাকালে। দেশটি গরুর মাংস ও সয়াবিন চাষে বন কেটে জমি তৈরি করছে। সরকার সেখানে আগুন দিয়ে জমি তৈরি ও রপ্তানিতে ছাড় দিয়েছে। ২০১৯ সালের পর বন ধ্বংস পাঁচগুণ বেড়েছে। ২০১০ থেকে ২০২২ পর্যন্ত দেশের ৫৭ শতাংশ বন ধ্বংস হয় পশুপালনের কারণে। অবৈধ বন কাটার শতাধিক মামলার মধ্যে শাস্তি হয়েছে মাত্র ছয়টিতে।
এর ফলে ২০২৪ সালে বলিভিয়া ১৪,৮০০ বর্গকিলোমিটার বন হারিয়েছে। আগের বছরের তুলনায় এটি ২০০ শতাংশ বেশি। দেশটির বন কম হলেও কঙ্গোর চেয়েও বেশি বন হারিয়েছে। দাবানলেই হয়েছে দুই-তৃতীয়াংশ ক্ষতি।
শুধু বলিভিয়া নয়, পেরুও বন কেটে জমি তৈরি করা ব্যক্তিদের জন্য ২০২৪ সালে আইন শিথিল করে। এতে দেশটিতে বন ধ্বংস বেড়েছে ২৫ শতাংশ। কলম্বিয়ায় বিদ্রোহীরা সোনা খনন ও কোকা চাষের জন্য বন কেটে ফেলছে। ২০২৪ সালে সেখানে প্রাথমিক বন ধ্বংস ৪৯ শতাংশ বেড়েছে।
সবচেয়ে সুরক্ষিত বলে পরিচিত গায়ানাও ঝুঁকিতে পড়েছে। দেশটি চায়, বিশ্ব তাকে অর্থ সহায়তা দিক যাতে তারা বন রক্ষা করতে পারে। কিন্তু সেখানে বন ধ্বংস বেড়েছে ২৭৫ শতাংশ। কারণ দাবানল ও অবৈধ স্বর্ণখনি।
আফ্রিকার ডেমোক্র্যাটিক রিপাবলিক অব কঙ্গো (ডিআরসি) এবং কঙ্গো-ব্রাজাভিলেও প্রাকৃতিক রেইনফরেস্ট ধ্বংসের সর্বোচ্চ রেকর্ড হয়েছে। এই দুই দেশেই অবস্থিত কঙ্গো অববাহিকার রেইনফরেস্ট, যা আমাজনের পরেই পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম।
এই বন ধ্বংসের প্রবণতা বিশ্বব্যাপী পরিবেশ সংকটকে আরও গভীর করে তুলছে, বলছেন বিশেষজ্ঞরা।
গ্লাসগোতে অনুষ্ঠিত কপ২৬ জলবায়ু সম্মেলনে বিশ্বের ১৪০টিরও বেশি দেশের শীর্ষ নেতারা ২০৩০ সালের মধ্যে বন ধ্বংস সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। কিন্তু প্রতিশ্রুতি দেওয়ার চার বছরের মধ্যেই বাস্তব চিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন। লক্ষ্যে পৌঁছাতে হলে ২০২৪ সালের তুলনায় প্রতি বছর অন্তত ২০ শতাংশ হারে বন ধ্বংস কমাতে হবে। অথচ বাস্তবে তার বিপরীত চিত্র স্পষ্ট।
আমেরিকার দক্ষিণাঞ্চলে গ্রান চাকো অঞ্চলে সবুজের বিস্তীর্ণ এলাকাগুলো পরিণত হচ্ছে ধুলোময় শ্মশানে। কাঠুরেরা ইচ্ছেমতো বন কেটে ফেলায় দেখা দিচ্ছে এই বিপর্যয়।
এ প্রসঙ্গে উপাত্ত বিশ্লেষক হ্যানসেন বলেন, 'এই তথ্যগুলোর বার্তাই ভীতিকর। বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে বনাঞ্চল আরও গরম ও শুষ্ক হয়ে উঠছে। যার ফলে সেগুলোতে আগুন লাগার আশঙ্কাও বেড়েছে। একবার মানুষের মাধ্যমে আগুনের সূত্রপাত হলে, এমনকি দুর্গম রেইনফরেস্ট এলাকাও নিয়ন্ত্রণহীনভাবে পুড়ে ছাই হয়ে যেতে পারে।'
তিনি আরও বলেন, 'আমাদের এখন অনেক বড় চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে—এই ধ্বংসাত্মক, ছড়িয়ে পড়া এবং ক্রমবর্ধমান অগ্নিকাণ্ডের প্রবণতা থামাতে হবে।'
বিশ্বব্যাপী বন ধ্বংসের রেকর্ড ভাঙা হারকে 'গ্লোবাল রেড অ্যালার্ট' হিসেবে আখ্যায়িত করেন পরিবেশবাদী গোল্ডম্যান।
তিনি বলেন, 'এটা প্রতিটি দেশ, প্রতিটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এবং প্রতিটি সচেতন মানুষের জন্য একসঙ্গে কাজ করার আহ্বান। আমাদের অর্থনীতি, সমাজ, স্বাস্থ্য—কোনোকিছুই টিকে থাকতে পারবে না যদি বন না থাকে।'
বিশ্বে যেসব দেশে এখনও বৃহৎ আকারে অক্ষত বন রয়েছে, সেই ২০টি দেশের মধ্যে ১৭টি দেশেই বন ধ্বংসের হার ২০২১ সালে গ্লাসগোতে চুক্তি স্বাক্ষরের সময়ের তুলনায় এখন বেড়ে গেছে।
তবে সব দিকেই হতাশাজনক পরিস্থিতি নয়। ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়ায় প্রাথমিক বনের ক্ষয় তুলনামূলকভাবে কম। মালয়েশিয়া তো প্রথমবারের মতো শীর্ষ দশ বন ধ্বংসকারী দেশের তালিকা থেকেও বাদ পড়েছে।
মেরিল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্ল্যাড ল্যাবের সহ-পরিচালক অধ্যাপক পিটার পোটাপভ সতর্ক করে বলেন, 'বিশ্ব এখন এক বিপজ্জনক নতুন চক্রে প্রবেশ করছে। ২০২৪ সাল অগ্নিকাণ্ডের মাধ্যমে বন ধ্বংসের দিক থেকে ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহ বছর হয়ে উঠেছে—গত বছরের রেকর্ডকেও ছাড়িয়ে গেছে। যদি এই প্রবণতা চলতেই থাকে, তবে তা প্রাকৃতিক গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলগুলোর স্থায়ী রূপান্তর ঘটাতে পারে এবং বিপুল পরিমাণ কার্বন নির্গত করে জলবায়ু পরিবর্তনকে আরও তীব্র করে তুলবে, যার ফলে আগুন আরও ব্যাপক হবে।'
তিনি আরও বলেন, 'এটা এমন এক বিপজ্জনক চক্র যা আমাদের আর কখনোই সক্রিয় করতে দেওয়া যাবে না।'
