ইতালির নাগরিকত্ব গণভোট: ‘আমি এখানে জন্ম নিয়েছি; কিন্তু এখনও আমার নিজেকে উপেক্ষিত মনে হয়’

রোমে জন্মগ্রহণ করা সনি ওলুমাতি তার পুরোজীবন ইতালিতে বসবাস করছেন। স্বাভাবিকভাবেই ইতালিকেই তিনি তার নিজের দেশ বলে মনে করেন। তবে এই দেশ [ইতালি] আজও তাকে নিজের নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি দেয়নি।
ইতালিয় কর্তৃপক্ষের দৃষ্টিতে সনি একজন নাইজেরিয়ান, তার পাসপোর্টের মতোই; ৩৯ বছর বয়সী সনিও ততদিনই দেশটিতে থাকতে পারবে, যতদিন তার সর্বশেষ রেসিডেন্স পারমিট বৈধ।
পেশায় নৃত্যশিল্পী ও অ্যাক্টিভিস্ট সনি বলেন, 'আমি এখানে জন্মেছি। এখানেই বাঁচব। এখানেই মরব।'
তিনি বলেন, 'কিন্তু নাগরিকত্ব না পাওয়াটা এমন, যেন নিজের দেশ থেকেই প্রত্যাখ্যাত হচ্ছি। আমি মনে করি আমাদের সঙ্গে এমন করা উচিত বলে না।'
এই কারণেই সনি ও অন্যান্যরা রবি ও সোমবার আয়োজিত জাতীয় গণভোটে 'হ্যাঁ' ভোটের পক্ষে প্রচারণা চালাচ্ছেন।
এই গণভোটে ইতালিয়ান নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করতে প্রয়োজনীয় সময়সীমা অর্ধেকে নামিয়ে আনার প্রস্তাব রাখা হয়েছে।
এতে বলা হয়েছে, ১৮ বছরের নিচের যেকোনো শিশুকে তার বাবা-মায়ের সঙ্গে স্বয়ংক্রিয়ভাবে নাগরিকত্ব দেওয়া হবে।
প্রস্তাবকারীদের মতে, দশ বছর থেকে পাঁচ বছরে সময় কমিয়ে আনা হলে ইতালি ইউরোপের অন্যান্য দেশের সঙ্গে তাল মেলাতে পারবে এবং এতে অন্তর্ভুক্তিকরণ (ইন্টিগ্রেশন) প্রক্রিয়াও উন্নত হবে।
সাধারণ নাগরিকদের একটি সংগঠন এই গণভোটের উদ্যোগ নিয়েছে এবং এটি বিভিন্ন সিভিল সোসাইটি গোষ্ঠী সমর্থন করছে।
তবে গণভোট বৈধ করতে হলে দেশের অন্তত ৫০% ভোটারের উপস্থিতি প্রয়োজন।
দেশটির কট্টর ডানপন্থী প্রধানমন্ত্রী জর্জিয়া মেলোনি জানিয়েছেন, তিনি এই ভোট বয়কট করবেন।
তার দাবি, নাগরিকত্ব সংক্রান্ত আইন ইতোমধ্যেই 'চমৎকার' এবং 'খুবই উন্মুক্ত'।
তার সঙ্গে যুক্ত অন্যান্য দলগুলো ইতালিয়ানদের ভোটকেন্দ্রে না গিয়ে সমুদ্রসৈকতে যাওয়ার আহ্বান জানিয়েছে।
সনি ভোটে অংশ নিতে পারছেন না। কারণ, নাগরিকত্ব না থাকায় তার ভোট দেওয়ার অধিকার নেই।
নাগরিকত্বের প্রশ্নটি ইতালিতে একটি সংবেদনশীল বিষয়।

প্রতি বছর বিপুল সংখ্যক অভিবাসী ও শরণার্থী দেশটিতে আসেন। তাদের উল্লেখযোগ্য অংশ উত্তর আফ্রিকা থেকে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে পাচারকারীদের মাধ্যমে ইতালিতে পৌঁছান।
মেলোনির পপুলিস্ট সরকার অভিবাসী ও শরণার্থী আসার হার কমানোর জন্য বড় ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছে।
কিন্তু এই গণভোটটি তাদের জন্য, যারা বৈধভাবে কাজের জন্য ইতালিতে এসেছেন।
তাদের চাওয়া নাগরিকত্ব প্রাপ্তির প্রক্রিয়া দ্রুত করা, কঠোর মানদণ্ড শিথিল করা নয়।
গণভোটের সমর্থক লিবারেল পার্টি মোর ইউরোপের কারলা তাইবি বলেন, 'ইতালিয়ান ভাষার জ্ঞান, অপরাধের অভিযোগ না থাকা, ধারাবাহিক বসবাস ইত্যাদি—সব বিভিন্ন প্রয়োজনীয়তা অপরিবর্তিত থাকবে।'
এই সংস্কার ইতোমধ্যেই ইতালিতে দীর্ঘমেয়াদে কর্মরত বিদেশি বাসিন্দাদের ওপর প্রভাব ফেলবে।
তাদের ১৮ বছরের নিচের সন্তানরাও স্বয়ংক্রিয়ভাবে নাগরিকত্ব পাবেন।
ধারণা করা হয়, এর ফলে অবিলম্বে সর্বাধিক ১.৪ মিলিয়ন মানুষ নাগরিকত্ব পাওয়ার যোগ্য হবে। কারো কারো ধারণা এই সংখ্যাটা আরও বেশি।
তাইবি বলেন, 'এই মানুষগুলো ইতালিতে বসবাস করে, পড়াশোনা করে এবং কাজ করে এবং [ইতালির অর্থনীতিতে অবদান রাখে। এটি তাদের সম্পর্কে মনোভাব পরিবর্তন করার বিষয়—তারা অপরিচিত কেউ নয়, বরং ইতালিয়ান।'সংস্কারটির বাস্তব প্রভাবও থাকবে।
একজন অ-ইতালিয়ান হিসেবে, সনি পাবলিক সেক্টরে চাকরির জন্য আবেদন করতে পারেন না।
এমনকি ড্রাইভিং লাইসেন্স পাওয়ার ক্ষেত্রেও তিনি সংগ্রাম করেছেন।
গত বছর যখন তাকে জনপ্রিয় রিয়েলিটি টিভি শো ফেম আইল্যান্ডে বুক করা হয়েছিল, তখন হন্ডুরাসে সেটে পৌঁছাতে তার দুই সপ্তাহ দেরি হয়, কারণ সঠিক কাগজপত্র পেতে অনেক সমস্যার মুখে পড়েছিলেন তিনি।
দীর্ঘ সময় ধরে, মেলোনি এই গণভোটের দাবি পুরোপুরি উপেক্ষা করেছেন।
মেলোনির ঘনিষ্ঠ মিত্র দ্বারা পরিচালিত ইতালির রাষ্ট্রায়ত্ত মিডিয়া গণভোটের প্রতি খুব কম গুরুত্ব দিয়েছে।
প্রত্যক্ষভাবে এই পরিবর্তনের বিরোধীতাকারীরা কোনো প্রচারণা চালাচ্ছেন না, তাই দুই পক্ষের মধ্যে সুষম বিতর্কের কোনো সুযোগ নেই। বিরোধীতাকারীরা মূল কাজটি করছে কৌশলে।
রোমের লুইস বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রবার্তো ডি'আলিমন্টে ব্যাখ্যা করেন, 'তারা গণভোটের গুরুত্ব সম্পর্কে জনসচেতনতা বাড়াতে চায় না, এটি একটি কৌশলগত সিদ্ধান্ত, যাতে ৫০ শতাংশ ভোটার উপস্থিতির শর্ত পূর্ণ না হয়।'
প্রধানমন্ত্রী মেলোনি অবশেষে ঘোষণা করেছেন, 'ব্যালট বক্সের প্রতি সম্মান দেখাতে' তিনি ভোটকেন্দ্রে উপস্থিত হবেন; কিন্তু ভোট দেবেন না।
সমালোচকরা তাকে গণতন্ত্রের প্রতি অসম্মান করার অভিযোগ তোলার পর মেলোনি এই সপ্তাহে একটি টিভি চ্যাট শোতে বলেছিলেন, 'আপনি একমত না হলে, আপনার চুপ থাকারও অপশন আছে।'
ইতালির নাগরিকত্ব ব্যবস্থা 'চমৎকার'।

তিনি যুক্তি দেন, ইতোমধ্যেই ইউরোপের বেশিরভাগ দেশের চেয়ে বেশি বিদেশিকে নাগরিকত্ব দিচ্ছে ইতালি।
জাতীয় পরিসংখ্যান সংস্থা আইস্ট্যাটের মতে, গত বছর দেশটিতে ২ লাখ ১৭ হাজার মানুষকে নাগরিকত্ব দিয়েছে ইতালি।
এদিকে, মেলোনির জোটসঙ্গী ও ফার-রাইট লিগের সদস্য রবার্তো ভ্যানাচ্চি বলেন, গণভোটের পেছনে থাকা ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে 'ইতালিয়ান নাগরিকত্ব বিক্রি এবং ইতালিয়ানদের পরিচয় মুছে ফেলার' অভিযোগ করেছেন।
আমি সনি'কে জিজ্ঞাসা করলাম তার নিজের নাগরিকত্বের আবেদনে ২০ বছরেরও বেশি সময় নিয়েছে কেন, এ বিষয়ে তিনি কী মনে করেন।
তিনি তাত্ক্ষণিকভাবে উত্তর দেন, 'এটি বর্ণবাদ।'
একসময় তার ফাইল পুরো হারিয়ে গিয়েছিল এবং বর্তমানে তাকে বলা হয়েছে তার মামলা 'স্থগিত রাখা হয়েছে'।
মেলোনির দলের সদস্য ও তৎকালীন কৃষি মন্ত্রীর ২০২৩ সালের মন্তব্য স্মরণ করে সনি বলেন, 'আমাদের মন্ত্রীরা শ্বেতাঙ্গদের শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে কথা বলেন।'
সনি বলেন, 'তারা কৃষ্ণাজ্ঞদের নাগরিক করতে চান না এবং আমরা সবাই এ কথা জানি। আমি এখানে ৩৯ বছর আগে জন্মেছি, তাই আমি জানি আমি কী বলছি।'
এই অভিযোগ প্রধানমন্ত্রী মেলোনি বারবার অস্বীকার করেছেন।
ইনসাফ দিমাসি নিজেকে 'নাগরিকত্বহীন ইতালিয়ান' হিসেবে পরিচয় দেন।
তিনি বলেন, 'ইতালিতে আমি বড় হয়েছি। তাই আজও আমাকে এই দেশের নাগরিক না ভাবতে পারাটা অত্যন্ত বেদনাদায়ক ও হতাশাজনক।'
বর্তমানে তিনি বোলোগনা শহরে পিএইচডি করছেন।
ইনসাফ যখন শিশু সেসময় তার বাবা কাজের জন্য ইতালিতে এসেছিলেন। পরবর্তীতে তিনি ও তার মা তার বাবার কাছে চলে আসেন।
তার বাবা-মা অবশেষে ইনসাফের ১৮ বছর পূর্ণ হওয়ার ২০ দিন পর নাগরিকত্ব পান। এর মানে তার [ইনসাফের] নিজেরও আবেদন করতে হয়েছে, যার মধ্যে একটি স্থিতিশীল আয়ের প্রমাণও দেখাতে হয়েছে।
ইনসাফ পড়াশোনার পথ বেছে নিয়েছিলেন।
তিনি হতাশ হয়ে বলেন, 'আমি এখানে ৯ মাস বয়সে এসেছি এবং হয়তো ৩৩ বা ৩৪ বছর বয়সে; যদি সব কিছু ঠিক থাকে, আমি অবশেষে একজন ইতালিয়ান নাগরিক হতে পারব।'
গণভোটের প্রাক্কালে রোমের শিক্ষার্থীরা শহরের একটি চত্বরে ভোটকেন্দ্রে যাওয়ার আহ্বান জানিয়ে একটি বার্তা লিখেছিলেন।
তারা বিশাল কার্ডবোর্ড অক্ষরে লিখেছিল, '৮ ও ৯ [জুন] 'হ্যাঁ' ভোট দিন।'
সরকারের পক্ষ থেকে বয়কট এবং এত কম প্রচারের কারণে ৫০% উপস্থিতি সীমা পূর্ণ হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ বলে মনে হয়।
কিন্তু সনি যুক্তি দেন যে এই ভোটটি শুধুমাত্র শুরু।

তিনি বলেন, 'যদিও তারা 'না' ভোট দেয়, আমরা আমাদের সিদ্ধান্তে অটল থাকব—এবং পরবর্তী পদক্ষেপ সম্পর্কে ভাবব।'
তিনি আরও বলেন, 'আমাদের এই দেশে আমাদের সম্প্রদায়ের অবস্থান সম্পর্কে কথা বলা শুরু করতে হবে।'
ইতালিতে নাগরিকত্ব ও শ্রম অধিকার সম্পর্কিত আইন সহজীকরণের জন্য অনুষ্ঠিত দুই দিনের গণভোটের দ্বিতীয় দিন সোমবার (৯ জুন) ভোটগ্রহণ হয়েছে।কিন্তু খুব কম ভোটার উপস্থিতির কারণে ভোটটি অবৈধ হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
গণভোটের সর্বশেষ অবস্থা
রবিবার পর্যন্ত প্রাথমিক তথ্যে দেখা গেছে যে, মাত্র ২৩% যোগ্য ভোটার ভোট দিয়েছেন, যা প্রয়োজনীয় ৫০% + ১ জন ভোটারের উপস্থিতির তুলনায় অনেক কম।
এই ভোটে পাঁচটি প্রস্তাব ছিল, যার মধ্যে একটি ছিল নাগরিকত্বের জন্য আবশ্যক বসবাসের মেয়াদ ১০ বছর থেকে ৫ বছরে কমানোর প্রস্তাব।
এটি আনুমানিক ২৫ লাখ বিদেশি নাগরিকের জীবনকে প্রভাবিত করতে পারে।
অন্য প্রস্তাবগুলো কর্মসংস্থান সংক্রান্ত আইন সংস্কার এবং কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনার জন্য দায়বদ্ধতা সংশোধনের বিষয়ে ছিল।
ইতালির প্রধানমন্ত্রী জর্জিয়া মেলোনি এবং তার মিত্ররা গণভোটে অংশগ্রহণ না করে বর্জনের আহ্বান জানান, যা গণভোটের প্রতি জনগণের আগ্রহ কমাতে ভূমিকা রাখতে পারে।
গণভোটের ফলাফল বৈধ হওয়ার জন্য ৫০% ভোটার উপস্থিতি প্রয়োজন হলেও, ভোটার উপস্থিতি কম হওয়ায় ফলাফল অবৈধ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
রবিবার মেলোনি রোমের একটি ভোটকেন্দ্রে উপস্থিত হলেও, তার স্টাফরা নিশ্চিত করেছেন যে তিনি ব্যালট পেপার সংগ্রহ করেননি এবং ভোট দেননি, যা তার পূর্বে ঘোষিত কৌশলের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ।