ট্রাম্পের সর্বশেষ ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা সম্পর্কে যা যা জানা গেল

যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের ক্ষেত্রে ১২টি দেশের নাগরিকদের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। বুধবার (৪ জুন) তিনি এ সংক্রান্ত একটি নির্বাহী আদেশে সই করেন। জাতীয় নিরাপত্তার ঝুঁকি দেখিয়ে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে হোয়াইট হাউজ জানিয়েছে। খবর বিবিসি'র।
এছাড়া আরও সাতটি দেশের নাগরিকদের ওপর আংশিক ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হবে।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট জানিয়েছেন, যদি 'গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি' হয়, তাহলে এই তালিকা পুনর্বিবেচনা করা হতে পারে। আবার বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে নতুন হুমকির উদ্ভব ঘটলে অতিরিক্ত দেশকেও এই তালিকায় যুক্ত করা যেতে পারে।
নির্দিষ্ট কিছু দেশের নাগরিকদের ওপর ট্রাম্পের দ্বিতীয়বারের মতো ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা এটি। এর আগে ২০১৭ সালে তার প্রথম মেয়াদে তিনি এ ধরনের একটি নির্বাহী আদেশে স্বাক্ষর করেছিলেন।
নিষেধাজ্ঞার আওতায় আসা দেশগুলো হলো—আফগানিস্তান, মিয়ানমার, চাদ, কঙ্গো, ইকুয়েটোরিয়াল গিনি, ইরিত্রিয়া, হাইতি, ইরান, লিবিয়া, সোমালিয়া, সুদান ও ইয়েমেন।
এছাড়া, আরও সাতটি দেশের ওপর আংশিক ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছেন ট্রাম্প। দেশগুলো হলো—বুরুন্ডি, কিউবা, লাওস, সিয়েরা লিওন, টোগো, তুর্কমেনিস্তান ও ভেনেজুয়েলা।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্স-এ প্রকাশিত এক ভিডিও বার্তায় ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেন, 'যারা আমাদের ক্ষতি করতে চায়, তাদের আমাদের দেশে প্রবেশ করতে দেওয়া হবে না।' তিনি জানান, এই তালিকায় পরিবর্তন আনা হতে পারে এবং ভবিষ্যতে আরও দেশ যুক্ত হতে পারে।
ঘোষণাপত্র অনুযায়ী, এই নিষেধাজ্ঞা আগামী ৯ জুন থেকে কার্যকর হবে। ঘোষণায় আরও বলা হয়েছে, ওই তারিখের আগে ইস্যু করা ভিসাগুলোর বৈধতা থাকবে; সেগুলো বাতিল করা হবে না।
নিষেধাজ্ঞার ঘোষণা কেন?
হোয়াইট হাউজ জানিয়েছে, এই 'কমন সেন্স' বা সাধারণ বোধসম্পন্ন নিষেধাজ্ঞাগুলো আমেরিকানদের 'বিপজ্জনক বিদেশি তৎপরতার' হাত থেকে সুরক্ষা দেবে।
ডোনাল্ড ট্রাম্প তার নিজস্ব সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম প্ল্যাটফর্ম 'ট্রুথ সোশ্যাল'-এ পোস্ট করা এক ভিডিও বার্তায় বলেছেন, সম্প্রতি কলোরাডোর বোল্ডারে যে কথিত সন্ত্রাসী হামলা হয়েছে, তা 'যথাযথভাবে যাচাই না করা বিদেশিদের' কারণে সৃষ্ট 'চরম বিপদের' বিষয়টি আবারও সামনে এনেছে।
গত রোববার কলোরাডোতে ইসরায়েলি জিম্মিদের সমর্থনে আয়োজিত এক সমাবেশে এক ব্যক্তি দুটি দাহ্য বিস্ফোরক ছুড়ে মারেন এবং একটি অস্থায়ী ফ্লেমথ্রোয়ার ব্যবহার করে হামলা চালান। এতে অন্তত ১২ জন আহত হন।
ওই হামলার জন্য অভিযুক্ত ব্যক্তি একজন মিশরীয় নাগরিক বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। তবে নিষিদ্ধ দেশের তালিকায় মিশরের নাম নেই।
উল্লেখযোগ্যভাবে, মিশরের প্রেসিডেন্ট আবদেল ফাত্তাহ আল-সিসির সঙ্গে ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। অতীতে ট্রাম্প তাকে 'আমার প্রিয় স্বৈরশাসক' বলেও উল্লেখ করেছিলেন।
কোন কোন ক্ষেত্রে ছাড় দেওয়া হবে?
নিষেধাজ্ঞার আওতায় থাকা দেশগুলোর কিছু নাগরিকের জন্য কিছু নির্দিষ্ট ছাড়ের ভিত্তিতে এখনো যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের সুযোগ থাকছে। এই ছাড়গুলো নিম্নরূপ—
- যারা বড়মাপের ক্রীড়া ইভেন্ট, যেমন ২০২৬ সালের বিশ্বকাপ বা ২০২৮ সালের অলিম্পিক গেমসে অংশ নিতে যুক্তরাষ্ট্রে যাচ্ছেন, তাদের ভিসা দেওয়া হতে পারে।
- 'ইরানে জাতিগত ও ধর্মীয় নিপীড়নের শিকার' সংখ্যালঘুদের জন্য ইস্যু করা অভিবাসী ভিসাধারীরা এই নিষেধাজ্ঞার আওতামুক্ত থাকবেন।
- আফগানিস্তানের বিশেষ অভিবাসী ভিসাধারীরাও এই নিষেধাজ্ঞার বাইরে থাকবেন।
- যুক্তরাষ্ট্রের 'আইনগত স্থায়ী বাসিন্দা' হিসেবে যারা স্বীকৃত, তাদের ওপর এ নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হবে না।
- যেসব দ্বৈত নাগরিকের একটি নাগরিকত্ব নিষেধাজ্ঞায় অন্তর্ভুক্ত নয়, তারা নিষেধাজ্ঞার আওতায় পড়বেন না।
এছাড়া, যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী 'জাতীয় স্বার্থে' প্রয়োজন মনে করলে, 'ব্যক্তিগত পর্যায়ে' বিশেষ বিবেচনায় কাউকে এই নিষেধাজ্ঞা থেকে ছাড় দেওয়ার ক্ষমতা রাখেন।
ট্রাম্পের নিষেধাজ্ঞা: দেশ-বিদেশে তীব্র প্রতিক্রিয়া
ট্রাম্পের সর্বশেষ নিষেধাজ্ঞা, যেটি আইনি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে, ইতোমধ্যে দেশ-বিদেশে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে।
সোমালিয়া নিরাপত্তা ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কাজ করার আশ্বাস দিয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত সোমালির রাষ্ট্রদূত দাহির হাসান আবদি এক বিবৃতিতে জানান, তার দেশ 'যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দীর্ঘদিনের সম্পর্ককে গুরুত্ব দেয়।'
ভেনেজুয়েলার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী দিয়োসদাদো কাবেইয়ো হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেন, 'যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান এখন শুধু ভেনেজুয়েলানদের জন্য নয়, বরং সবার জন্যই এক বড় ঝুঁকি।'
এ নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে ডেমোক্র্যাট নেতারা দ্রুত প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন।
ওয়াশিংটনের ডেমোক্র্যাট কংগ্রেসওম্যান প্রমিলা জয়পাল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লিখেছেন, 'প্রথম মেয়াদের মুসলিম নিষেধাজ্ঞা সম্প্রসারণ করে যে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, তা কেবল আমাদের বিশ্বমঞ্চে আরও একঘরে করে ফেলবে।'
আরেক ডেমোক্র্যাট ও কংগ্রেসম্যান ডন বেয়ার বলেন, ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা আদর্শের সঙ্গে 'বিশ্বাসঘাতকতা' করেছেন।
মানবাধিকার সংস্থাগুলোও এই নিষেধাজ্ঞার সমালোচনা করেছে।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ইউএসএ একে 'বৈষম্যমূলক, বর্ণবাদী ও নির্মম' বলে মন্তব্য করেছে।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ফার্স্ট বলেছে, এটি প্রেসিডেন্টের নেওয়া 'আরেকটি অভিবাসনবিরোধী ও দমনমূলক পদক্ষেপ।'
গতবার কী ঘটেছিল?
২০১৭ সালে প্রথম মেয়াদে ডোনাল্ড ট্রাম্প তার প্রথম ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞার আদেশ জারি করেছিলেন।
তৎকালীন আদেশে ইরান, লিবিয়া ও সোমালিয়াসহ কয়েকটি দেশকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল, যেগুলোর মধ্যে কিছু দেশের নাম তার সাম্প্রতিক নির্দেশনাতেও রয়েছে।
সমালোচকেরা একে 'মুসলিম নিষেধাজ্ঞা' বলে অভিহিত করেছিলেন, কারণ প্রাথমিকভাবে তালিকাভুক্ত সাতটি দেশই ছিল মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ। এই আদেশ যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে আদালতগুলোতে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে।
পরে হোয়াইট হাউজ ওই নীতিতে পরিবর্তন আনে এবং শেষ পর্যন্ত দুটি অমুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ—উত্তর কোরিয়া ও ভেনেজুয়েলাকে—তালিকাভুক্ত করে।
২০১৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আদালত এই নিষেধাজ্ঞাকে বৈধতা দেয়।
এরপর প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেওয়া জো বাইডেন ২০২১ সালে নিষেধাজ্ঞাটি বাতিল করেন। তিনি একে 'জাতীয় বিবেকের জন্য একটি কলঙ্ক' বলে আখ্যা দেন।