দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট রামাফোসার কাছে ‘শ্বেতাঙ্গ গণহত্যা’র মিথ্যা অভিযোগ ট্রাম্পের

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বুধবার (২১ মে) হোয়াইট হাউজে দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট সিরিল রামাফোসাকে এক উত্তেজনাপূর্ণ বৈঠকে 'শ্বেতাঙ্গ গণহত্যা' ও 'ভূমি দখলের' মতো বিভ্রান্তিকর ও মিথ্যা অভিযোগে অভিযুক্ত করেন। সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, এই বৈঠকটি ছিল চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কিকে ট্রাম্পের আচমকা জিজ্ঞাসাবাদের পুনরাবৃত্তি।
দক্ষিণ আফ্রিকা বিশ্বের অন্যতম হত্যা প্রবণ দেশ। তবে অধিকাংশ সহিংসতার শিকার হন কৃষ্ণাঙ্গ নাগরিকরা।
রামাফোসা আশা করেছিলেন, বৈঠকটি হবে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তার দেশের সম্পর্ক পুনঃস্থাপনের সুযোগ। এর আগে ট্রাম্প দক্ষিণ আফ্রিকার জন্য গুরুত্বপূর্ণ সহায়তা বাতিল করেন, শ্বেতাঙ্গ আফ্রিকানারদের [মূলত দক্ষিণ আফ্রিকায় বসবাসকারী ডাচ, জার্মান ও ফরাসি বংশোদ্ভূত শ্বেতাঙ্গ জনগোষ্ঠী] আশ্রয় দেন, দক্ষিণ আফ্রিকার রাষ্ট্রদূতকে বহিষ্কার করেন এবং ইসরায়েলের বিরুদ্ধে 'গণহত্যা'র মামলার সমালোচনা করেন।
ট্রাম্পের প্রতিক্রিয়া নিয়ে শঙ্কায় রামাফোসা প্রস্তুতি নিয়েই হোয়াইট হাউজে পৌঁছান। তার প্রতিনিধিদলে জনপ্রিয় শ্বেতাঙ্গ দক্ষিণ আফ্রিকান গলফাররাও ছিলেন। তিনি জানান, আলোচনার মূল বিষয় হবে বাণিজ্য। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র দক্ষিণ আফ্রিকার দ্বিতীয় বৃহত্তম বাণিজ্যিক অংশীদার। তবে ট্রাম্পের স্থগিত রাখা আমদানি শুল্কের আওতায় দেশটি ৩০ শতাংশ শুল্কের মুখে রয়েছে।
তবে বৈঠক শুরু হতেই ট্রাম্প এক পরিকল্পিত অভিযানের অংশ হিসেবেই যেন দক্ষিণ আফ্রিকায় শ্বেতাঙ্গদের ওপর 'অবিচার' নিয়ে একের পর এক অভিযোগ তোলেন। তিনি একটি ভিডিও দেখান এবং ছাপা সংবাদ প্রতিবেদন তুলে ধরেন, যেগুলোকে নিজের দাবির পক্ষে প্রমাণ হিসেবে উপস্থাপন করেন।
তার অনুরোধে ঘরের আলো কমিয়ে দেওয়া হয়। সাধারণত ওভাল অফিসে ব্যবহৃত না হওয়া একটি টেলিভিশনে ভিডিওটি চালানো হয়। সেখানে দেখা যায় সাদা রঙের ক্রসচিহ্ন—যা ট্রাম্প দাবি করেন, নিহত শ্বেতাঙ্গদের কবর। পাশাপাশি কয়েকজন বিরোধী নেতার উসকানিমূলক বক্তব্য। এর মধ্যে ট্রাম্প জুলিয়াস মালেমার নাম উল্লেখ করে বলেন, তাকে গ্রেপ্তার করা উচিত।
ভিডিওটি ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরের এক বিক্ষোভে ধারণ করা হয়েছিল। তার এক সপ্তাহ আগে একটি খামারে দুইজন নিহত হন। ভিডিওতে দেখা ক্রসগুলো বাস্তব কবর নয়; বরং নিহত কৃষকদের প্রতীকী চিহ্ন, বলে জানিয়েছিলেন এক আন্দোলন সংগঠক।
'অনেকে মনে করেন, তারা নিপীড়নের শিকার, এবং যুক্তরাষ্ট্রে আশ্রয় চান,' বলেন ট্রাম্প। 'আমরা বহু দেশ থেকেই মানুষকে গ্রহণ করি, যদি দেখি সেখানে নিপীড়ন বা গণহত্যা হচ্ছে।' তিনি এই মন্তব্য বিশেষভাবে শ্বেতাঙ্গ কৃষকদের প্রসঙ্গে করেন।
'মানুষ দক্ষিণ আফ্রিকা ছেড়ে পালাচ্ছেন নিরাপত্তার জন্য। জমি দখল করা হচ্ছে, কেউ কেউ খুনও হচ্ছেন,' বলেন ট্রাম্প। এ বক্তব্য এক চরম ডানপন্থী ষড়যন্ত্র তত্ত্বের প্রতিধ্বনি, যা বহু বছর ধরে আন্তর্জাতিক ফার-রাইট চ্যাটরুমে ঘুরছে। ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠ মিত্র, দক্ষিণ আফ্রিকায় জন্ম নেওয়া ইলন মাস্কও এর সমর্থক। তিনি সেদিন ওভাল অফিসে উপস্থিত ছিলেন।
তবে দক্ষিণ আফ্রিকা ট্রাম্পের অভিযোগ সরাসরি প্রত্যাখ্যান করেছে। দীর্ঘ উপনিবেশ ও বর্ণবাদ-শাসনের ইতিহাস পেছনে ফেলে দেশটি ১৯৯৪ সালে নেলসন ম্যান্ডেলার নেতৃত্বে বহুদলীয় গণতন্ত্রে প্রবেশ করে।
সম্প্রতি পাস হওয়া নতুন ভূমি সংস্কার আইনে বলা হয়েছে, জনস্বার্থে প্রয়োজনে ক্ষতিপূরণ ছাড়াই জমি অধিগ্রহণ করা যেতে পারে। তবে এখনো এমন কোনো অধিগ্রহণ ঘটেনি, এবং তা আদালতে চ্যালেঞ্জ করা সম্ভব।
২০২৪ সালে দক্ষিণ আফ্রিকায় পুলিশ রেকর্ড অনুযায়ী ২৬,২৩২টি খুনের ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে কৃষিভিত্তিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মাত্র ৪৪টি, যার মধ্যে ৮ জন ছিলেন কৃষক।
রামাফোসা ট্রাম্পের পাশে শান্তভাবে বসে এসব অভিযোগ শুনছিলেন এবং শেষে দৃঢ়ভাবে উত্তর দেন। তিনি বলেন, 'যদি আফ্রিকানার কৃষকদের ওপর গণহত্যা চলত, তাহলে এই তিনজন ভদ্রলোক এখানে উপস্থিত থাকতেন না।' তিনি তখন উপস্থিত শ্বেতাঙ্গ গলফার আর্নি এলস, রেটিফ গুসেন এবং ধনকুবের জোহান রুপার্টের দিকে ইঙ্গিত করেন।
তাতেও ট্রাম্প সন্তুষ্ট হননি।
তিনি বলেন, 'আমাদের কাছে হাজার হাজার প্রতিবেদন আছে, ডকুমেন্টারি আছে, খবরের কাগজে আছে—এই বিষয়ে জবাব দিতেই হবে।'
'কোনো গণহত্যা চলছে না'
ভিডিও প্রদর্শনের সময় রামাফোসা বেশিরভাগ সময় নির্লিপ্ত ছিলেন। মাঝে মাঝে পর্দার দিকে তাকাচ্ছিলেন। তিনি বলেন, এই ভিডিও আগে কখনও দেখেননি এবং এর অবস্থান কোথায় জানতে চান।
ট্রাম্প পরে কয়েকটি ছাপা প্রতিবেদন তুলে ধরেন, যেগুলোতে তার ভাষ্য অনুযায়ী শ্বেতাঙ্গদের হত্যার ঘটনা উল্লেখ ছিল। তিনি প্রতিটি পৃষ্ঠা উল্টাতে উল্টাতে বলছিলেন, 'মৃত্যু, মৃত্যু।' শেষে প্রতিবেদনগুলো রামাফোসার হাতে তুলে দেন।
জবাবে রামাফোসা স্বীকার করেন, দক্ষিণ আফ্রিকায় অপরাধ রয়েছে এবং বেশিরভাগ ভুক্তভোগীই কৃষ্ণাঙ্গ। ট্রাম্প তখন তাকে থামিয়ে বলেন, 'কিন্তু চাষিরা তো কৃষ্ণাঙ্গ নয়।'
রামাফোসা শান্ত স্বরে বলেন, 'এই উদ্বেগ নিয়ে আমরা আপনার সঙ্গে আলোচনা করতে প্রস্তুত।'
তিনি নেলসন ম্যান্ডেলার শান্তির আদর্শের কথা বলেন। তবে ট্রাম্প, যার সমর্থকদের মধ্যে শ্বেতাঙ্গ জাতীয়তাবাদীরাও রয়েছেন, তা আমলে নেননি। তথাকথিত শ্বেতাঙ্গ গণহত্যার মিথ এখন যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের নানা প্রান্তে ডানপন্থীদের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে।
ট্রাম্প বলেন, 'আমি বলব, বর্ণবাদী শাসন ছিল ভয়াবহ। এখনকার অবস্থা যেন তার সম্পূর্ণ বিপরীত।'
ওভাল অফিসে ট্রাম্প ও ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্সের সঙ্গে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কির ঘটনার মাত্র তিন মাস পর এমন এক অভূতপূর্ব বৈঠকের মুখোমুখি হন রামাফোসা। এ অভিজ্ঞতা ভবিষ্যতে ট্রাম্পের আমন্ত্রণ গ্রহণের আগে অনেক রাষ্ট্রপ্রধানকে দ্বিধায় ফেলতে পারে।
তবে ইউক্রেনীয় প্রেসিডেন্টের মতো পাল্টাপাল্টি কথা না বলে কিংবা আগেভাগে বৈঠক ছেড়ে না গিয়ে রামাফোসা ছিলেন শান্ত ও সংযত। তিনি ট্রাম্পের ওভাল অফিসের সোনালি সাজসজ্জার প্রশংসা করেন এবং জানান, তিনি আগামী বছর জি-২০-এর সভাপতিত্ব হস্তান্তরের অপেক্ষায় আছেন।
দক্ষিণ আফ্রিকায় অনুষ্ঠেয় নভেম্বরের জি-২০ সম্মেলনে ট্রাম্প অংশ নেবেন কি না—এই প্রশ্নে তিনি কোনো প্রতিশ্রুতি দেননি।
পরে ব্যবসায়ী জোহান রুপার্ট আলোচনায় হস্তক্ষেপ করেন রামাফোসাকে সমর্থন দিতে। তিনি বলেন, দক্ষিণ আফ্রিকায় অপরাধ সত্যিই বড় সমস্যা এবং বহু কৃষ্ণাঙ্গ মানুষ এতে প্রাণ হারাচ্ছেন।
বৈঠক শেষে রামাফোসা বাণিজ্য ইস্যুতেই মনোযোগ দেন। তিনি জানান, গুরুত্বপূর্ণ খনিজসম্পদ নিয়ে দুই দেশের মধ্যে আলোচনা হয়েছে। তার বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, যুক্তরাষ্ট্র থেকে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস কেনা এবং একটি বাণিজ্য ও বিনিয়োগ প্রস্তাব যুক্তরাষ্ট্রের কাছে জমা দেওয়া হয়েছে।
তবে ট্রাম্পের 'জাতিগত সহিংসতার বিস্তার' সংক্রান্ত অভিযোগ সরাসরি প্রত্যাখ্যান করে রামাফোসা বলেন, 'দক্ষিণ আফ্রিকায় কোনো গণহত্যা চলছে না।'