আন্তর্জাতিক বুকার পুরস্কার পেয়ে ইতিহাস গড়লেন ভারতের বানু মুশতাক

ছোটগল্প সংকলন 'হার্ট ল্যাম্প'-এর জন্য আন্তর্জাতিক বুকার পুরস্কার পেয়েছেন ভারতী লেখক, আইনজীবী ও অধিকারকর্মী বানু মুশতাক। খবর বিবিসির।
এই প্রথম কন্নড় ভাষায় লেখা কোনো বই এই মর্যাদাপূর্ণ আন্তর্জাতিক পুরস্কার পেলো।
হার্ট ল্যাম্প-এ থাকা গল্পগুলো ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন দীপা ভাস্তি।
১৯৯০ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ তিন দশকে লেখা মোট ১২টি ছোটগল্পের এই সংকলনটিতে, দক্ষিণ ভারতে বসবাসকারী মুসলিম নারীদের জীবনের সংগ্রাম ও দুঃখ-কষ্ট অত্যন্ত সংবেদনশীলভাবে তুলে ধরা হয়েছে।
২০২২ সালে গীতাঞ্জলি শ্রী'র লেখা 'টোম্ব অব স্যান্ড' হিন্দি থেকে অনুবাদ করেছিলেন ডেইজি রকওয়েল। এটি সে বছর আন্তর্জাতিক বুকার পুরস্কার জিতেছিল। ২০২২ সালের পর আরেক ভারতীয় বানু মুশতাক এ পুরস্কারে ভূষিত হলেন।
সাহিত্যপ্রেমীদের মধ্যে তার কাজ ইতোমধ্যেই সুপরিচিত ছিল, তবে আন্তর্জাতিক বুকার জয়ের পর তার জীবন ও সাহিত্যকর্ম নিয়ে আলোচনার পরিসর অনেক বড় হয়েছে। তার লেখায় যেসব নারী চরিত্রের সংগ্রাম তুলে ধরা হয়েছে, সেগুলো অনেকাংশেই তার নিজের জীবনের বাস্তবতার প্রতিফলন।
এই আত্মজ্ঞানই সম্ভবত মুশতাককে সবচেয়ে সূক্ষ্ম ও জটিল চরিত্র এবং কাহিনি নির্মাণে সহায়তা করেছে।
বইটি সম্পর্কে ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস পত্রিকার এক পর্যালোচনায় বলা হয়েছে, 'এমন সাহিত্য সংস্কৃতিতে যেখানে শুধু চমকপ্রদ উপস্থাপনাকে পুরস্কৃত করা হয়, সেখানে 'হার্ট ল্যাম্প' গুরুত্ব দেয়−সীমান্তে বাস করা জীবনগুলোর প্রতি, অদৃশ্য থেকে যাওয়া সিদ্ধান্তগুলোর প্রতি এবং শুধু টিকে থাকার জন্য যে শক্তির প্রয়োজন, তার প্রতি। এটাই বানু মুশতাকের নিঃশব্দ শক্তি।'
মুশতাক বেড়ে উঠেছেন কর্ণাটকের একটি ছোট শহরের মুসলিম পাড়ায়। তার আশপাশের অন্যান্য মেয়েদের মতো তিনিও স্কুলে উর্দু ভাষায় কোরআন পড়তেন।
তবে তার সরকারি কর্মচারী বাবা তার জন্য আরও কিছু চেয়েছিলেন। আট বছর বয়সে তিনি মুশতাককে ভর্তি করিয়ে দেন একটি কনভেন্ট স্কুলে, যেখানে শিক্ষার মাধ্যম ছিল রাজ্যের সরকারি ভাষা—কন্নড়।
কন্নড় ভাষাটি শুরুতে মুশতাকের জন্য একেবারেই অপরিচিত ছিল, কিন্তু তিনি কঠোর পরিশ্রম করে ভাষাটিতে দক্ষতা অর্জন করেন—আর এটাই হয়ে ওঠে তার সাহিত্যিক অভিব্যক্তির মাধ্যম।
তিনি স্কুলে পড়াকালীনই লেখা শুরু করেন। সেসময় তার সহপাঠীরা বিয়ে করে সংসার শুরু করছিল, তখন তিনি কলেজে পড়ার সিদ্ধান্ত নেন।
তার লেখা প্রকাশিত হতে বেশ কয়েক বছর লেগে যায়, আর তা ঘটে তার জীবনের এক চ্যালেঞ্জিং সময়ে।
২৬ বছর বয়সে নিজের পছন্দের মানুষকে বিয়ে করার এক বছর পর, তার একটি ছোটগল্প স্থানীয় একটি ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয়। তবে বিবাহিত জীবনের শুরুটা খুব সহজ ছিল না—সংঘাত ও টানাপোড়েনে ভরা সেই সময়ের কথা তিনি একাধিক সাক্ষাৎকারে খোলামেলাভাবেই বলেছেন।
ভোগ ম্যাগাজিনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে মুশতাক বলেন, 'আমি সবসময়ই লিখতে চেয়েছিলাম, কিন্তু লেখার মতো কিছু ছিল না। কারণ হঠাৎ প্রেম করে বিয়ের পর আমাকে বোরকা পরতে বলা হয় এবং গৃহস্থালির কাজেই নিজেকে উৎসর্গ করতে বলা হয়। ২৯ বছর বয়সে মা হওয়ার পর আমি পোস্টপার্টাম ডিপ্রেশনে ভুগছিলাম।'
দ্য উইক ম্যাগাজিনকে দেওয়া আরেক সাক্ষাৎকারে তাকে কীভাবে চার দেয়ালের মধ্যে আবদ্ধ এক জীবনযাপন করতে বাধ্য করা হয়েছিল, তা বলেছিলেন।
এরপর একটি চমকপ্রদ ও সাহসী প্রতিরোধ তাকে সেই বন্দিদশা থেকে মুক্ত করে।
ম্যাগাজিনকে বলেন মুশতাক বলেন, 'একবার, চরম হতাশার মুহূর্তে, আমি নিজের গায়ে পেট্রোল ঢেলে আগুন ধরিয়ে আত্মহত্যা করতে চেয়েছিলাম। ভাগ্যক্রমে, আমার স্বামী সময়মতো টের পেয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরে দেশলাইটা কেড়ে নেয়। সে আমার পায়ে আমাদের সন্তানকে রেখে অনুনয় করে বলেছিল, "আমাদের ফেলে চলে যেও না"।'
হার্ট ল্যাম্প-এ তার নারী চরিত্রগুলোও এই প্রতিরোধ আর সহিষ্ণুতার প্রতিচ্ছবি।
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস-এর এক পর্যালোচনায় বলা হয়েছে, 'প্রধানধারার ভারতীয় সাহিত্যে মুসলিম নারীদের প্রায়ই একমাত্রিক রূপে তুলে ধরা হয়—নিঃশব্দ ভোগান্তির প্রতীক হিসেবে, অথবা অন্য কারও নৈতিক তর্কের অনুষঙ্গ হিসেবে। মুশতাক এই দুই পথই প্রত্যাখ্যান করেন। তার চরিত্রগুলো সহ্য করে, দরকষাকষি করে এবং মাঝে মাঝে প্রতিরোধও গড়ে তোলে। সেটা হয়ত খবরের শিরোনাম হয় না, কিন্তু তাদের জীবনে তা গভীরভাবে প্রাসঙ্গিক।'
মুশতাক একটি স্বনামধন্য স্থানীয় ট্যাবলয়েডে রিপোর্টার হিসেবে কাজ করেন এবং বান্দায়া আন্দোলনের সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন তিনি।
প্রায় এক দশক সাংবাদিকতা করার পর তিনি সেই পেশা ছেড়ে পরিবারের পাশে দাঁড়ানোর জন্য আইনজীবী হিসেবে কাজ শুরু করেন।
বহু দশকজুড়ে বিস্তৃত তার কর্মজীবনে তিনি প্রচুর লিখেছেন—প্রকাশিত হয়েছে ছয়টি ছোটগল্প সংকলন, একটি প্রবন্ধ সংকলন এবং একটি উপন্যাস।
তবে তার এই তীক্ষ্ণ ও অকপট লেখনী তার বিরুদ্ধে ঘৃণা ও বিরোধিতাও তৈরি করেছে।
দ্য হিন্দু পত্রিকাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে মুশতাক বলেন, ২০০০ সালে তিনি যখন মসজিদে নারীদের নামাজ পড়ার অধিকার নিয়ে মত প্রকাশ করেন, তখন তাকে ফোন করে বিভিন্ন হুমকি দেওয়া হয়।
তার বিরুদ্ধে একটি ফতোয়া জারি করা হয় এবং এক ব্যক্তি ছুরি হাতে হামলার চেষ্টা করেন, তবে তার স্বামী তাকে প্রতিহত করেন।
তবে এসব ঘটনা মুশতাককে দমিয়ে রাখতে পারেনি—তিনি তার লেখায় অকুণ্ঠ সাহসিকতা বজায় রেখেছেন।
দ্য উইক ম্যাগাজিনকে তিনি বলেন, 'আমি ধারাবাহিকভাবে ধর্মীয় পুরুষতান্ত্রিক ব্যাখ্যাকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে এসেছি। এই বিষয়গুলো এখনও আমার লেখার কেন্দ্রে রয়েছে। সমাজ অনেক বদলেছে, কিন্তু মূল সমস্যাগুলো রয়েই গেছে। প্রেক্ষাপট বদলালেও, নারী ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মৌলিক লড়াই আজও চলছেই।'
বছরের পর বছর ধরে মুশতাকের লেখালেখি তাকে স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ে বহু সম্মানজনক পুরস্কার এনে দিয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে কর্ণাটক সাহিত্য একাডেমি পুরস্কার এবং দানা চিন্তামণি আত্তিমাব্বে পুরস্কার রয়েছে।
২০২৪ সালে, তার ১৯৯০ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে প্রকাশিত পাঁচটি ছোটগল্প সংকলনের ইংরেজি অনুবাদ সংকলন হাসিনা অ্যান্ড আদার স্টোরিজ নামে প্রকাশিত হয় এবং বইটি পিইএন ট্রান্সলেশন পুরস্কার অর্জন করে।