ভারত-পাকিস্তান সংঘাত: ২৫ ড্রোন ধ্বংসের দাবি পাকিস্তানের, পালটা হামলার চেষ্টা প্রতিহতের দাবি ভারতের

পারমাণবিক শক্তিধর প্রতিবেশী দুই দেশের মধ্যে সংঘাত ছড়িয়ে পড়ার প্রেক্ষাপটে পাকিস্তান বলেছে, তারা ২৫টি ভারতীয় ড্রোন তাদের আকাশসীমায় ভূপাতিত করেছে। অন্যদিকে ভারত বলছে, পাকিস্তান ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে যেসব সামরিক স্থাপনায় হামলার চেষ্টা চালিয়েছিল, তা তারা সফলভাবে প্রতিহত করেছে।
এই ঘটনার আগের দিন ভারত দাবি করে, বুধবার ভোরে তারা 'পাকিস্তানের সন্ত্রাসবাদী' অবকাঠামোতে হামলা চালিয়েছে। তার দুই সপ্তাহ আগে কাশ্মীরের হামলায় পাকিস্তানের সম্পৃক্ততা আছে বলে অভিযোগ করেছিল ভারত। ওই হামলায় ২৬ জন ভারতীয় পর্যটক নিহত হয়েছিলেন, যাদের বেশিরভাগ ছিলেন হিন্দু।
ইসলামাবাদ এই অভিযোগ অস্বীকার করে এবং ক্ষেপণাস্ত্র হামলার পাল্টা জবাব দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়। একইসঙ্গে তারা বলেছে, পাকিস্তান পাঁচটি ভারতীয় যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করেছে। তবে বেইজিংয়ে অবস্থিত ভারতীয় দূতাবাস এই যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করার খবরকে 'ভুল তথ্য' বলে উল্লেখ করেছে।
পাকিস্তানের সামরিক মুখপাত্র আহমেদ শরীফ চৌধুরী বলেন, ভারত থেকে পাঠানো ইসরায়েল নির্মিত ২৫টি ড্রোন তারা ভূপাতিত করেছে। যেসব অঞ্চলে এ ঘটনা ঘটে, তার মধ্যে রয়েছে পাকিস্তানের দুটি বড় শহর করাচি ও লাহোর।
তিনি আরও জানান, এসব অঞ্চল থেকে ড্রোনের ধ্বংসাবশেষ সংগ্রহ করা হচ্ছে। তিনি জানান, রাওয়ালপিন্ডি শহরের ওপরেও একটি ড্রোন ভূপাতিত করা হয়েছে। এই শহরেই পাকিস্তান সেনাবাহিনীর উচ্চ নিরাপত্তা সম্পন্ন সদর দপ্তর অবস্থিত।
তিনি বলেন, একটি ড্রোন লাহোরের কাছে একটি সামরিক স্থাপনায় আঘাত হানে এবং এতে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর চারজন সদস্য আহত হন।
তিনি আরও জানান, 'ভারতীয় ড্রোন বারবার পাকিস্তানের আকাশসীমায় প্রবেশ করছে… এই নগ্ন আগ্রাসনের জন্য ভারতকে চড়া মূল্য দিতে হবে।'
ভারতের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, বুধবার রাত থেকে বৃহস্পতিবার ভোর পর্যন্ত পাকিস্তান উত্তর ও পশ্চিম ভারতের একাধিক সামরিক স্থাপনায় ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলার চেষ্টা করে। তবে ভারতীয় বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা তা সফলভাবে 'প্রতিহত' করতে পেরেছে।
পাল্টা জবাবে বৃহস্পতিবার ভারতীয় বাহিনী পাকিস্তানের বিভিন্ন এলাকায় বিমান প্রতিরক্ষা রাডার এবং সিস্টেম লক্ষ্য করে হামলা চালায়। বিবৃতিতে বলা হয়, 'পাকিস্তান যেভাবে আগ্রাসন চালিয়েছে, ভারতও একই মাত্রা ও পরিসরে তার জবাব দিয়েছে।'
এছাড়া পাকিস্তান কাশ্মীরের নিয়ন্ত্রণরেখা বরাবর গোলাগুলির মাত্রা বাড়িয়েছে। এতে ভারতের অন্তত ১৬ জন নিহত হন, যাদের মধ্যে পাঁচজন শিশু ও তিনজন নারী রয়েছেন।
ভারত ও পাকিস্তানের সম্পর্ক ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসন থেকে স্বাধীনতা লাভের পর থেকেই উত্তেজনায় ভরা। দেশদুটি তিনটি যুদ্ধ করেছে, যার মধ্যে দুটি হয়েছে কাশ্মীর ইস্যু নিয়ে, আর সীমান্তে সংঘর্ষ ঘটেছে অগণিতবার।
দুই দেশই ১৯৯০-এর দশকে পারমাণবিক শক্তির অধিকারী হয়।
ড্রোন হামলার খবরে পাকিস্তানের প্রধান শেয়ার সূচক ৬.৩ শতাংশ হ্রাস পায়। ভারতীয় প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের বিবৃতির পর ভারতের শেয়ারবাজার, রুপি ও বন্ডের দামও বিকেলের দিকে উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যায়।
ভারতের সতর্কবার্তা
পাকিস্তানের দাবি, বুধবারের হামলা ও এর পরবর্তী কাশ্মীর সীমান্তবর্তী গোলাগুলিতে তাদের অন্তত ৩১ জন বেসামরিক নাগরিক নিহত এবং প্রায় ৫০ জন আহত হয়েছে। অন্যদিকে, ভারতের পক্ষ থেকে বলা হয় ১৩ জন ভারতীয় বেসামরিক নাগরিক নিহত এবং ৫৯ জন আহত হয়েছেন।
বৃহস্পতিবার নয়াদিল্লিতে রাজনৈতিক দলগুলোর এক বৈঠকে ভারত সরকারের মন্ত্রীরা দাবি করেন, পাকিস্তানে চালানো হামলায় '১০০-র বেশি সন্ত্রাসী নিহত হয়েছে' এবং নিহতের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে বলে সরকারিভাবে ধারণা করা হচ্ছে।
পাকিস্তান সীমান্তের কাছাকাছি অবস্থানের কারণে কাশ্মীরের গুলমার্গে অবস্থিত জনপ্রিয় পর্যটন আকর্ষণ ক্যাবল কার বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। সেখানে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন হোটেল ব্যবস্থাপক জানান—বুধবার রাতে পুলিশ তাদের হোটেল খালি করে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে।
স্থানীয় গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়েছে, পাকিস্তানের পাল্টা হামলার আশঙ্কায় ভারতের পাঞ্জাব রাজ্যের কিছু শহরে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মজুদ শুরু করেছেন মানুষজন।
পাকিস্তানের বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ লাহোর, করাচি এবং উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় শহর সিয়ালকোটের বিমানবন্দরে সাময়িকভাবে দুপুর পর্যন্ত ফ্লাইট চালনা স্থগিত করেছে। তবে তারা এই স্থগিতাদেশের কোনো কারণ উল্লেখ করেনি।
যদিও পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার ভারতের হামলার জবাব দেওয়ার অঙ্গীকার করেছে, দেশটির প্রতিরক্ষামন্ত্রী খাজা মুহাম্মদ আসিফ বুধবার দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস-কে বলেন, পাকিস্তান উত্তেজনা নিরসনে প্রস্তুত রয়েছে।
ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুব্রামণ্যম জয়শঙ্কর ভারত-ইরান যৌথ কমিশনের বৈঠকে জানিয়েছেন, নয়াদিল্লি এমন পরিস্থিতি বাড়িয়ে তোলার কোনো ইচ্ছা রাখে না। তবে তিনি এও বলেন, 'আমাদের বিরুদ্ধে সামরিক হামলা হলে, তার অত্যন্ত কঠোর পালটা জবাবও আমরা দেব।'
এই প্রেক্ষাপটে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বুধবার বলেন, তিনি আশা করছেন ভারত ও পাকিস্তান নিজেদের মধ্যে সমঝোতায় পৌঁছাতে পারবে। তিনি আরও বলেন, 'যদি আমি কোনোভাবে সাহায্য করতে পারি, তাহলে আমি পাশে থাকব।'
চীন উভয় দেশকে শান্তি ও স্থিতিশীলতার বৃহত্তর স্বার্থে দায়িত্বশীল আচরণ করার আহ্বান জানিয়েছে। চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র বলেন, বেইজিং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে একযোগে কাজ করতে প্রস্তুত, যাতে এমন কোনো পদক্ষেপ না নেওয়া হয় যা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তোলে।
রাশিয়া এবং যুক্তরাষ্ট্রও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য দুই দেশকে সংযম প্রদর্শনের আহ্বান জানিয়েছে।
এই উত্তেজনা এমন এক সময়ে তৈরি হয়েছে, যখন পাকিস্তানের ৩৫০ বিলিয়ন ডলারের অর্থনীতির অবস্থা কিছুটা নাজুক। ২০২৩ সালে দেশটি আন্তর্জাতিক ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হওয়ার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গিয়েছিল। পরে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল থেকে জরুরি সহায়তা পাওয়ার মাধ্যমে সেই সংকট সাময়িকভাবে মোকাবিলা করা হয়।