যুদ্ধক্ষেত্রের বাইরেও পাকিস্তানকে চাপে ফেলতে আর যে যে পদক্ষেপ নিয়েছে ভারত

গত মাসে কাশ্মীরে সন্ত্রাসী হামলার প্রতিশোধ নিতে ভারত একদিকে যেমন পাকিস্তানের ওপর সামরিক হামলা চালানোর প্রস্তুতি নিয়েছে, আরেকদিকে রক্তপাতহীন, সূক্ষ্ম ও কৌশলগত আরও কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। এসব পদক্ষেপের মূল লক্ষ্য ছিল পাকিস্তানের অর্থনৈতিক দুর্বলতা।
আগামীকাল শুক্রবার (৯ মে) যুক্তরাষ্ট্রের হোয়াইট হাউস থেকে মাত্র তিন ব্লক দূরে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)-এর নির্বাহী বোর্ডের বৈঠক হওয়ার কথা।
ভারতীয় কর্মকর্তারা ইঙ্গিত দিয়েছেন, তারা সেখানে একটি নতুন দাবি উত্থাপন করতে পারেন: আইএমএফ যেন পাকিস্তানকে দেওয়া ৭ বিলিয়ন ডলারের ঋণের মেয়াদ না বাড়ায়। এই ঋণ পাকিস্তানের আর্থিক স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনা এবং সাধারণ মানুষের জন্য জরুরি সেবা চালু রাখতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হচ্ছে।
যদিও ভারতীয় কর্মকর্তারা এই বিষয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু বলেননি। তবে দেশটির সংবাদমাধ্যমের খবরে বলা হয়েছে, পাকিস্তানের জন্য অন্যান্য সম্ভাব্য সাহায্যের উৎসগুলোর ওপরও নজরে রাখছে ভারত।
পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বুধবারের হামলার দুই সপ্তাহ আগেই, পুরনো শত্রুকে বিপাকে ফেলতে নতুন নতুন উপায় খোঁজা শুরু করেছিল ভারত।
গত ২৩ এপ্রিল ভারত একতরফাভাবে একটি পানিবণ্টন চুক্তি থেকে সরে দাঁড়ায়। ১৯৬০ সালে বহু বছরের আলোচনা শেষে, বিশ্বব্যাংকের মধ্যস্থতায় সিন্ধু পানি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। এটি বিশ্বের অন্যতম স্থিতিশীল আন্তঃসীমান্ত পানি চুক্তি হিসেবে পরিচিত ছিল।
পাকিস্তান এই সিদ্ধান্তকে 'যুদ্ধ ঘোষণার সমতুল্য' বলে অভিহিত করেছে।
এমনকি পাকিস্তানের বিরুদ্ধে তথাকথিত 'সফট পাওয়ার' ব্যবহার করতেও পিছপা হয়নি ভারত।
কাশ্মীরে সন্ত্রাসী হামলার পর দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা চরমে পৌঁছার পর ভারত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পাকিস্তানি সংগীতশিল্পী ও ক্রিকেটারদের ভারতীয় দর্শক-শ্রোতাদের কাছ থেকে কার্যত বিচ্ছিন্ন করে দেয়। যেমনটা তারা ২০২০ সালে চীনের সঙ্গে সংঘর্ষের পর টিকটক নিষিদ্ধ করে করেছিল, ঠিক সেভাবে।
ভারত আরও ঘোষণা দেয়, তারা পাকিস্তানের সঙ্গে সব ধরনের বাণিজ্য বন্ধ করে দেবে। যদিও বাস্তবে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্যিক আদান-প্রদান এমনিতেই খুবই সীমিত ছিল।
ভারত থেকে মূলত চিনি, ওষুধ এবং কিছু রাসায়নিক রপ্তানি হতো পাকিস্তানে।
কয়েকজন ভারতীয় রপ্তানিকারক বলেছেন, তারা সরকার থেকে এ বিষয়ে কোনো আইনি নোটিশ পাননি, তাই আগের চুক্তি অনুযায়ী তারা এখনও পণ্য পাঠাচ্ছেন।
তবে এই উত্তেজনা শুরুর আগেও পাকিস্তান ভারতে খুবই সামান্য পণ্য রপ্তানি করত—মাত্র ২০ লাখ ডলারের মতো।
এই দুই বৈরি প্রতিবেশীর মধ্যে থাকা অর্থনৈতিক অসমতা, এখন আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে আরও স্পষ্ট।
আর্থিক চাপে ফেলার অন্যান্য পদক্ষেপগুলো মূলত পর্দার আড়ালেই ঘটছে।
স্থানীয় সংবাদমাধ্যমগুলো জানিয়েছে, ভারতীয় কর্মকর্তারা বলছেন, তারা আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ও অনুরূপ সংস্থাগুলোকে বোঝানোর চেষ্টা করছেন যেন তারা পাকিস্তানের ওপর কড়াকড়ি আরোপ করে।
নয়াদিল্লিতে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ সুধীপ্ত মুণ্ডল বলেন, 'ভারত যদি পাকিস্তানের ঋণের বিপক্ষে অবস্থান না নিত, তা-ই বরং অবাক করার মতো ব্যাপার হতো।'
সুধীপ্ত মুণ্ডল বলেন, 'এই সব প্রতিষ্ঠান দেখতে কর্পোরেট ব্যাংকের মতো হলেও, আসলে এরা খুব রাজনৈতিক চরিত্রের।'
সুধীপ্ত মুণ্ডল বর্তমানে ভারতের সেন্টার ফর ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ-এর চেয়ারম্যান।
তিনি আরও বলেন, 'একটি প্রকল্পের গুণগত মানের ভিত্তিতে ঋণ অনুমোদনের কথা থাকলেও, বাস্তবে সিদ্ধান্তটা শেষ পর্যন্ত নির্ভর করে বোর্ডের সদস্যরা কোন পক্ষের সঙ্গে আছে তার ওপর।'
সুধীপ্ত মুণ্ডল স্মরণ করেন, ১৯৯৮ সালে ভারতের পারমাণবিক বোমার পরীক্ষার পর, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক ভারতের জন্য আগে থেকে অনুমোদিত একটি ঋণ বাতিল করেছিল। কারণ সেসময় যুক্তরাষ্ট্রসহ বেশিরভাগ প্রভাবশালী দেশ ভারতের এই পদক্ষেপে ক্ষুব্ধ হয়েছিল, কারণ তারা মনে করেছিল, ভারত এতে পাকিস্তানের সঙ্গে পারমাণবিক প্রতিযোগিতার সূচনা করছে।
কিন্তু আজকের দিনে সেই দেশগুলোর মনোভাব অনেকটাই ভারতের অনুকূলে। শুধু সন্ত্রাসবাদের শিকার বলেই নয়, ভারতের অর্থনীতি এখন পাকিস্তানের তুলনায় ১০ গুণ বড় এবং এর শ্রমশক্তি ও ভোক্তা বাজার চীনের বিকল্প খুঁজে বেড়ানো আন্তর্জাতিক কৌশলবিদদের কাছে বড় আকর্ষণ হয়ে উঠেছে।
তবে পাকিস্তানকে আর্থিকভাবে বিচ্ছিন্ন করার ভারতের প্রচেষ্টায় সরাসরি সায় দিতে ওয়াশিংটনভিত্তিক আর্থিক সংস্থাগুলোর কিছু দ্বিধা আছে। পাকিস্তানের অর্থনৈতিক দুর্বলতা সম্পর্কে অবগত এই সংস্থাগুলো, বহু বছর ধরে দেশটির ঋণ ও মুদ্রাব্যবস্থার স্থিতিশীলতা ফেরাতে বিভিন্ন ঋণ ও কর্মসূচি চালানোর পর, এখন আর দেশটিকে আরও গভীর অস্থিরতার দিকে ঠেলে দিতে রাজি নাও হতে পারে।
ভারতের অর্থ মন্ত্রণালয় পাকিস্তানকে ঋণ দেওয়ার বিষয়টি পুনর্বিবেচনার জন্য এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) কাছে তদবির করছে বলে যে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে, তার বিরোধিতা করেছে ভারত। তবে তারা পাকিস্তানকে বৈশ্বিক মানি লন্ডারিং ও সন্ত্রাসবিরোধী টাস্ক ফোর্সের 'ধূসর তালিকায়' ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করবে বলে যে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে, তা অস্বীকার করেনি তারা।
এই তালিকায় ফিরলে পাকিস্তানের জন্য আর্থিক সহায়তা পাওয়া কঠিন হয়ে পড়বে, আর দেশটি বহু বছর চেষ্টার পর ২০২২ সালে সেই তালিকা থেকে বাইরে বেড়িয়েছিল।
২০১৩ থেকে ২০১৫ পর্যন্ত পাকিস্তানে ভারতের হাইকমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালন করা টি. সি. এ. রাঘবন বলেছেন, '[পাকিস্তানের] 'ধূসর তালিকাভুক্তি' একটি বড় পদক্ষেপ। তবে এই সংঘাতে ভারতের সবচেয়ে কার্যকর অ-সামরিক হাতিয়ার হচ্ছে অন্যান্য দেশের সঙ্গে তার সম্পর্ক।'
রাঘবন বলেন, 'সেখানে সমীকরণ খুব, খুব নাটকীয়ভাবে বদলে গেছে।'
তিনি আরও বলেন, ''বিশেষ করে উপসাগরীয় রাজতন্ত্রগুলোর সঙ্গে, ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক, 'গত ১০-১৫ বছরে সেই সম্পর্কের অনেক পরিবর্তন হয়েছে'।''
রাঘবন ২০০৮ সালের কথা স্মরণ করে বলেন, ওই ঘটনার পর 'বেশিরভাগ দেশ খুব স্পষ্টভাবে বুঝে গেছে' ভারতের সমস্যা কোন ধরনের।
প্রসঙ্গত, সেসময় পাকিস্তানের-মদতপুষ্ট সন্ত্রাসীগোষ্ঠী লস্কর-ই-তইয়্যেবা মুম্বাই শহরে একটি সংগঠিত ও সমন্বিত সন্ত্রাসী হামলা চালিয়ে ১৬৬ জনকে হত্যা করেছিল।