লাতিন সাহিত্যের প্রবাদপুরুষ নোবেলজয়ী মারিও ভার্গাস য়োসা মারা গেছেন

লাতিন আমেরিকান সাহিত্যকে বৈশ্বিক অঙ্গনে জনপ্রিয় করার অন্যতম রূপকার, নোবেলজয়ী পেরুভিয়ান ঔপন্যাসিক মারিও ভার্গাস য়োসা ৮৯ বছর বয়সে প্রয়াত হয়েছেন।
রোববার য়োসার তিন সন্তান—আলভারো, গনসালো ও মরগানা ভার্গাস য়োসা—এক যৌথ বিবৃতিতে তার মৃত্যুর কথা জানান।
বিবৃতিতে তারা বলেন, 'লিমায়…পরিবারের প্রিয়জনদের বেষ্টনীতে, শান্তিপূর্ণভাবে তিনি আমাদের ছেড়ে গেছেন'।
তারা লিখেছেন, 'আত্মীয়, বন্ধু ও বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে থাকা অসংখ্য পাঠককে তার প্রস্থান শোকার্ত করবে। তবে আমরা আশাবাদী, তার দীর্ঘ, দুঃসাহসিক ও সার্থক জীবনের কথা ভেবে তারা কিছুটা সান্ত্বনা পাবেন, যেমনটা আমরা পাচ্ছি।'
মারিও ভার্গাস য়োসার সাহিত্যজীবন পঞ্চাশ বছরেরও বেশি সময়জুড়ে বিস্তৃত। বিতর্ক ছিল লাতিন আমেরিকান সাহিত্য ও সংস্কৃতির এই কিংবদন্তির নিত্যসঙ্গী।
৫০-এর বেশি গ্রন্থের স্রষ্টা এই সাহিত্যিক। এসব বইয়ের অনেকগুলোই নানা ভাষায় অনূদিত হয়েছে। ২০১০ সালে তিনি সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। বিচারকেরা তাকে বলেছিলেন, 'ঈশ্বরপ্রদত্ত গল্পকার'।
বর্ণময় ভাষা ও রূপক-চিত্রে কর্তৃত্ববাদ, সহিংসতা আর পুরুষতান্ত্রিকতার তীক্ষ্ণ চিত্রায়ন তাকে পরিণত করেছিল সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়া লাতিন আমেরিকান সাহিত্য আন্দোলনের উজ্জ্বল নক্ষত্রে।
প্রথমদিকে য়োসা বামপন্থি আদর্শের অনুরাগী ছিলেন। তবে ধীরে ধীরে লাতিন আমেরিকার বিপ্লবী আন্দোলনের প্রতি তার মোহভঙ্গ ঘটে। শেষতক ১৯৯০ সালে তিনি একটি মধ্য-ডানপন্থি দল থেকে পেরুর প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে অংশ নেন। যদিও জয়ী হতে পারেননি।
১৯৩৬ সালে পেরুর দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর আরেকিপায় এক মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্ম মারিও ভার্গাস য়োসার। শৈশবে তার মা-বাবার বিচ্ছেদ হলে তিনি প্রপিতামহের সঙ্গে বলিভিয়ার কোচাবাম্বায় চলে যান। পেরুতে ফিরে আসেন দশ বছর বয়সে, আর ষোলো বছর বয়সে লেখেন তার প্রথম নাটক 'দি এস্কেপ অভ দি ইনকা'। এরপর লিমা ইউনিভার্সিটি থেকে স্নাতক সম্পন্ন করে স্পেনেও পড়াশোনা করেন। পরে চলে যান প্যারিসে।
তার প্রথম উপন্যাস 'দ্য টাইম অভ দ্য হিরো' ছিল পেরুর এক সামরিক বিদ্যালয়ে দুর্নীতি ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র। ১৯৬২ সালে প্রকাশিত এই উপন্যাসের সময় দেশটির সামরিক বাহিনী রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে প্রচণ্ড ক্ষমতাধর ছিল। গল্পের তীব্রতা ও ভয়াবহ চিত্রায়ন ক্ষুব্ধ করে তোলে কয়েকজন পেরুভিয়ান জেনারেলকে। এক জেনারেল তো তাকে 'বিকৃতমনা' আখ্যা দিয়ে বসেন।
য়োসার নিজের অভিজ্ঞতা—লিওন্সিও প্রাদো মিলিটারি একাডেমিতে কৈশোরে কাটানো দিনগুলো ছিল এই উপন্যাসের পটভূমি। ১৯৯০ সালে এক সাক্ষাৎকারে তিনি একাডেমিতে কাটানো দিনগুলোকে 'চরম ট্রমাটিক অভিজ্ঞতাকে' বলে উল্লেখ করেন। সেখানে কাটানো ওই দুই বছর তাকে বুঝিয়ে দেয়, 'পেরু তিক্ততায় পরিপূর্ণ এক সহিংস সমাজ; এই সমাজের মানুষ বিভক্ত—সামাজিক, সাংস্কৃতিক, জাতিগত বিভাজনে পরস্পরের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে আছে'। য়োসা দাবি করেন, এ গল্প প্রকাশের পর স্কুল কর্তৃপক্ষ স্কুল প্রাঙ্গণে উপন্যাসটির এক হাজার কপি পুড়িয়ে ফেলে।
তার দ্বিতীয় উপন্যাস 'দ্য গ্রিন হাউস' (১৯৬৬) ছিল সাহসী নিরীক্ষা। এ কাহিনির ঘটনাস্থল ছিল পেরুর মরুভূমি আর অরণ্য, আর কাহিনির কেন্দ্রে ছিল এক পতিতালয়কে ঘিরে গড়ে ওঠা দালাল, ধর্মপ্রচারক ও সৈনিকদের জটিল আঁতাত।
এই দুটি উপন্যাসই ১৯৬০ ও ১৯৭০-এর দশকে 'লাতিন আমেরিকান বুম' নামক সাহিত্যিক নবজাগরণে ভূমিকা রাখে। এ সাহিত্যিক আন্দোলনের বৈশিষ্ট্য ছিল নিরীক্ষাধর্মী ও প্রবল রাজনৈতিক রচনা।
এই আন্দোলনের অগ্রদূতদের মধ্যে ছিলেন ভার্গাস য়োসার বন্ধু ও প্রতিদ্বন্দ্বী, কলম্বিয়ান সাহিত্যিক গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস—যিনি জাদুবাস্তবতার বহুরৈখিক শৈলীতে বিশ্বকে চমকে দিয়েছিলেন। ঘরে ঘরে তারা হয়ে উঠেছিলেন প্রিয় নাম। তাদের লেখা পড়া হতো বিশ্বের প্রতিটি কোণে।
তবে হুট করেই এই দুই লেখকের বন্ধুত্ব ভেঙে যাওয়ার ঘটনা বিখ্যাত হয়ে আছে সারা দুনিয়াতেই। ১৯৭৬ সালে মেক্সিকোর এক সিনেমা হলে ভার্গাস য়োসা আচমকাই ঘুসি মেরে বসেন মার্কেসকে। এরপর বহু দশক দুজনের মধ্যে কথা বন্ধ ছিল। য়োসা কেন মার্কেসকে ঘুসি মেরেছিলেন, তা নিয়ে নানাজনের নানারকম মত রয়েছে।
মার্কেসের বন্ধুরা বলেন, দ্বন্দ্বটা ছিল ভার্গাস য়োসার তখনকার স্ত্রী প্যাট্রিসিয়ার সঙ্গে মার্কেসের বন্ধুত্ব নিয়ে। তবে ২০১৭ সালে মাদ্রিদের এক বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তৃতাকালে ভার্গাস য়োসা বলেন, ওই ঘুসি মারা ঘটনাটি ছিল কিউবা ও ফিদেল কাস্ত্রোকে ঘিরে তাদের রাজনৈতিক মতাদর্শ না মেলার ফল।
২০০৭ সালে দুই বন্ধুর মধ্যে মিটমাট হয়ে যায়। এর তিন বছর পর, ২০১০ সালে ভার্গাস য়োসা নোবেল জেতেন। ১৯৮২ সালে মার্কেস নোবেল জিতেছিলেন; তার পর সাহিত্যে নোবেলজয়ী প্রথম দক্ষিণ আমেরিকান লেখক য়োসা।
ভার্গাস য়োসার অধিকাংশ সাহিত্যকর্মকেই বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে লাতিন আমেরিকার অস্থিরতা ও সহিংসতা থেকে আলাদা করা যায় না। সে সময়টায় এই অঞ্চলজুড়েই ছড়িয়ে পড়েছিল বিপ্লব আর সামরিক শাসনের ঢেউ।
য়োসার ১৯৬৯ সালের উপন্যাস 'কনভারসেশনস ইন দ্য ক্যাথেড্রাল' -এ পেরুর ১৯৪৮-৫৬ সালের একনায়ক ম্যানুয়েল ওড্রিয়ার শাসনামলের নির্মমতা উঠে এসেছে। সেই স্বৈরশাসন কীভাবে সাধারণ মানুষের জীবন গ্রাস করে নিয়েছিল, ধ্বংস করে দিয়েছিল তাদের স্বপ্ন আর সম্ভাবনা—এসব উঠে এসেছে এই উপন্যাসে।
অনেক বুদ্ধিজীবীর মতো ভার্গাস য়োসাও একসময় ফিদেল কাস্ত্রোর সমর্থক ছিলেন। কিন্তু ১৯৭১ সালে 'পাদিল্লা-কাণ্ডে'—যখন কিউবান সরকারকে সমালোচনার দায়ে কবি হেবের্তো পাদিল্লাকে কারাবন্দি করা হয়—কাস্ত্রোর প্রতি তার মোহভঙ্গ হয়।
১৯৮৩ সালে পেরুর আন্দিজ পর্বতে আটজন সাংবাদিকের ভয়াবহ হত্যাকাণ্ড তদন্তে গঠিত কমিশনের প্রধান করা হয় ভার্গাস য়োসাকে। ঘটনাটি পরিচিত হয়ে ওঠে 'উচুরাক্কাই হত্যাকাণ্ড' নামে।
সরকারি ভাষ্য অনুযায়ী, স্থানীয় আদিবাসীরা ওই সাংবাদিকদের 'শাইনিং পাথ' মাওবাদী গেরিলা ভেবে হত্যা করে।
য়োসার নেতৃত্বাধীন কমিশনের প্রতিবেদনে সরকারি বক্তব্যের পক্ষেই কথা বলা হয়। এর ফলে প্রবল সমালোচনার মুখে পড়তে হয় তাকে। হত্যাকাণ্ডের নৃশংসতা এবং মরদেহের বিকৃত করার ধরন দেখে অনেকেরই বিশ্বাস ছিল, এ কাজ আসলে কুখ্যাত সন্ত্রাসবিরোধী পুলিশের।
পরে আরও ডানপন্থি অবস্থানে সরে গিয়ে ১৯৯০ সালে নব্য-উদারনৈতিক অর্থনীতির প্রতিশ্রুতি নিয়ে 'ফ্রেন্তে ডেমোক্রাতিকো' জোট থেকে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে দাঁড়ান ভার্গাস য়োসা। কিন্তু হেরে যান আলবের্তো ফুজিমোরির কাছে। ফুজিমোরি পরের ১০ বছর দেশ শাসন করেন।
উচুরাক্কাই তদন্তে বিতর্কিত হলেও ভার্গাস য়োসা তার সাহিত্যে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস ও ক্ষমতার অপব্যবহার উন্মোচন অব্যাহত রেখেছেন।
তার ২০০০ সালের 'দ্য ফিস্ট অব দ্য গোট' উপন্যাসের কাহিনি গড়ে উঠেছে ডোমিনিকান রিপাবলিকের একনায়ক রাফায়েল ত্রুজিয়োকে কেন্দ্র করে। ৩১ বছর দেশ শাসনের পর ১৯৬১ সালে তিনি হত্যাকাণ্ডের শিকার হন। এই উপন্যাসে 'ক্ষমতার কাঠামো' বিশ্লেষণ এবং 'প্রতিরোধ, বিদ্রোহ ও পরাজয়ের মাঝে ব্যক্তির প্রতিচ্ছবি' তুলে ধরার জন্য তার প্রশংসা করে নোবেল কমিটি।
ভার্গাস য়োসার একাধিক রচনা চলচ্চিত্রে রূপ পেয়েছে। প্রথম বিয়ের প্রেক্ষাপটে লেখা 'আন্ট জুলিয়া অ্যান্ড দ্য স্ক্রিপ্টরাইটার' অবলম্বনে ১৯৯০ সালে নির্মিত হয় হলিউডের ছবি 'টিউন ইন টুমরো'।
পরবর্তী সময়ে তার লেখার বিষয় আরও বিস্তৃত হয়। আইরিশ জাতীয়তাবাদী রজার কেসমেন্টকে নিয়ে লেখেন 'দ্য ড্রিম অভ দ্য সেল্ট '(২০১২)।
য়োসার জীবনের শেষ সময় কেটেছে পেরু ও মাদ্রিদে।
তার ব্যক্তিজীবনও ছিল পত্রিকার শিরোনামে। ২০১৫ সালে ৫০ বছরের দাম্পত্যজীবনের ইতি টেনে তিনি সম্পর্কে জড়ান জনপ্রিয় লাতিন গায়ক এনরিকে ইগলেসিয়াসের মা এবং স্প্যানিশ-ফিলিপিনো তারকা ইসাবেল প্রেসলারের সঙ্গে।
বিতর্ক য়োসার পিছু ছাড়েনি। ২০১৯ সালে মেক্সিকোতে সাংবাদিক হত্যার বেড়ে যাওয়ার জন্য সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার প্রসারকে দায়ী করে সমালোচিত হন তিনি।
এর আগে ২০১৮ সালে স্পেনের সংবাদমাধ্যম 'এল পাইস'-এ একটি কলামে তিনি নারীবাদকে 'সাহিত্যের সবচেয়ে একনিষ্ঠ শত্রু' বলে আখ্যা দেন।
তার প্রয়াণে লাতিন আমেরিকান সাহিত্যের প্রসার আন্দোলনের শেষ উজ্জ্বল নক্ষত্রটিও নিভে গেল।