অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী সংক্রমণে বাড়ছে মৃত্যু, সবচেয়ে ঝুঁকিতে আফ্রিকা ও দক্ষিণ এশিয়ার শিশুরা: গবেষণা

বিশ্বজুড়ে অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী সংক্রমণের কারণে ২০২২ সালে ৩০ লাখেরও বেশি শিশু মারা গেছে বলে জানিয়েছেন শিশুস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের একদল গবেষক। খবর বিবিসির।
গবেষণায় দেখা গেছে, আফ্রিকা ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার শিশুদের ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি।
অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্স (এএমআর) বা জীবাণু প্রতিরোধ গড়ে তোলা এক ভয়াবহ স্বাস্থ্যঝুঁকি হিসেবে ইতোমধ্যেই চিহ্নিত হয়েছে। যখন সংক্রমণ সৃষ্টিকারী জীবাণুগুলো এমনভাবে পরিবর্তিত হয় যে, প্রচলিত অ্যান্টিবায়োটিক আর কাজ করে না—তখনই এএমআর সৃষ্টি হয়।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) এবং বিশ্বব্যাংকের তথ্য বিশ্লেষণ করে গবেষকরা জানিয়েছেন, কেবল ২০২২ সালেই অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী সংক্রমণে বিশ্বজুড়ে ৩০ লাখেরও বেশি শিশু প্রাণ হারিয়েছে।
গবেষণার অন্যতম লেখক, অস্ট্রেলিয়ার মারডক চিলড্রেন'স রিসার্চ ইনস্টিটিউটের ডা. ইয়ানহং জেসিকা হু এবং ক্লিনটন হেলথ অ্যাক্সেস ইনিশিয়েটিভের অধ্যাপক হার্ব হারওয়েল জানিয়েছেন, মাত্র তিন বছরের ব্যবধানে শিশুদের মধ্যে এ ধরনের সংক্রমণ ১০ গুণেরও বেশি বেড়েছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, কোভিড মহামারির সময় অতিরিক্ত অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের কারণে পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে।
অতিরিক্ত ও ভুল ব্যবহারে অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধ
অ্যান্টিবায়োটিক মূলত ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণ প্রতিরোধে ব্যবহৃত হয়—যেমন ত্বকের ইনফেকশন, নিউমোনিয়া কিংবা অস্ত্রোপচারের সময় সংক্রমণ ঠেকাতে। কিন্তু এগুলো ভাইরাসজনিত রোগ যেমন সর্দি-কাশি, ফ্লু বা কোভিডের বিরুদ্ধে কার্যকর নয়।
দুঃখজনকভাবে, বহু ক্ষেত্রে অপ্রয়োজনে বা ভুলভাবে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করা হয়, যার ফলে কিছু ব্যাকটেরিয়া এসব ওষুধের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলছে। অন্যদিকে, নতুন অ্যান্টিবায়োটিক উদ্ভাবনের হার খুব ধীর।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৯ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় 'ওয়াচ অ্যান্টিবায়োটিক' (যেগুলোর ওপর প্রতিরোধ গড়ার ঝুঁকি বেশি) ব্যবহারে ১৬০ শতাংশ এবং আফ্রিকায় ১২৬ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।
একই সময়ে, 'রিজার্ভ অ্যান্টিবায়োটিক'—যেগুলো শুধু গুরুতর ও বহুমুখী প্রতিরোধী সংক্রমণের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়—তার ব্যবহার দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ৪৫ শতাংশ ও আফ্রিকায় ১২৫ শতাংশ বেড়েছে।
চিকিৎসার বিকল্প সংকুচিত হচ্ছে
গবেষকরা সতর্ক করেছেন, যদি এই রিজার্ভ অ্যান্টিবায়োটিকগুলোতেও ব্যাকটেরিয়া প্রতিরোধ গড়ে তোলে, তবে ভবিষ্যতে এসব সংক্রমণের চিকিৎসার জন্য কার্যকর বিকল্প থাকবে না বললেই চলে।
অধ্যাপক হার্ব হারওয়েল চলতি মাসে অস্ট্রিয়ার ভিয়েনায় অনুষ্ঠিতব্য ইউরোপিয়ান সোসাইটি অব ক্লিনিক্যাল মাইক্রোবায়োলজি অ্যান্ড ইনফেকশাস ডিজিজ কংগ্রেসে এই গবেষণা উপস্থাপন করবেন।
তিনি বলেন, 'এএমআর একটি বৈশ্বিক সমস্যা। এটি সবার ওপর প্রভাব ফেলে। তবে শিশুরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়—এটাই আমরা এই গবেষণায় তুলে ধরেছি।'
সমাধান কোথায়?
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এটিকে বিশ্বের সবচেয়ে বড় স্বাস্থ্যঝুঁকিগুলোর একটি হিসেবে উল্লেখ করলেও, অধ্যাপক হারওয়েলের মতে, সমস্যাটির কোনও সহজ সমাধান নেই।
'অ্যান্টিবায়োটিক শুধু চিকিৎসায় নয়, খাদ্য ও পরিবেশেও ছড়িয়ে পড়ছে। ফলে একটি একক সমাধান কার্যকর করা সম্ভব নয়,' বলেন তিনি।
তাঁর মতে, সংক্রমণ প্রতিরোধের সবচেয়ে ভালো উপায় হলো—সংক্রমণই যাতে না হয়, সেদিকে মনোযোগ দেওয়া। এর জন্য প্রয়োজন টিকাদান, পানি ও পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থার উন্নয়ন এবং স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা।
'প্রয়োজনের সময় সঠিক অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে,' বলেন তিনি।
লন্ডনের কিংস কলেজের মাইক্রোবায়োলজির জ্যেষ্ঠ প্রভাষক ডা. লিন্ডসে এডওয়ার্ডস বলেন, এই নতুন তথ্য আগের তুলনায় অনেক বড় ধরনের সতর্কবার্তা।
'বিশ্বের স্বাস্থ্যের জন্য এটি একটি জোরালো সংকেত। এখনই পদক্ষেপ না নিলে শিশুস্বাস্থ্যে বহু দশকের অগ্রগতি মুখ থুবড়ে পড়তে পারে।'