খনিজের পর এবার ইউক্রেনের পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রেরও নিয়ন্ত্রণ নিতে চান ট্রাম্প

ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির সঙ্গে এক ফোনালাপে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এক ব্যতিক্রমী প্রস্তাব দিয়েছেন—যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনের পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর নিয়ন্ত্রণ নিতে পারে।
হোয়াইট হাউস এক বিবৃতিতে জানায়, 'যুক্তরাষ্ট্রের বিদ্যুৎ ও ইউটিলিটি খাতে বিশেষজ্ঞদের অভিজ্ঞতা ইউক্রেনের পারমাণবিক অবকাঠামোর সুরক্ষায় সহায়ক হতে পারে। এই কেন্দ্রগুলো মার্কিন মালিকানায় গেলে তা ইউক্রেনের জ্বালানি খাতের জন্য সবচেয়ে ভালো সুরক্ষা হবে।'
তবে কিয়েভের কর্মকর্তারা ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা এই প্রস্তাবে বিস্মিত হয়েছেন। ইউক্রেনের চারটি পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র রয়েছে, কিন্তু ঠিক কতগুলো কেন্দ্র নিয়ে এই আলোচনা হয়েছে, তা নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে বিভ্রান্তি রয়েছে।
জেলেনস্কি এক সংবাদ সম্মেলনে জানান, আলোচনা মূলত ইউরোপের বৃহত্তম পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র জাপোরিঝঝিয়া প্লান্টকে কেন্দ্র করেই হয়েছে, যা বর্তমানে রাশিয়ার নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। তিনি বলেন, 'এ নিয়ে ইতিবাচক আলোচনা হয়েছে, তবে দ্রুত কোনো সিদ্ধান্ত আসবে কিনা, তা নিশ্চিত নয়।'
হোয়াইট হাউসের বিবৃতিতে ট্রাম্পের পরিচিত একটি যুক্তি উঠে এসেছে—যুক্তরাষ্ট্র যদি ইউক্রেনে অর্থনৈতিকভাবে যুক্ত থাকে, তাহলে রাশিয়া সেখানে হামলার বিষয়ে আরও সতর্ক হবে। তিনি একই ধরনের যুক্তি ইউক্রেনের মূল্যবান খনিজ সম্পদে মার্কিন বিনিয়োগের ক্ষেত্রেও প্রয়োগ করেছেন।
যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক স্বার্থ
ইউক্রেনের সোভিয়েত যুগের পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো যুদ্ধকালীন সময়ে দেশটির জ্বালানি খাতের মূল ভরসা হয়ে উঠেছে। বর্তমানে এসব কেন্দ্র ইউক্রেনের মোট বিদ্যুতের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ সরবরাহ করে। যদিও রাশিয়া ইউক্রেনের তাপ ও জলবিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর ওপর ধারাবাহিক হামলা চালিয়ে দেশটির বিদ্যুৎ অবকাঠামো ধ্বংসের চেষ্টা করেছে, তবে পারমাণবিক কেন্দ্রগুলোর ওপর আঘাত হানেনি। কারণ, এতে তেজস্ক্রিয়তা ছড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি রয়েছে।
এই পরিস্থিতিতে ইউক্রেন সরকার নতুন পারমাণবিক চুল্লি নির্মাণের পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে, যা দীর্ঘমেয়াদে জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিতের অন্যতম কার্যকর উপায় বলে মনে করা হচ্ছে। এ প্রসঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যিক স্বার্থ স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

যুদ্ধ শুরুর আগে মার্কিন পারমাণবিক প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান ওয়েস্টিংহাউস ইউক্রেনের রাষ্ট্রীয় পারমাণবিক কোম্পানি এনেরগোঅ্যাটমের সঙ্গে পাঁচটি পারমাণবিক চুল্লি নির্মাণের জন্য চুক্তি স্বাক্ষর করেছিল। যুদ্ধ শুরু হলে এই সংখ্যা বাড়িয়ে ৯টিতে উন্নীত করা হয় এবং পরবর্তী সময়ে আরও চারটি ছোট পারমাণবিক কেন্দ্র নির্মাণে সহযোগিতার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
ওয়েস্টিংহাউসের বিশেষ নজর রয়েছে জাপোরিঝঝিয়া পারমাণবিক কেন্দ্রের ওপর, যেখানে ছয়টি চুল্লি রয়েছে। ২০২২ সালের মার্চে রাশিয়া কেন্দ্রটির নিয়ন্ত্রণ নেয় এবং সেটি ইউক্রেনের জাতীয় গ্রিড থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। তবে যুদ্ধের আগে এটি ওয়েস্টিংহাউসের জ্বালানি ও প্রযুক্তি ব্যবহার করত।
ইউক্রেনের পারমাণবিক নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ ওলগা কোশারনা জানান, রাশিয়ার দখল নেওয়ার পর ওয়েস্টিংহাউসের মালিকানাধীন প্রযুক্তি চুরির আশঙ্কা তৈরি হয়। ২০২৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের জ্বালানি দপ্তর রুশ পারমাণবিক কোম্পানি রোসাটমকে সতর্ক করে জানায়, তারা যদি ওয়েস্টিংহাউসের প্রযুক্তি ব্যবহার করে, তবে মার্কিন আইনের আওতায় তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হতে পারে।
ওয়াশিংটনের কেনান ইনস্টিটিউটের জ্বালানি বিশেষজ্ঞ আন্দ্রিয়ান প্রকিপ বলেন, জাপোরিঝঝিয়া কেন্দ্র ইউক্রেনের নিয়ন্ত্রণে ফিরলে ওয়েস্টিংহাউসের বাজার আরও বিস্তৃত হবে এবং প্রতিষ্ঠানটি সরাসরি লাভবান হবে।
ট্রাম্প তার ঘোষণামতো রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে মঙ্গলবারের ফোনালাপে জাপোরিঝঝিয়া কেন্দ্র নিয়ে আলোচনা করেছেন কি না, তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। ওয়েস্টিংহাউসও এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেনি।
এদিকে, যুক্তরাষ্ট্র-ইউক্রেন আলোচনার বিষয়ে অবগত বর্তমান ও সাবেক দুই ইউক্রেনীয় কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ওয়াশিংটনের যদি ইউক্রেনের খনিজ সম্পদে প্রবেশাধিকার চাই, তবে জাপোরিঝঝিয়া কেন্দ্রের বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা প্রয়োজন হবে, কারণ খনিজ উত্তোলন ও প্রক্রিয়াকরণে ব্যাপক বিদ্যুৎ খরচ হয়।
সম্ভাব্য চ্যালেঞ্জ
ইউক্রেনের সব পারমাণবিক কেন্দ্র রাষ্ট্রীয় কোম্পানি এনেরগোঅ্যাটমের মালিকানাধীন, এবং আইন অনুসারে দেশটির সব পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন এবং সেগুলোর ব্যক্তিগতকরণ নিষিদ্ধ। ফলে যুক্তরাষ্ট্র যদি এসব কেন্দ্রের মালিকানা নিতে চায়, তবে ইউক্রেনের আইন সংশোধন করতে হবে, যা রাজনৈতিকভাবে সংবেদনশীল একটি বিষয়।
সোভিয়েত-পরবর্তী ইউক্রেনে বেশ কিছু কৌশলগত খাত এখনও রাষ্ট্রীয় মালিকানায় রয়েছে, যা এই আইন পরিবর্তনের পথে বড় বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে। যুদ্ধকালীন সময়ে ইউক্রেন বেশ কিছু রাষ্ট্রীয় সম্পদ বেসরকারীকরণের উদ্যোগ নিলেও এনেরগোঅ্যাটম—যা দেশের সর্বোচ্চ রাজস্ব উৎপাদনকারী সংস্থা—নিজি খাতে ছেড়ে দেওয়া হবে কি না, তা নিয়ে জটিলতা দেখা দেবে।
'আমি মনে করি, ইউক্রেনে এই ধারণার ব্যাপক প্রতিরোধ হবে,' বলেন দেশটির পার্লামেন্টের জ্বালানি কমিটির সাবেক সিনিয়র সদস্য ও সাবেক আইনপ্রণেতা ভিক্টোরিয়া ভোইৎসিৎসকা। 'এটি রাজনৈতিকভাবে সংবেদনশীল, এবং উভয় পক্ষের নেতাদের কাছ থেকেই বিরোধিতা আসতে পারে।'
প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কিও এই বিষয়টি ট্রাম্পের সঙ্গে আলোচনার পর সংবাদ সম্মেলনে ইঙ্গিত দেন। তিনি বলেন, যদি রাশিয়া জাপোরিঝঝিয়া কেন্দ্রটি ইউক্রেনকে ফিরিয়ে দেয় (যা অনেক ইউক্রেনীয়র কাছেই অবাস্তব মনে হয়), তবে 'সরাসরি যুক্তরাষ্ট্রের কাছে এটি হস্তান্তর করা সম্ভব হবে না, কারণ এটি আমাদের সম্পদ এবং আমাদের ভূখণ্ডের অন্তর্গত।'
তিন বছরের যুদ্ধের পর এসব কেন্দ্র আবার সচল করাও বড় চ্যালেঞ্জ হবে। জেলেনস্কি জানান, বিশেষ করে জাপোরিঝঝিয়া কেন্দ্র পুনরায় চালু করতে দুই থেকে আড়াই বছর সময় লাগতে পারে।
এছাড়া, যুদ্ধের সময় ছয়টি চুল্লি বন্ধ করে দেওয়া হলেও সেগুলোর গুরুত্বপূর্ণ নিরাপত্তা ব্যবস্থা সচল রাখতে বিদ্যুৎ ও পর্যাপ্ত শীতলীকরণ প্রয়োজন। কিন্তু যুদ্ধের কারণে প্লান্টে বিদ্যুৎ সরবরাহকারী লাইন একাধিকবার বিচ্ছিন্ন হয়েছে। এছাড়া, রাশিয়ার নির্দেশে কাছাকাছি একটি বাঁধ ধ্বংস হওয়ায় শীতলীকরণে ব্যবহৃত পানির সরবরাহ কমে গেছে, যা পারমাণবিক দুর্ঘটনার ঝুঁকি আরও বাড়িয়ে তুলেছে।