গাজায় ইসরায়েলি হামলা: নবজাতকসহ নিহত ৭১, অনির্দিষ্টকাল যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার ইঙ্গিত নেতানিয়াহুর

গাজায় ইসরায়েলের নতুন করে বোমাবর্ষণ টানা তৃতীয় দিনের মতো অব্যাহত রয়েছে। আজ ভোর থেকে এখন পর্যন্ত ইসরায়েলি হামলায় নারী ও শিশুসহ কমপক্ষে ৭১ জন নিহত হয়েছেন। নিহতদের মধ্যে একটি নবজাতক শিশুও রয়েছে।
গাজার দক্ষিণ ও উত্তরাঞ্চলে বৃহস্পতিবার ভোরে অন্তত ৭১ জনের মৃত্যু হয়েছে বলে জানিয়েছেন উপকূলীয় ছিটমহলের স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা। এসব হামলায় আহত হয়েছেন আরও অনেকে।
ফিলিস্তিনি সংবাদমাধ্যম কুদস নিউজ নেটওয়ার্ক জানিয়েছে, ইসরায়েলি বাহিনী ওই এলাকার বেশ কয়েকটি বাড়িতে হামলা চালালে দক্ষিণের খান ইউনুসে অন্তত ২০ জন নিহত হয়েছে।
এদিকে, গাজার উত্তরাঞ্চলে বেইত লাহিয়ার পশ্চিমে আস-সুলতান এলাকায় একটি বাড়িতে হামলায় অন্তত সাতজন নিহত হয়েছে।
আল-জাজিরার তারেক আবু আজজুম মধ্য গাজা থেকে জানিয়েছেন, 'গাজা উপত্যকাজুড়ে ইসরায়েলি হামলা আরও তীব্র হয়েছে; বিশেষ করে ভোরে, সেসময় ইসরায়েলি বাহিনী কমপক্ষে ১১টি আবাসিক ভবন ধ্বংস করে দিয়েছে।'
তিনি বলেন, 'আমরা বুঝতে পারছি নিহতের সংখ্যা বেড়েছে, কমপক্ষে ৭১ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন।'
আবু আজজুম বলেন, 'আজ যারা নিহত হয়েছেন তাদের মধ্যে শিশু ও নারীদের পাশাপাশি একটি নবজাতক শিশু রয়েছে।'
তিনি আরও বলেন, 'ইসরায়েল যে কৌশলগত পদ্ধতি ব্যবহার করছে তা স্পষ্ট। কারণ বেসামরিক নাগরিকরা যে ভবনে আশ্রয় নিচ্ছে সেখানে আঘাত হানার আগে তাদের কোনো ধরনের সতর্কবার্তা দিচ্ছে না ইসরায়েল।'
গাজায় প্রায় দুই মাস ধরে চলা যুদ্ধবিরতি ভেঙে গত মঙ্গলবার প্রথম হামলা করে ইসরায়েল।
গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র খলিল আল-দাকরান আল জাজিরা আরবিকে বলেন, এরপর থেকে ইসরায়েলি হামলায় ৭১০ জনেরও বেশি ফিলিস্তিনি নিহত ও ৯০০ জন আহত হয়েছেন। আহতদের প্রায় ৭০ শতাংশই শিশু ও নারী।

জবাব চায় জাতিসংঘ
বুধবার গাজার কেন্দ্রস্থলে জাতিসংঘের একটি স্থাপনায় ইসরায়েলি বিমান হামলায় জাতিসংঘের এক বিদেশি কর্মী নিহত ও আরও পাঁচ শ্রমিক আহত হয়েছেন।
জাতিসংঘের মানবিক ত্রাণ বিষয়ক প্রধান টম ফ্লেচার এই হামলাকে 'হিংস্র' বলে বর্ণনা করেছেন।
তিনি বলেন, ''গাজায় জাতিসংঘের 'স্পষ্টভাবে নির্ধারিত' একটি কম্পাউন্ডকে লক্ষ্য করে এই হামলা চালানো হয়েছে। জাতিসংঘ এই হামলার 'জবাব' চায় এবং 'আমরা আমাদের সহকর্মীর পরিবারের প্রতি শোক প্রকাশ করছি'।''
এক বিবৃতিতে ফ্লেচার বলেন, 'আন্তর্জাতিক আইন পরিষ্কার। জাতিসংঘের কর্মী ও মানবিক সহায়তাকর্মীসহ বেসামরিক লোকজনকে লক্ষ্যবস্তু করা যাবে না। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে অবশ্যই সত্যিকারের তদন্ত ও জবাবদিহিতার ওপর জোর দিতে আমাদের সঙ্গে যোগ দিতে হবে।'
ইসরায়েল পুনরায় হামলা শুরু করায় জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস জানিয়েছেন, গাজায় ইসরায়েলি বিমান হামলায় তিনি ক্ষুব্ধ হয়েছেন।

বুধবার ইসরায়েলি সেনারা গাজায় স্থল অভিযান পুনরায় শুরু করার সঙ্গে সঙ্গে তারা ফের নেটজারিম করিডোরের নিয়ন্ত্রণও নেয়, যার ফলে কার্যত উত্তর গাজা উপত্যকার বাকি অংশ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে।
গাজা সিটি থেকে আল-জাজিরার হানি মাহমুদ বলেন, 'নেটজারিম করিডোর পুনর্দখলে ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর পদক্ষেপ যুদ্ধবিরতির আগের দুঃসহ স্মৃতি ফিরিয়ে আনছে।'
তিনি বলেন, 'যুদ্ধবিরতি চলাকালে ফিলিস্তিনিরা উত্তরাঞ্চলে তাদের বাড়িঘরে ফিরে যাওয়ার জন্য এটি ব্যবহার করতে পারত। কিন্তু এখন আর পারছে না। এখন মানুষের চলাচল খুবই সীমিত।'
যুদ্ধবিরতির আগে নেটজারিম অনেক ইসরায়েলি সামরিক অভিযানের লঞ্চিং প্যাড হিসেবে কাজ করেছে এবং 'অনেক ফিলিস্তিনির জন্য মৃত্যুফাঁদ' হয়ে দাঁড়িয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'এর পুনর্দখলের ফলে বোঝা যাচ্ছে যে ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী বড় আকারের অভিযানের জন্য অগ্রসর হচ্ছে।'
যুদ্ধবিরতি ভঙ্গের বিষয়টি ইসরায়েলের নাগরিকদের মধ্যেও ব্যাপক ক্ষোভের সৃষ্টি করেছে। অনেক ইসরায়েলি এখনও গাজা থেকে তাদের প্রিয়জনদের ফিরে আসার অপেক্ষায় রয়েছেন।
ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে গাজায় বন্দিদের নিরাপত্তার তোয়াক্কা না করে আবারও হামলা শুরু করার অভিযোগ তুলে বুধবার জেরুজালেমে জড়ো হন হাজার হাজার ইসরায়েলি বিক্ষোভকারী।
গাজায় অনির্দিষ্টকালের জন্য যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার ইঙ্গিত নেতানিয়াহুর
কাতার বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক লুসিয়ানো জাকারা আল- জাজিরাকে বলেছেন, দুটি প্রধান লক্ষ্য অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত ইসরায়েলি সরকার গাজায় যুদ্ধ চালিয়ে যেতে আগ্রহী বলে মনে হচ্ছে।
জাকারা বলেন, প্রথম উদ্দেশ্য - বন্দীদের মুক্তি – যার বেশিরভাগই আলোচনার মাধ্যমে অর্জিত হয়েছিল। দ্বিতীয় উদ্দেশ্য - হামাসকে ধ্বংস করা - নেতানিয়াহুর জন্য সব সময়ই এটাই ছিল প্রধান বিষয়।
এই বিশ্লেষক বলেন, 'যুদ্ধবিরতি চুক্তির কারণে পদত্যাগের পর জাতীয় নিরাপত্তা মন্ত্রী হিসেবে ইতামার বেন-গভিরের পুনর্নিয়োগ একটি স্পষ্ট সংকেত যে, 'আর কোনো আলোচনা হবে না এবং আর কোনো যুদ্ধবিরতি হবে না।'
জাকারা বলেন, 'যুদ্ধবিরতি স্বাক্ষরিত হওয়ায় নেতানিয়াহুর জোটের অনেকের পরাজয় হয়েছে। '[বন্দীদের] ইতোমধ্যেই বলি দেওয়া হয়েছিল। তারা যা চায়, তা হলো যুদ্ধ'।