বিশ্বের সবচেয়ে বড় হিমশৈল আটকে গেল প্রত্যন্ত এক দ্বীপের কাছে এসে

বিশ্বের বৃহত্তম হিমশৈল (আইসবার্গ) দক্ষিণ জর্জিয়ার ব্রিটিশ দ্বীপের প্রত্যন্ত অঞ্চলের অগভীর জলে আটকে গেছে। সেখানে লাখ লাখ পেঙ্গুইন ও সীল মাছের বসবাস। খবর বিবিসির।
বৃহত্তর লন্ডনের প্রায় দ্বিগুণ আকারের বিশাল এ হিমশৈলটি বর্তমানে সেখানে আটকে আছে বলে ধারণা করা হচ্ছে এবং দ্বীপের দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলে এ হিমশৈলটি ভেঙে পড়তে শুরু করতে পারে।
স্থানীয় মৎস্যজীবীরা আশঙ্কা করছেন, তাদের এ বিশাল আকারের ভাসমান বরফের সঙ্গে লড়াই করতে হতে পারে। এটি কিছু ম্যাকারোনি প্রজাতির পেঙ্গুইনের খাদ্য সংগ্রহে প্রভাব ফেলতে পারে।
তবে অ্যান্টার্কটিকার বিজ্ঞানীরা বলছেন, এই বরফের ভেতরে প্রচুর পুষ্টি আটকে আছে, যা গলে গেলে সমুদ্রের জীববৈচিত্র্যের বিস্ফোরণ ঘটাতে পারে।
ব্রিটিশ অ্যান্টার্কটিক সার্ভের অধ্যাপক নাদিন জনস্টন বলেন, "এটি একপ্রকার পুষ্টির বিস্ফোরণ, যেন একেবারে বিরান মরুভূমির মাঝে হঠাৎ খাদ্যের ভাণ্ডার ফেলে দেওয়া হয়েছে।"
দক্ষিণ জর্জিয়ার সরকারের পরামর্শদাতা পরিবেশবিদ মার্ক বেলচিয়ার বলেন, "যদি এটি ভেঙে যায়, তাহলে তৈরি হওয়া ছোট ছোট হিমশৈল স্থানীয় স্রোতের সঙ্গে প্রবাহিত হয়ে জাহাজ চলাচলের জন্য বিপজ্জনক হতে পারে এবং মাছ ধরার এলাকাগুলোয় প্রবেশও সীমিত করতে পারে।"
এই হিমশৈলটি ১৯৮৬ সালে ফিলচনার-রনে আইস শেল্ফ থেকে এটি ভেঙে পড়ে ভাসা শুরু করে। এটি দীর্ঘ সময় সমুদ্রের স্রোতে আটকে পড়ার পর অবশেষে মুক্ত হয়ে গিয়েছিল। গত ডিসেম্বর থেকে স্যাটেলাইটের মাধ্যমে এর গতিপথ পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছিল।
উত্তরের উষ্ণ জলপ্রবাহের মধ্যে প্রবাহিত হওয়ার পরও এটি দীর্ঘদিন অক্ষত ছিল। কিছুদিন ধরে এটি স্থির ছিল, এরপর ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি দিনে প্রায় ২০ মাইল (৩০ কিমি) গতিতে অগ্রসর হতে দেখা যায়।
অ্যান্টার্কটিকায় অবস্থানরত ব্রিটিশ গবেষণা জাহাজ স্যার ডেভিড অ্যাটেনবরো থেকে অধ্যাপক হু গ্রিফিথস বলেন, "সব হিমশৈল একসময় গলে যায়। তবে বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, এ২৩এ এতদিন টিকে ছিল এবং এখনও পর্যন্ত এর মাত্র এক-চতুর্থাংশ বরফ গলেছে।"
শনিবার ৩০০ মিটার লম্বা হিমশৈলটি ভূমি থেকে প্রায় ৫০ মাইল (৮০ কিমি) দূরে মহাদেশীয় শেলফে আটকে যায় এবং বর্তমানে এটি সেখানেই স্থির রয়েছে বলে মনে হচ্ছে।
ব্রিটিশ অ্যান্টার্কটিক সার্ভের অধ্যাপক অ্যান্ড্রু মেইজার্স বলেন, "বরফের বিশাল খণ্ডগুলো ভেঙে না যাওয়া পর্যন্ত এটি সম্ভবত এখানেই থাকবে।"
এটি ক্ষয় হতে শুরু করেছে। একসময় ৩,৯০০ বর্গকিলোমিটার (১,৫০০ বর্গমাইল) আয়তনের হিমশৈলটি ক্রমাগত সংকুচিত হয়ে বর্তমানে ৩,২৩৪ বর্গকিলোমিটারে নেমে এসেছে।
অধ্যাপক মেইজার্স আরও বলেন, "আগে এটি ছিল একটি বিশাল, সমতল বরফখণ্ড, কিন্তু এখন এর প্রান্তে গুহার মতো ফাটল দেখা যাচ্ছে।"
জোয়ারের ওঠানামার ফলে হিমশৈলটি উপরে-নিচে দুলতে থাকবে। এর ফলে যেখানে আটকে আছে সেখানে পাথর ও বরফেরও ক্ষয় হবে।
অধ্যাপক মেইজার্স বলেন, "যদি নিচের বরফ লবণের সংস্পর্শে ক্ষয়ে যায়, তবে এটি ভেঙে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে সম্ভবত আরও অগভীর পানিতে প্রবাহিত হবে।"
তবে এটি যেখানে রয়েছে সেখানে হাজার হাজার ক্ষুদ্র সামুদ্রিক প্রাণী যেমন- প্রবাল, সামুদ্রিক শামুক এবং স্পঞ্জ রয়েছে।
অধ্যাপক গ্রিফিথস বলেন, "সমুদ্রের তলদেশে বরফের বিশাল স্ল্যাব এগুলোর আবাসস্থলকে একেবারে নিশ্চিহ্ন করে দিতে পারে।"
এটি স্বল্পমেয়াদে ওই সামুদ্রিক প্রাণীদের জন্য বিধ্বংসী হতে পারে, তবে এটি এই অঞ্চলের প্রাকৃতিক জীবচক্রের অংশ। তিনি বলেন, "এক জায়গায় এটি ক্ষতি করলেও, অন্য জায়গায় পুষ্টি ও খাদ্যের নতুন উৎস তৈরি করছে।"
দ্বীপের বড় আকারের প্রাণীদের জন্যও এটি উদ্বেগের কারণ ছিল। ২০০৪ সালে রস সাগর অঞ্চলে একটি বিশাল হিমশৈল পেঙ্গুইনের প্রজনন প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করেছিল, ফলে মৃত্যুর হার বেড়ে গিয়েছিল।
তবে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, দক্ষিণ জর্জিয়ার বেশিরভাগ পাখি ও প্রাণী এই ধরনের পরিস্থিতি থেকে রেহাই পাবে।
ব্রিটিশ অ্যান্টার্কটিক সার্ভের গবেষক পিটার ফ্রেটওয়েল বলেন, "কিছু ম্যাকারোনি পেঙ্গুইনের জন্য এটি সমস্যার কারণ হতে পারে, যদি তাদের খাদ্য সংগ্রহের পথ হিমশৈলের কারণে বাধাগ্রস্ত হয়।"
হিমশৈল মিঠা পানিকে লবণ পানির সঙ্গে মিশিয়ে দেয়, ফলে সামুদ্রিক ক্রাস্টেশিয়ান ক্রিল-এর (যা পেঙ্গুইনের প্রধান খাদ্য) প্রাচুর্য কমে যেতে পারে।
তিনি ব্যাখ্যা করেন, "পেঙ্গুইনরা খাদ্যের সন্ধানে অন্যত্র যেতে পারে, তবে এতে তারা অন্যান্য প্রাণীদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় পড়বে।"
এপ্রিল মাসে মাছ ধরার মৌসুম শুরু হলে হিমশৈলটি বন্দরগুলো অবরুদ্ধ করতে পারে বা নৌযান চলাচলে বিঘ্ন ঘটাতে পারে।
মাছ ধরার প্রতিষ্ঠান আর্গোস ফ্রোয়ানেসের অ্যান্ড্রু নিউম্যান বলেন, "এটি সম্ভবত মাছ ধরার মৌসুমে দেখা সবচেয়ে বড় হিমশৈল, তবে আমরা এই পরিস্থিতির জন্য ভালোভাবে প্রস্তুত।"
অন্যদিকে, বর্তমানে অ্যান্টার্কটিকায় কর্মরত বিজ্ঞানীরা দেখছেন যে হিমশৈল সমুদ্রের জীববৈচিত্র্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
অধ্যাপক গ্রিফিথস এবং অধ্যাপক জনস্টন স্যার ডেভিড অ্যাটেনবরো গবেষণা জাহাজ থেকে গবেষণা চালাচ্ছেন। তাদের দল বিশ্বাস করে যে অ্যান্টার্কটিকার বরফ থেকে পুষ্টির বিশাল প্রবাহ সমগ্র বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে।
বিজ্ঞানীরা ব্যাখ্যা করেন, বরফের ভেতরে আটকে থাকা কণা ও পুষ্টি ধীরে ধীরে সমুদ্রে মিশে যায়, যা সামুদ্রিক জীবের বৃদ্ধিতে সহায়ক।
অধ্যাপক গ্রিফিথস বলেন, "এই বরফ না থাকলে আমরা এই সমুদ্রতীরবর্তী বাস্তুতন্ত্রও পেতাম না। এটি বিশ্বের সবচেয়ে উর্বর অঞ্চলগুলোর একটি, যা অসংখ্য প্রাণীকে সহায়তা করে এবং এমনকি নীল তিমির মতো বৃহৎ প্রাণীদের খাদ্যের জোগান দেয়।"
এ২৩এ হিমশৈলের চারপাশে বিশাল ফাইটোপ্ল্যাঙ্কটন দেখা যাচ্ছে। এর অর্থ হচ্ছে এটি ইতোমধ্যেই পুষ্টি ছড়াতে শুরু করেছে। স্যাটেলাইট ইমেজে এটি একটি বিশাল সবুজ আভা হিসেবে দেখাচ্ছে।