যেভাবে সুপারম্যানের ‘এস’ ফ্যাশন জগতে প্রিয় লোগো হয়ে উঠল

সুপারম্যান: দ্য ক্রিস্টোফার রিভ স্টোরি নামে একটি নতুন প্রামাণ্যচিত্রে হুপি গোল্ডবার্গ বলছিলেন, "আমি কখনো এতটা মোহিত হইনি, যতক্ষণ না তাকে ওই ছোট পোশাকে দেখেছি।" তিনি যে ১৯৭৮ সালের সেই উজ্জ্বল গাঢ় নীল রঙের লাইকরা বডিস্যুট আর লাল কেপের কথা বলছিলেন, তা স্পষ্ট। সেটিই প্রথম লাইভ-অ্যাকশন সুপারম্যান চলচ্চিত্রে পরেছিলেন ক্রিস্টোফার রিভ।
সেই সময় থেকেই বিশেষ করে অন্য সুপার হিরোদের তুলনায় ক্লার্ক কেন্টের চেনা নীল, লাল ও হলুদ পোশাকের খুব বেশি পরিবর্তন হয়নি। যেখানে ব্যাটম্যান টাইটস ছেড়ে গাঢ় রঙের সামরিক ঢঙের বডি-আর্মার পরা শুরু করেছেন, সেখানে সুপারম্যান রয়ে গেছেন তার ঐতিহ্যবাহী স্কিন-টাইট পোশাকে। তবে পোশাকের রঙে কিছুটা বৈচিত্র্য এসেছে। পেরিওয়িংকেল থেকে কোবাল্ট, এমনকি ১৯৯০-এর দশকের টিভি সিরিজ লুইস অ্যান্ড ক্লার্কে ডিন কেইনকে গাঢ় ইন্ডিগো পোশাকে দেখা গেছে। তবুও সুপারম্যানের ইউনিফর্ম সব প্রজন্মের কাছেই তাৎক্ষণিকভাবে পরিচিতি পেয়েছে।
আসলে, একমাত্র চলচ্চিত্র যেখানে সুপারম্যান তার আইকনিক লাল বেল্টযুক্ত ট্রাঙ্কস পরেননি, সেটি ছিল জ্যাক স্নাইডারের ২০১৩ সালের ম্যান অব স্টিলে।

সিএনএনকে দেওয়া এক মেইলে ছবিটির পোশাক ডিজাইনার মাইকেল উইলকিনসন জানান, "সেই নির্দিষ্ট পোশাকটি তার নিজ গ্রহ ক্রিপ্টনের সংস্কৃতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল।" ক্রিপ্টোনীয় জাতির আঁশের মতো বর্ম ও পেশিবহুল শরীর গঠনের ধারণা থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে তিনি এই ডিজাইন করেছিলেন তিনি। তিনি আরও বলেন, "আমরা পোশাকটির বিভিন্ন সংস্করণ তৈরি করেছিলাম। একদিন আমরা ট্রাঙ্কস ছাড়া একটি ডিজাইন আঁকি, আর সেটিই আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে সবচেয়ে বেশি মানানসই মনে হয়।'
আগামী সুপারম্যান রিমেকের পরিচালক জেমস গান্নের জন্য, সুপারম্যানের ঐতিহ্যবাহী ব্রিফস ফিরিয়ে আনা ছিল এক ধরনের কৌশল। সিনেমাব্লেন্ডকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, "সে আশা ও ইতিবাচকতার প্রতীক হতে চায়। তাই সে একজন পেশাদার রেসলারের মতো পোশাক পরে। সে এমনভাবে পোশাক পরিধান করে, যাতে মানুষ তাকে ভয় না পায়।"
শুধু সুপারম্যানের উজ্জ্বল রঙের সুপারস্যুট তার ভক্তদের জন্য আনন্দদায়ক এক প্রতীকই নয়, এটি ফ্যাশন ডিজাইনারদের জন্যও অনুপ্রেরণার উৎস।
কয়েকটি বিলাসবহুল ফ্যাশন ব্র্যান্ড সুপারহিরোদের অনুপ্রেরণা হিসেবে দেখেছে। ২০০৮ সালে নিউইয়র্কের মেট্রোপলিটন মিউজিয়াম অব আর্ট-এর কস্টিউম ইনস্টিটিউট 'ফ্যাশন অ্যান্ড ফ্যান্টাসি' শিরোনামে একটি প্রদর্শনীর আয়োজন করে। সেখানে সিনেমার পোশাক থেকে শুরু করে উচ্চ ফ্যাশনের ডিজাইনসহ প্রায় ৬০টি পোশাক প্রদর্শিত হয়।
এর মধ্যে অন্যতম ছিল জার্মান ডিজাইনার বার্নহার্ড উইলহেলমের ২০০৬ সালের রয়্যাল ব্লু রঙের পোশাক, যার ওপর রক্তাক্ত ও গলিত সুপারম্যানের 'এস' লোগো ছাপানো ছিল।

সেই সময় ইনস্টিটিউটের কিউরেটর অ্যান্ড্রু বল্টন বলেছিলেন, "আজ সুপারহিরোদের চিত্রায়ণ জনপ্রিয় সংস্কৃতির প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে ছড়িয়ে পড়েছে। কেপ, মাস্ক ও বডিস্যুট নিয়ে গঠিত সুপারহিরোদের প্রতীকী পোশাক নানা ধরনের ফ্যাশনধারায় রূপান্তরিত হয়েছে। তবে ফ্যাশন কেবল প্রতীকী হিসেবেই থেমে থাকেনি বরং এটি পরিচয়, যৌনতা এবং জাতীয়তাবাদের মতো বিষয়কেও ছুঁয়ে গেছে।"
তিনি আরও বলেন, ফ্যাশনের সঙ্গে সুপারহিরোদের একটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য হলো 'প্রতীকী নমনীয়তা' যা মানুষকে তাদের আদর্শের প্রতি আকর্ষণ তৈরি করতে সাহায্য করে।
কয়েক বছর পর, আমেরিকান ফ্যাশন ডিজাইনার জেরেমি স্কট মোশিনোর ২০১১ সালের শরৎ-শীতকালীন সংগ্রহের জন্য রয়্যাল ব্লু রঙের সিকুইনযুক্ত, লম্বা হাতার ম্যাক্সি ড্রেস ডিজাইন করেন। পোশাকটির সামনে সুপারম্যানের 'এস' লোগোর নতুন সংস্করণ ছিল। তবে সেখানে 'এস' -এর পরিবর্তে ছিল একটি প্রশ্নবোধক চিহ্ন। আর লাল টিউলের এক গজ দীর্ঘ অংশ পোশাকের পেছনে কেপের মতো ঝুলছিল, যা এক আভিজাত্যের ছোঁয়া যোগ করেছিল।
ফ্যাশন ম্যাগাজিন ভোগকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে স্কট বলেন, "ফ্যাশনের সঙ্গে মজা করাটা জরুরি।" তিনি একই নকশায় একটি উজ্জ্বল গাঢ় নীল রঙের একটুকরা পোশাকও উপস্থাপন করেছিলেন, যেখানে প্রশ্নবোধক চিহ্ন ছিল।
এর পরের বছর, ২০১২ সালের শরৎ-শীতকালীন ক্যাটওয়াক শো আয়োজন করে শ্যানেল। সেখানে মঞ্চ সুপারম্যানের 'ফর্ট্রিস অব সলিটিউড'-এর মতো বলে মনে হয়েছিল সংবাদমাধ্যমের কাছে। মডেলরা হাঁটছিলেন বিশাল বেগুনি ও কালো রঙের জিওড-এর চারপাশে, যা মেঝে থেকে উঠে আসছিল। পুরো মঞ্চটি সাদা বালু দিয়ে ঢাকা ছিল, যা এক রহস্যময় আবহ সৃষ্টি করেছিল।
শুধু মডেলরাই সুপারম্যানের লোগোর বিভিন্ন সংস্করণ পরেননি। ১৯৯০ ও ২০০০-এর দশকে সুপারম্যানের 'এস' চিহ্ন সময়ের সংস্কৃতির সঙ্গে যুক্ত হয়ে এক ধরনের ব্যঙ্গাত্মক প্রতীকে পরিণত হয়।
১৯৯৩ সালে শিকাগোর এক শোতে স্ম্যাশিং পাম্পকিনসের ফ্রন্টম্যান বিলি করগান কালো রঙের একটি সোয়েটার পরেছিলেন, যার ওপর গোলাপি ও হলুদ রঙে সুপারম্যানের প্রতীক খচিত ছিল আর তার হাতায় লেখা ছিল 'সুপারস্লাট'।
এমনকি ব্যান্ডটি নিজেদের পণ্যের তালিকায় সুপারম্যানের আইকনিক 'এস' লোগো যুক্ত করেছিল, আর ২০০২ সালে এমিনেম নিজের জন্য তৈরি করেন উল্টো 'সুপার-ই' সংস্করণ, যা তার স্বতন্ত্র স্টাইলের প্রতিচ্ছবি হয়ে ওঠে।
এটি ১৯৭০-এর দশকে ক্রিস্টোফার রিভের প্রদর্শিত নিখুঁত পুরুষত্বের ঐতিহ্যবাহী ছবির চেয়ে অনেক দূরে ছিল। রিভ প্রতিদিন কয়েক ঘণ্টা শরীরচর্চা করতেন, যাতে সুপারম্যানকে একজন সরু-পাতলা লোকের মতো না দেখায়।
তবে শতকের পালাবদলের সঙ্গে, এই কমিক বইয়ের চরিত্রটি বহু সংগীতশিল্পী ও সৃজনশীল মানুষ নিজেদের মতো করে গ্রহণ করেছে। তাদের কাছে ক্রীড়াশক্তির চেয়ে শিল্পসত্তাই ছিল প্রধান।

আধুনিক ফ্যাশনে সুপারম্যানের প্রভাব
গত গ্রীষ্মে মার্ক জেকবস ১৯৯০-এর দশকের শেষের দিকে তৈরি করা ক্লাসিক 'এস' খচিত কাশ্মিরি সোয়েটারের হালনাগাদ সংস্করণ বাজারে এনেছেন। স্ট্রিটওয়্যার ডিজাইনার নিগোর সঙ্গে মিলে তৈরি করা এই আধুনিক পুলওভারটি অ্যালপাকা ও মেরিনো উলের সংমিশ্রণে তৈরি। এর দাম ৪৯৫ ডলার।
ফ্যাশন সচেতনরা গত মৌসুমে লন্ডন ফ্যাশন উইকের অতিথিদের মাঝে এই সোয়েটারটি দেখে থাকতে পারেন। একইভাবে, নিউইয়র্ক ফ্যাশন উইকে কোচ-এর শরৎ-শীত ২০২৪ শো-এর বাইরে দেখা গেছে ভিনটেজ ঘরানার সুপারম্যান টি-শার্ট।
অর্থাৎ এটা কোনো পাখি বা বিমানের চিহ্ন না। আপনি সম্ভবত যা দেখছেন, বিশেষ করে কোনো র্যাম্প শোতে সেটি আপনি সুপারম্যানের লোগোই দেখছেন।