ইউক্রেনে মার্কিন সেনা ছাড়া কি রাশিয়াকে ঠেকাতে পারবে ইউরোপ?

নিজ দেশের জেনারেলদের থেকেও যেন বিট্রেনের সামরিক বাহিনীর ওপর বেশি আস্থা মার্কিন ডোনাল্ড ট্রাম্পের—অন্তত ব্রিটেনের অনেক অবসরপ্রাপ্ত শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তার তুলনায়ও বেশি।
সম্প্রতি যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে এক সংবাদ সম্মেলনে ইউক্রেনের নিরাপত্তা সংক্রান্ত এক প্রশ্নের জবাবে ট্রাম্পের উত্তরে এমন ইঙ্গিতই মিলল। ট্রাম্প বলেন, 'ব্রিটিশ সেনারা অসাধারণ। তাদের সামরিক শক্তি চমৎকার, এবং তারা নিজেদের দেখভাল করতে সক্ষম'। তবে তিনি স্পষ্ট করে বলেননি, ব্রিটিশ সেনাবাহিনী আদৌ রাশিয়াকে মোকাবিলা করতে পারবে কি না।
শীর্ষ মার্কিন সামরিক কর্মকর্তারা প্রকাশ্যে ব্রিটিশ সেনাদের পেশাদারিত্বের প্রশংসা করলেও, ব্যক্তিগত আলোচনায় তারা যুক্তরাজ্যের সামরিক বাহিনীর সাম্প্রতিক সংকোচনের সমালোচনা করেছেন। বিশেষত, বর্তমানে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর নিয়মিত সদস্য সংখ্যা মাত্র ৭০ হাজারের কিছু বেশি, যা অনেক দেশের তুলনায় খুবই কম। যুক্তরাজ্য সফরে এক শীর্ষ মার্কিন জেনারেল এটিকে 'খুবই ছোট' বলে মন্তব্য করেছিলেন।
স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের আন্তর্জাতিক ইনস্টিটিউটের তথ্য অনুযায়ী, ক্রয়ক্ষমতার নিরিখে রাশিয়ার সামরিক বাজেট বর্তমানে ইউরোপের সম্মিলিত প্রতিরক্ষা ব্যয়ের চেয়েও বেশি। রাশিয়ার সামরিক ব্যয় ৪১ শতাংশ বেড়েছে এবং এখন এটি দেশটির জিডিপির ৬ দশমিক ৭ শতাংশের সমান। এর বিপরীতে, যুক্তরাজ্য ২০২৭ সালের মধ্যে প্রতিরক্ষা ব্যয় মাত্র ২ দশমিক ৫ শতাংশে উন্নীত করার পরিকল্পনা করছে।
ট্রাম্পের বক্তব্য থেকে স্পষ্ট, তিনি ইউক্রেনে মার্কিন সেনা পাঠানোর কথা ভাবছেন না—এমনকি সম্ভাব্য অস্ত্রবিরতির ক্ষেত্রেও নয়। যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা মূলত অর্থনৈতিক, বিশেষত দেশটির খনিজ সম্পদ ব্যবহারের ওপর গুরুত্ব দিচ্ছে তারা।
ট্রাম্প ইঙ্গিত দিয়েছেন, এটি রাশিয়ার জন্য একটি বাধা হতে পারে। তবে ট্রাম্প প্রশাসনও মনে করে, অর্থনৈতিক প্রভাবের পাশাপাশি কিছু সামরিক শক্তিও থাকা দরকার। ইউরোপীয় দেশগুলোর ওপরই সেই সামরিক শক্তি সরবরাহের দায়িত্ব পড়বে।
প্রশ্ন হলো, ইউরোপের কি পর্যাপ্ত সামরিক শক্তি আছে? সংক্ষেপে বললে—'না'। এ কারণেই ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী স্যার কিয়ার স্টারমার যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে অতিরিক্ত নিরাপত্তা নিশ্চয়তা চেয়ে আসছেন।
শুধু ব্রিটেন নয়, স্নায়ুযুদ্ধের পর ইউরোপের অন্যান্য দেশও তাদের সামরিক বাহিনীর আকার কমিয়েছে। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে প্রতিরক্ষা বাজেট আবার বাড়ানোর প্রবণতা দেখা যাচ্ছে।
তবে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি যে এক-দুই লাখ আন্তর্জাতিক সেনার প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছেন, তা একা ইউরোপের পক্ষে জোগান দেওয়া প্রায় অসম্ভব। পশ্চিমা কর্মকর্তারা বরং ৩০ হাজার সেনার একটি বাহিনী গঠনের পরিকল্পনা করছেন, যা ইউক্রেনের প্রধান শহর, বন্দর ও পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে।
এই বাহিনী সরাসরি যুদ্ধক্ষেত্রে মোতায়েন করা হবে না। ইউক্রেনের আকাশসীমা ও নৌপথ পর্যবেক্ষণের জন্য ইউরোপীয় যুদ্ধবিমান ও রণতরি মোতায়েন করা হতে পারে। তবে পশ্চিমা কর্মকর্তারাও স্বীকার করেছেন যে, এটি যথেষ্ট নয়।
এজন্যই তারা যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে একটি 'ব্যাকস্টপ' বা নিরাপত্তা জাল চাচ্ছেন, যাতে রাশিয়া মোতায়েনকৃত বাহিনীকে চ্যালেঞ্জ করার সাহস না পায় এবং ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী নিশ্চিত থাকতে পারেন যে, তার বাহিনী নিরাপদ থাকবে।
পশ্চিমা কর্মকর্তারা মনে করছেন, অন্তত ন্যূনতম পর্যায়ে হলেও যুক্তরাষ্ট্র ইউরোপীয় বাহিনীর জন্য 'কমান্ড ও কন্ট্রোল' ব্যবস্থা সরবরাহ করতে পারে এবং পোল্যান্ড ও রোমানিয়ায় অবস্থিত মার্কিন বিমানঘাঁটি থেকে যুদ্ধবিমান প্রস্তুত রাখতে পারে। ইউরোপের পক্ষে মার্কিন নজরদারি বা গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহের সমকক্ষ হওয়া সম্ভব নয়।
যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনকে অস্ত্র সরবরাহ অব্যাহত রাখার প্রতিশ্রুতি দিতেও পারে। যদিও ইউক্রেনে পশ্চিমা অস্ত্র সরবরাহের অনুপাতে সম্প্রতি ইউরোপ যুক্তরাষ্ট্রকে ছাড়িয়ে গেছে। এক পশ্চিমা সূত্র মতে, মার্কিন সরবরাহের মধ্যে সেরা অস্ত্র ছিল দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র ও বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা।
এ ছাড়া, ইউরোপীয় দেশগুলো বড় পরিসরে সামরিক অভিযান পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় লজিস্টিক সহায়তা পায় না। ইউক্রেনে পশ্চিমা অস্ত্র সরবরাহের পুরো ব্যবস্থাই মূলত মার্কিন লজিস্টিক সহায়তার ওপর নির্ভরশীল।
২০১১ সালে লিবিয়ায় ন্যাটোর বিমান হামলার সময়ও এই সীমাবদ্ধতা দেখা গিয়েছিল। নেতৃত্ব ইউরোপের হাতে থাকলেও মার্কিন সহায়তা ছাড়া তারা কার্যকর অভিযান চালাতে পারেনি। তখনও মিত্র দেশগুলো মার্কিন জ্বালানি সরবরাহকারী ট্যাঙ্কার ও লক্ষ্য নির্ধারণ প্রযুক্তির ওপর নির্ভর করেছিল।
তবে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী স্যার কিয়ার স্টারমার ওয়াশিংটন থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক সহায়তার কোনো নিশ্চিত প্রতিশ্রুতি ছাড়াই ফিরে এসেছেন। বিবিসিকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে যুক্তরাজ্যের স্বাস্থ্য সচিব ওয়েস স্ট্রিটিং বলেছেন, 'ডোনাল্ড ট্রাম্পের ন্যাটোর অনুচ্ছেদ ৫-এর প্রতি নতুন করে প্রতিশ্রুতি হয়ত যথেষ্ট হতে পারে।' এই অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, ন্যাটোর যেকোনো সদস্য রাষ্ট্রের ওপর হামলাকে পুরো জোটের ওপর হামলা হিসেবে গণ্য করা হবে।
তবে মার্কিন প্রতিরক্ষা সচিব পিট হেগসেথ আগেই স্পষ্ট করেছেন যে, ইউক্রেনে পাঠানো যে কোনো আন্তর্জাতিক বাহিনী ন্যাটোর অংশ হবে না এবং ন্যাটোর নিরাপত্তা চুক্তির আওতায়ও আসবে না। ফলে, এখন পর্যন্ত ইউরোপের জন্য ন্যাটোর মতো কোনো যৌথ নিরাপত্তা নিশ্চয়তা নেই।
ইউক্রেনকে দেওয়া ইউরোপের প্রতিশ্রুতি কঠিন পরীক্ষার মুখে পড়েছে। এই সপ্তাহের শেষে ইউরোপীয় নেতাদের সঙ্গে বৈঠক ডেকেছেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী। সেখানে বোঝা যাবে, ডোনাল্ড ট্রাম্পের কূটনৈতিক বার্তা সত্যিই অন্য দেশগুলোকে যুক্তরাজ্যের সঙ্গে ইউক্রেনে সেনা মোতায়েনে রাজি করাতে পারে কি না।
এখন পর্যন্ত ফ্রান্সই একমাত্র প্রধান ইউরোপীয় শক্তি, যারা এই বিষয়ে আগ্রহ দেখিয়েছে। উত্তর ইউরোপের কিছু দেশ যেমন, ডেনমার্ক, সুইডেন এবং বাল্টিক রাষ্ট্রগুলো বিষয়টি বিবেচনা করছে। তবে তারাও মার্কিন নিরাপত্তা নিশ্চয়তা চায়। অন্যদিকে, স্পেন, ইতালি ও জার্মানি এই পরিকল্পনার বিপক্ষে রয়েছে।
স্যার কিয়ার এখনো হয়ত আশাবাদী যে, আলোচনার সুযোগ রয়েছে এবং যুক্তরাষ্ট্র শেষ পর্যন্ত ইউরোপীয় বাহিনীকে সমর্থন দেবে। তবে ট্রাম্পের করা মূল প্রশ্নটি থেকেই যাচ্ছে—ব্রিটেন কি রাশিয়ার সেনাবাহিনীর মোকাবিলা করতে পারবে?
রাশিয়ার সেনাবাহিনী হয়ত ক্রমশ দুর্বল হতে পারে, কিন্তু ব্রিটেনের একার পক্ষে রাশিয়াকে মোকাবিলা করা সম্ভব নয়।