কাসু মারজু: বিশ্বের ‘সবচেয়ে বিপজ্জনক পনির’

ইতালির সার্দিনিয়া দ্বীপের খাঁজকাটা পাহাড়ি অঞ্চলে মেষপালকরা তৈরি করেন কাসু মারজু, এক ধরনের পচা পনির, যা পোকামাকড় দিয়ে ভর্তি থাকে। ২০০৯ সালে গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ড এটিকে 'বিশ্বের সবচেয়ে বিপজ্জনক পনির' হিসেবে ঘোষণা করেছে।
চিজ স্কিপার মাছি (Piophila casei) সার্দিনিয়ার লবণাক্ত পেকোরিনো পনির ফিওরে সার্ডো-এর ফাটলে ডিম পাড়ে। সেখান থেকে বের হয়ে আসা ম্যাগট (মাছির লার্ভা) পনিরের ভেতরে গর্ত করে প্রোটিন হজম করে এবং সেটিকে নরম ও ক্রিমের মতো উপাদানে পরিণত করে।
পনির বিক্রেতা তখন ওপরের স্তরটি ফাটিয়ে খানিকটা তুলে আনেন, যা তুলনামূলকভাবে ম্যাগটের সংস্পর্শে কম আসে। তবে এই পনির দুর্বল হৃদয়ের মানুষদের জন্য নয়, কারণ এর ভেতরের পোকাগুলো হঠাৎ করে ছটফট করতে শুরু করে।
কিছু বিক্রেতা সেন্ট্রিফিউজে ঘুরিয়ে ম্যাগটগুলো পনিরের সঙ্গে মিশিয়ে ফেলেন। আবার অনেকেই সরাসরি সেটি চেখে দেখেন, সবকিছু একসাথে মুখে তুলে নেন!
কাসু মারজুর স্বাদ অত্যন্ত শক্তিশালী ও ঝাঁঝালো। কিছু মানুষের দাবি, এটি একটি উত্তেজক (আফ্রোডিজিয়াক) খাবার। অন্যরা বলেন, এটি মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য বিপজ্জনক হতে পারে, কারণ ম্যাগট থেকে মাইয়াসিস নামক রোগ হতে পারে। তবে, এখন পর্যন্ত কাসু মারজুর সাথে এর কোনো সম্পর্ক পাওয়া যায়নি।
এই পনিরটি বাণিজ্যিকভাবে বিক্রি নিষিদ্ধ, তবে সার্দিনিয়ার লোকেরা শতাব্দী ধরে এটি খাচ্ছে, ম্যাগট সহ।
সার্দিনিয়ার খাদ্যবিশারদ পাওলো সোলিনাস বলেন, 'ম্যাগটের উপদ্রব এই পনিরের মন্ত্র এবং আনন্দ।'
তিনি আরও বলেন, কিছু সার্দিনিয়ান কাসু মারজুর কথা ভাবলেই অস্বস্তি বোধ করেন, তবে যারা সারা জীবনের জন্য লবণাক্ত পেকোরিনো খেয়ে বেড়ে উঠেছেন, তারা এর তীব্র স্বাদ উপভোগ করেন।
প্রাচীন রন্ধন কৌশল
পর্যটকরা সার্দিনিয়াতে ঘুরতে আসলে সাধারণত পোরসেডু সারডো (ধীরে ভুনা করা পর্ক), পানে কারাসাউ (প্রথাগত পাতলা রুটি) বা ফিওরে সার্ডো (সার্দিনিয়ার পেকোরিনো পনির) খেতে পছন্দ করেন। তবে, অনেক সাহসী পর্যটক কাসু মারজুও চেখে দেখেন। এটি কোনও অদ্ভুত আকর্ষণ নয়, বরং একটি প্রাচীন রীতিকে টিকিয়ে রাখে এবং খাবারের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে ধারণা দেয়।
সার্দিনিয়ান সাংবাদিক ও খাদ্যবিশারদ জিওভানি ফানসেলো সার্দিনিয়ার খাদ্য ইতিহাস নিয়ে দীর্ঘদিন গবেষণা করছেন। তিনি বলেন, 'আমাদের ভাষা ছিল লাতিন এবং আমাদের উপভাষায় আমরা আমাদের প্রাচীন রন্ধনকৌশলের চিহ্ন খুঁজে পাই।'
ফানসেলোর মতে, ১৯০৯ সাল পর্যন্ত সার্দিনিয়ার রেসিপির কোনো লিখিত রেকর্ড ছিল না। তখন মদেনার ডাক্তার ভিত্তোরিও আগনেতি সার্দিনিয়ায় এসে 'লা নুভা কুচিনা ডেল্লে স্পেশালিতা রিজিওনালি' [আঞ্চলিক বিশেষত্বের নতুন রান্না] নামক বইয়ে ছয়টি রেসিপি সংকলন করেন।

ফানসেলো বলেন, 'আমরা সবসময়ই পোকামাকড় খেয়েছি। প্লিনি দ্য এল্ডার এবং অ্যারিস্টটলও এ সম্পর্কে বলেছেন।'
ইতালির আরও দশটি অঞ্চলে ম্যাগটযুক্ত পনিরের নিজস্ব রূপ রয়েছে। অঞ্চলভিত্তিক পনিরগুলোকে বিশেষ কিছু হিসেবে দেখা হয়, যেমনটা কাসু মারজু সার্দিনিয়ার খাদ্য সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ।
এই পনিরটির নানা নাম রয়েছে, যেমন কাসু বেচ্চি, কাসু ফ্যাতিত্তু, হাসু মুহিদু, ফরমাজিও মার্চিও। সার্দিনিয়ার প্রতিটি উপ-অঞ্চল এটি তৈরির নিজস্ব পদ্ধতি অনুসরণ করে, ভিন্ন ধরনের দুধ ব্যবহার করে।
'যাদু এবং অতিপ্রাকৃত ঘটনা'
ফানসেলো বলেন, গর্ডন রামসের মতো রন্ধনশিল্পীদের কাজ থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে খাবারের প্রতি আগ্রহী মানুষরা এই পনির খুঁজতে আসেন। তিনি বলেন, 'তারা আমাদের জিজ্ঞেস করে, 'কাসু মারজু কীভাবে তৈরি করা হয়?' এটা আমাদের ইতিহাসের অংশ। আমরা এই খাবারের সন্তান। এটা সম্ভাবনা, যাদু এবং অতিপ্রাকৃত ঘটনার ফল।'
ফানসেলোর বাবা সেবাস্তিয়ানো একজন পশুপালক ছিলেন। তিনি কাসু মারজু তৈরি করতেন। তিনি জানান, তার বাবার কাছে কাসু মারজু ছিল একটি স্বর্গীয় উপহার। যদি তার পনিরে ম্যাগট না থাকত, তিনি হতাশ হয়ে পড়তেন। কিছু পনির পরিবারে থাকত, কিছু বন্ধু বা যারা চাইতেন তাদের কাছে পাঠানো হতো।

কাসু মারজু সাধারণত জুন মাসের শেষে তৈরি হয়। তখন স্থানীয় মেষের দুধ পরিবর্তন হতে শুরু করে এবং গ্রীষ্মের তাপে ঘাস শুকিয়ে যায়।
ফানসেলো বলেন, পনির বানানোর দিনে গরম সিরোক্কো বাতাস বয়ে গেলে সেটি পনিরের পরিবর্তন প্রক্রিয়াকে আরও কার্যকরী করে। কারণ এতে পনিরের গঠন দুর্বল হয়ে যায় এবং মাছির কাজ সহজ হয়।
তিন মাস পর এই বিশেষ পনির তৈরি হয়।
উচ্চ জরিমানা
যদিও এই পনিরটি অনেক জনপ্রিয়, এর আইনগত অবস্থা স্পষ্ট নয়।
কাসু মারজু সার্দিনিয়ার ঐতিহ্যবাহী পণ্য হিসেবে নিবন্ধিত হওয়ায় এটি স্থানীয়ভাবে সুরক্ষিত। তবে ১৯৬২ সাল থেকে ইতালি সরকার এটিকে নিষিদ্ধ করেছে, কারণ দেশটির আইন অনুযায়ী পরজীবীর সংক্রমণ থাকা খাবার খাওয়া নিষিদ্ধ।
এই পনির বিক্রি করলে হাজার হাজার ইউরো জরিমানা হতে পারে। কিন্তু সার্দিনিয়ার লোকেদের যখন তাদের প্রিয় পনিরের নিষেধাজ্ঞা সম্পর্কে প্রশ্ন করা হয়, তারা হাসেন।
সম্প্রতি ইউরোপীয় ইউনিয়ন নতুন খাদ্য ধারণার আওতায় ম্যাগট খাওয়ার বিষয়টি নিয়ে পুনরায় গবেষণা শুরু করেছে কারণ পোকামাকড় খাওয়ার প্রচলন বিশ্বের অনেক স্থানেই রয়েছে।
গবেষণা দেখিয়েছে, এগুলো খেলে গবাদি পশু পালন থেকে উদ্ভূত কার্বন ডাই অক্সাইড নিঃসরণ কমানো যেতে পারে এবং তা জলবায়ু সংকট নিরসনে সহায়ক হতে পারে।