ল্যাবে তৈরি পনির আসছে বাজারে, কিন্তু খেতে রাজি হবেন আপনি?

লন্ডনের স্ট্র্যাটফোর্ড এলাকার একটি সাধারণ ভবনের ভেতরে ব্রিটিশ স্টার্টআপ 'বেটার ডেইরি' এমন এক ধরনের পনির তৈরি করছে, যার উৎপাদনে গরুর কোনো দুধ লাগে না। প্রতিষ্ঠানের দাবি, এই পনির স্বাদে দুধের তৈরি পনিরের কাছাকাছি। খবর বিবিসির।
বিশ্বজুড়ে কয়েকটি কোম্পানি এমন ল্যাব-তৈরি পনির বাজারে আনতে কাজ করছে। তবে ব্রিটেনে সাম্প্রতিক সময়ে নিরামিষভিত্তিক খাদ্যের চাহিদা কিছুটা কমেছে বলে জানিয়েছে 'অ্যাগ্রিকালচার অ্যান্ড হর্টিকালচার ডেভেলপমেন্ট বোর্ড' ।
তাদের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালের প্রথম প্রান্তিকে যুক্তরাজ্যে উদ্ভিজ্জ উপাদানে তৈরি পনিরের বিক্রি কমেছে প্রায় ২৫.৬ শতাংশ, অথচ গরুর দুধের তৈরি পনিরের বিক্রি বেড়েছে ৩ শতাংশ।
এর একটি কারণ হতে পারে, ব্রিটেনে নিরামিষভোজী মানুষের সংখ্যা এখনও খুবই কম—সরকারি হিসাব অনুযায়ী মাত্র ১ শতাংশ, যদিও ভেগান সোসাইটি বলছে, এটি ৩ শতাংশ।
ভেগান সোসাইটি অবশ্য বলছে, মাংস ও দুগ্ধজাত খাবারবিহীন বাজার এখনও প্রতিযোগিতামূলক ও স্থিতিশীল।
এদিকে স্বাস্থ্য ও দামের বিষয়টিও গ্রাহকদের মনে প্রভাব ফেলছে। এক জরিপে দেখা গেছে, অতিরিক্ত প্রক্রিয়াজাত খাবার নিয়ে দুশ্চিন্তা এখন দ্বিতীয় সর্বোচ্চ (প্রথমটি হচ্ছে মূল্য)। আর উদ্ভিজ্জ পনির সাধারণত গরুর দুধের পনিরের চেয়ে বেশি দামে বিক্রি হয়।
তাহলে কি এই ল্যাব-তৈরি পনির সফল হবে? কেউ কেউ মনে করছেন, সামনে সুযোগ রয়েছে।
নেদারল্যান্ডসের 'দোজ ভেগান কাউবয়েজ' নামের একটি প্রতিষ্ঠান আশা করছে, চলতি বছরই যুক্তরাষ্ট্রে তাদের পনির পৌঁছাবে। তবে ইউরোপে আসতে সময় লাগবে আরও কয়েক বছর—কারণ ইউরোপে ল্যাব-তৈরি পনির 'নতুন খাবার' হিসেবে বিবেচিত হয় এবং বিক্রির আগে অনুমোদন প্রয়োজন।
প্রতিষ্ঠানটির সিইও হিলে ফান ডার কা বলেন, আপাতত চাহিদা কম হলেও তারা চাইছেন ধীরে ধীরে এমন পনির বাজারে আনতে, যেগুলো মানুষ সাধারণত আলাদাভাবে খেয়াল করে না।
"যখন আপনি ফ্রোজেন পিজ্জা কিনছেন, তখন ভাবেন না সেখানে কী ধরনের পনির আছে," বললেন হিলে। "সেখানেই আমরা পরিবর্তন আনতে চাই।"
ফ্রান্সের কোম্পানি 'স্ট্যান্ডিং ওভেশন' ২০২৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রে, আর ২০২৭ সালে ইউকে ও ইউরোপে বাজারে আসার পরিকল্পনা করছে।
অন্যদিকে স্ট্র্যাটফোর্ডের 'বেটার ডেইরি' এখনো বাজারে তাদের পনির আনেনি—কারণ এই মুহূর্তে এর উৎপাদন খরচ অনেক বেশি।
তবে কোম্পানির প্রধান নির্বাহী জেভান নাগারাজাহ আশা করছেন, আগামী তিন-চার বছরের মধ্যে দাম কমিয়ে এটি প্রথমে কারিগরি পনির বিক্রেতাদের কাছে, পরে সাধারণ বাজারেও আনা যাবে।
স্বাদ কেমন?
'বেটার ডেইরি' একটি পরীক্ষার সুযোগ দিয়েছিল একজন রীতিমতো পনিরপ্রেমী প্রতিবেদককে।
এই কোম্পানি আপাতত শুধু চেডার পনির তৈরি করছে। কারণ তাদের মতে, ভেগান পনিরের মান সাধারণত দুধের পনির থেকে অনেকটাই পিছিয়ে। তারা নরম পনির, ব্লু চিজ, মোৎজারেলাও তৈরি করেছে, তবে চেডারে ফারাক সবচেয়ে স্পষ্ট।
তাদের গবেষণা শুরু হয় খামির (ইস্ট) দিয়ে, যেটি জেনেটিকভাবে পরিবর্তন করে দুধের মূল প্রোটিন কেসিন উৎপাদন করানো হয়—আলকোহলের বদলে। ঠিক একই প্রক্রিয়ায় ইনসুলিন উৎপাদন হয়, যা আগে শূকরের শরীর থেকে নিতে হতো।
কিছু কোম্পানি এই কাজের জন্য ব্যাকটেরিয়া বা ফাঙ্গি ব্যবহার করে।
একবার কেসিন তৈরি হলে, তা উদ্ভিজ্জ উৎস থেকে নেওয়া চর্বি এবং দুধের অন্য উপাদানের সঙ্গে মিশিয়ে শুরু হয় সাধারণ পনির তৈরির প্রক্রিয়া।
এই ল্যাব-তৈরি চেডার পনির এর স্বাদ আসলের বেশ কাছাকাছি। তবে অল্প সময়ের তৈরি পনিরগুলো একটু রাবার এর মতো ও সামান্য লবণ বেশি। তবে বার্গারে সাধারণ পনিরের মতোই এগুলো গলে যায়।
জেভান স্বীকার করেন, স্বাদের আরও উন্নতি দরকার। ভবিষ্যতে তিনি চান, তাদের তৈরি 'নন-ডেইরি মিল্ক' ব্যবহার করে শিল্পপতিরা নিজেদের মতো করে পনির তৈরি করুন।
কারণ দুধের চর্বি না থাকায়, উদ্ভিজ্জ চর্বি দিয়েই স্বাদ ঠিক রাখতে হচ্ছে।

"ভেগান পনিরে অনেক সময় অদ্ভুত স্বাদ থাকে," বলেন 'বেটার ডেইরি'র বিজ্ঞানী কেট রয়েল। "বিশেষ করে বাদাম বা নারকেলজাত চর্বি ব্যবহারে কিছু স্বাদ আসে, যা সাধারণ পনিরে থাকে না।"
'দোজ ভেগান কাউবয়েজ' তাই এমন পনিরে মন দিচ্ছে, যেগুলো সহজে বদলানো যায়—যেমন বার্গার বা পিজ্জার পনির।
'স্ট্যান্ডিং ওভেশন' বলছে, তাদের তৈরি কেসিন দিয়ে ক্যামেম্বারসহ আরও অনেক ধরনের পনির তৈরি সম্ভব।
তবে কি মানুষ কিনবে?
এই প্রশ্নের উত্তর সহজ নয়। এক জরিপ বলছে, যারা গত বছর ভেগান পনির কিনেছেন, তাদের ৪০ শতাংশ আর দ্বিতীয়বার কেনেননি—সম্ভবত স্বাদের কারণেই।
ভেগান সোসাইটির ড্যামিয়ান ওয়াটসন বলেন, "সব ভেগান যে মাংস বা দুধের মতো স্বাদ চান, তা নয়। কেউ চান মিলুক, আবার কেউ চান একদম আলাদা কিছু।"
'ডেইরি ইউকে'র প্রধান নির্বাহী জুডিথ ব্রায়ান্স বলেন, "এখনো প্রমাণ নেই যে ল্যাব-তৈরি পনির বাজার থেকে দুধের পনিরের জায়গা কেড়ে নেবে।"
তবে 'বেটার ডেইরি' এবং 'ভেগান কাউবয়েজ' দুই কোম্পানিই পনির নির্মাতাদের সঙ্গে অংশীদারিত্ব গড়ে তুলছে, যাতে খরচ কমানো যায়। 'স্ট্যান্ডিং ওভেশন' ইতোমধ্যে বেবিবেল প্রস্তুতকারী 'বেল'-এর সঙ্গে চুক্তি করেছে।
তাদের সিইও ইভান শারডনন বলেন, এখনকার ভেগান পনিরের প্রথম আগমণ ব্যর্থ হলেও, ভবিষ্যতের উন্নত মানের পনির সেই ঘাটতি পূরণ করতে পারবে।
এদিকে অতি-প্রক্রিয়াজাত খাবার নিয়ে আশঙ্কাও বড় একটি চ্যালেঞ্জ। তবে এই কোম্পানিগুলোর দাবি—ল্যাকটোস নেই, কোলেস্টেরল নেই, স্যাচুরেটেড ফ্যাট কম—এসব কারণে ল্যাব-তৈরি পনির স্বাস্থ্যকর হতে পারে।
তাদের মতে, যেকোনো পনিরই আসলে প্রক্রিয়াজাত খাবার।
হিলে বলেন, মানুষ এখনো গবাদিপশু খামারকে "প্রাকৃতিক" ভাবলেও বাস্তবে তা পুরোপুরি শিল্পায়িত।
"আমরা মানুষের চোখে এই পনির তৈরির বাস্তবতা তুলে ধরতে চাই," বললেন তিনি।
অনুবাদ: নাফিসা ইসলাম মেঘা