ধীরে কিন্তু নিখুঁতভাবে ডিম সেদ্ধ করার বৈজ্ঞানিক উপায়

বিজ্ঞানীরা পারফেক্ট ডিম সেদ্ধ করার উপায় উদ্ভাবন করেছেন। তবে আশ্চর্যজনকভাবে এ প্রক্রিয়ায় ডিম সেদ্ধ করতে সময় লাগবে আধা ঘণ্টা।
বিবিসি-এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নিখুঁতভাবে ডিম সেদ্ধ করা কঠিন, তা অস্বীকার করার উপায় নেই। এ ডিম সিদ্ধের কারণে সকালের নাস্তা অনেক সময় হতাশাজনক হয়ে উঠে। কারণ মাঝে মধ্যে দেখা যায়, ডিম কখনো বেশি সিদ্ধ হয়ে যায়। তখন ডিমের খোসা ভেঙে টোস্ট ডুবিয়ে খেতে গেলে দেখা যায় কুসুম শুকনো ও ঝুরঝুরে হয়ে গেছে। আবার দেখা যায় কম সিদ্ধ হলে ডিমের সাদা অংশ কাচা রয়ে গেছে এবং সেখান থেকে আঁশটে গন্ধ আসছে।
সমস্যার মূল কারণ হলো, ডিমের কুসুম ও অ্যালবুমিন (সাদা অংশ) দুই ভিন্ন তাপমাত্রায় রান্না হয়। কুসুম সেদ্ধ হতে মাত্র ৬৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস (১৪৯ ডিগ্রি ফারেনহাইট) তাপমাত্রা প্রয়োজন হয়, তবে অ্যালবুমিনের জন্য আরও বেশি তাপ, প্রায় ৮৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস (১৮৫ ডিগ্রি ফারেনহাইট) দরকার হয়।
তাই প্রচলিত পদ্ধতিতে ডিম সেদ্ধ করা মানে এই দুই বিপরীত সত্যের মধ্যে সমঝোতা করা। যদি ১০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস (২১২ ডিগ্রি ফারেনহাইট) তাপমাত্রায় ডিম সেদ্ধ করা হয় তাহলে খুব দ্রুতই ডিমের সাদা অংশ যথাযথভাবে রান্না হয়ে যাবে। তবে এতে কুসুম পুরোপুরি শক্ত হয়ে যাবে। শক্ত কুসুম কিছু মানুষের পছন্দ হলেও যারা নরম বা আধা-তরল কুসুম পছন্দ করেন তার জন্য বিষয়টি হতাশার।
ডিম রান্নার আরেকটি পদ্ধতি হল সও ভেড। এ প্রক্রিয়ায় ডিমকে ৬০ থেকে ৭০ ডিগ্রি সেলসিয়াস (১৪০-১৫৮ ডিগ্রি ফারেনহাইট) তাপমাত্রার পানির মধ্যে এক ঘণ্টা রেখে দেওয়া হয়। এতে কুসুম সুস্বাদুভাবে নরম ও আধা-তরল থাকে। কিন্তু অনেক সময় সাদা অংশ কাঁচা ও আঁশটে থেকে যেতে পারে।
তবে চিন্তার কিছু নেই, কারণ গবেষকরা এখন নিখুঁতভাবে ডিম সেদ্ধ করার আদর্শ পদ্ধতি আবিষ্কার করেছেন। শুধু তাই নয়, তারা দেখিয়েছেন যে এই পদ্ধতিতে রান্না করা ডিম শুধু সুস্বাদুই নয়, এটি স্বাস্থ্যের জন্যও বেশি উপকারী।
নতুন গবেষণাপত্রে, ইতালির জাতীয় গবেষণা কাউন্সিলের (এনআরসি) পোজুয়োলি শাখার বিজ্ঞানী পেলেগ্রিনো মুস্তোর নেতৃত্বাধীন গবেষকরা প্রথমে কম্পিউটেশনাল ফ্লুইড ডায়নামিক্স (সিএফডি) ব্যবহার করে ডিম সেদ্ধ করার প্রক্রিয়া অনুকরণ করেছেন।
সিএফপি হল একটি বিজ্ঞান যেখানে কম্পিউটার ব্যবহার করে তরল ও গ্যাসের প্রবাহ কেমন হবে তা আগে থেকে ঠিখ করে দেওয়া হয়। এটি ভর, গতি ও শক্তি সংরক্ষণের মতো পদার্থবিজ্ঞানের মূল নীতিগুলোর ভিত্তিতে কাজ করে।

সিমুলেশনে একটি নতুন পদ্ধতির প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে—যা বেশিরভাগ পেশাদার ও অপেশাদার রাঁধুনিদের জন্য একদমই অপরিচিত হতে পারে। কিন্তু এটি আরও উন্নত ফলাফল দিতে পারে।
এই পদ্ধতিকে গবেষকরা 'পর্যায়ক্রমিক রান্না' বা পিরিয়ডিক কুকিং নাম দিয়েছেন। এতে ডিমকে ১০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস (২১২ ডিগ্রি ফারেনহাইট) তাপমাত্রায় ফুটন্ত পানির পাত্রে রাখা হয়, তারপর ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস (৮৬ ডিগ্রি ফারেনহাইট) উষ্ণ পানির বাটিতে স্থানান্তর করা হয়। সর্বোত্তম ফলাফলের জন্য ডিমকে প্রতি দুই মিনিট পরপর এই দুটি তাপমাত্রার মধ্যে স্থানান্তর করতে হয় এবং মোট ৩২ মিনিট ধরে এই প্রক্রিয়া চালিয়ে যেতে হয়।
তবে, এই পদ্ধতিটি তাদের জন্য আদর্শ নয় যারা রান্নার সময় বারবার রান্নাঘর ছেড়ে অন্য কাজে ব্যস্ত থাকেন এবং ডিমকে অযত্নে ফেলে রাখতে পছন্দ করেন।
যদি আপনি এই প্রক্রিয়ায় পরিশ্রম করতে রাজি থাকেন, তবে ফলাফল হবে আশানুরূপ। গবেষকরা বাস্তবে যখন এ প্রক্রিয়ায় ডিম সেদ্ধ করেন তার স্বাদ অসাধারণ ছিল।
গবেষকরা নিউক্লিয়ার ম্যাগনেটিক রেজোন্যান্স (এনএমআর) এবং হাই-রেজোলিউশন ম্যাস স্পেকট্রোমেট্রি (এইচআরএমএস) ব্যবহার করে নতুন প্রক্রিয়ায় সেদ্ধ করা ডিমের নমনীয়তা, স্বাদ ও রাসায়নিক গঠন বিশ্লেষণ করে দেখেন এটি প্রচলতি পদ্ধতির তুলনায় এর স্বাদ ও পুষ্টিগুণ অনেক উন্নত।
ফলাফলে দেখা গেছে যে পর্যায়ক্রমে রান্না করা ডিমের কুসুম ছিল সও ভেড পদ্ধতিতে রান্না করা ডিমের মতো নরম, যা ইতিবাচক দিক। তবে, সও ভেড পদ্ধতিতে রান্না করা ডিমের বিপরীতে, এতে সাদা অংশ (অ্যালবুমিন) কাঁচা বা অতিরিক্ত তরল থাকেনি বরং এটি সাধারণভাবে সিদ্ধ করা ডিমের কাছাকাছিই ছিল।
গবেষণাপত্রের লেখকদের মতে, এর সম্ভাব্য কারণ হলো— পর্যায়ক্রমে রান্নার সময় ডিমের সাদা অংশের তাপমাত্রা ৩৫°সেলসিয়াস থেকে ১০০°সেলসিয়াস পর্যন্ত ওঠানামা করানোর কারণে কুসুমের তাপমাত্রা পুরো সময় ধরে ৬৭° সেলসিয়াসে স্থিতিশীল ছিল।
সবচেয়ে আকর্ষণীয় বিষয় হলো, রাসায়নিক বিশ্লেষণে দেখা গেছে যে পর্যায়ক্রমে রান্না করা ডিমের কুসুমে অন্যান্য পদ্ধতিতে রান্না করা ডিমের তুলনায় বেশি পলিফেনল থাকে। পলিফেনল মূলত উদ্ভিদে পাওয়া। এটি এক ধরনের মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট যা স্বাস্থ্যের জন্য অনেক উপকারী। এই যৌগগুলোর অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ও অ্যান্টি-ইনফ্লেমেটরি গুণাগুণও রয়েছে।
উদ্ভিদ সাধারণত প্রতিকূল পরিবেশগত অবস্থার (যেমন অতিবেগুনি রশ্মি, খরা বা পোকামাকড়ের আক্রমণ) বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষা হিসেবে পলিফেনল তৈরি করে। তবে সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, এগুলো মানুষের স্বাস্থ্যের জন্যও উপকারী। পর্যবেক্ষণমূলক গবেষণাগুলোতে দেখা গেছে যে খাদ্যাভ্যাসে বেশি পরিমাণ পলিফেনল গ্রহণ করলে হৃদ্রোগ, নির্দিষ্ট কিছু ধরনের ক্যান্সার এবং স্নায়বিক অবক্ষয়জনিত রোগের ঝুঁকি কমতে পারে।
সুতরাং, সকালের নাশতায় 'ডিপি এগস' ও টোস্টের সাথে পিরিয়ডিক কুকিং পদ্ধতিতে রান্না করা ডিম খাওয়ার আরও একটি স্বাস্থ্যকর কারণ পাওয়া গেল!