চাকরি পাওয়ার জন্য ডাকতে হলো গরুর মতো হাম্বা রবে, দিতে হলো হামাগুড়ি

ইংল্যান্ডের ব্রিস্টল শহরে আইনজীবীদের একটি অফিসে চাকরির ইন্টারভিউ দিতে গিয়েছিলেন লে নামে এক নারী। তিনি সেখানে সময়মতোই পৌঁছেছিলেন। কিন্তু পৌঁছানোর ২০ মিনিট পর সেদিনের ইন্টারভিউটি বাতিল করা হয় এবং লেকে পরের দিন আসতে বলা হয়।
এ কথা শুনে ফিরে যান লে। কিন্তু পরে তার ফোনে একটি মেসেজ আসে। যা দেখে তার মন খারাপ হয়ে যায়। মেসেজটিতে লেখা ছিল ইন্টারভিউটি 'বাতিল' করার ঘটনাটি ছিল একটি পরীক্ষা, যেটিতে তিনি অকৃতকার্য হয়েছেন। তাই সেই চাকরিটিও আর পাওয়া হয়নি লের। খবর বিবিসির।
লে বলেন, এই অভিজ্ঞতাটি ছিল 'পুরোপুরি উদ্ভট'। আর এ অভিজ্ঞতাই তাকে তার নিজের ব্যবসা শুরু করতে অনুপ্রাণিত করেছিল।
নিয়োগ সংস্থা হেস এর তথ্যমতে, লে শুধু একাই নন, নতুন একটি চাকরির জন্য ইন্টারভিউ দিতে গিয়ে তার মতো অর্ধেকেরও বেশি মানুষের নেতিবাচক অভিজ্ঞতা হয়েছে।
নেতিবাচক অভিজ্ঞতা হওয়া বহু মানুষের সঙ্গে কথা বলেছে বিবিসি।
এইজিন ফু নামে আরেক ব্যক্তিও ইন্টারভিউ দিতে গিয়ে লের মতো অদ্ভুত অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হন। তিনি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে স্টুডেন্ট অ্যাম্বাসেডরের চাকরির জন্য আবেদন করেছিলেন। একটি গ্রুপ ইন্টারভিউয়ের সময় তাদের প্রত্যেককে হামাগুড়ি দিতে এবং মুখে 'গরুর মতো হাম্বা হাম্বা' করে শব্দ করতে বলা হয়েছিল।
ফু বলেন, 'আমরা তিন থেকে চার মিনিট ধরে সেটি করেছিলাম। ওই সময় আমি বেশ বিরক্ত হয়েছিলাম। এটি অত্যন্ত অনুপযোগী ছিল।'
ইন্টারভিউ গ্রহণকারীরা অবশ্য বলছিলেন যে তারা এর মধ্য দিয়ে চাকরিপ্রার্থীরা কতটুকু মজার মানুষ তা দেখতে চেয়েছিলেন। তবে ফুর সন্দেহ হলো- ইন্টারভিউ গ্রহণকারীরা হয়ত তাদের ক্ষমতা প্রয়োগ করেছিলেন।
'আপনি আর কত বছর কাজ করতে পারবেন বলে মনে হয়?'
যুক্তরাষ্ট্রের মিসৌরি অঙ্গরাজ্যের জুলি নামে একজন বলছিলেন, মাঝে মাঝে ইন্টারভিউ গ্রহণকারী ব্যক্তিরা যার ইন্টারভিউ নিচ্ছেন তার ওই সময়ের মানসিক অবস্থা কিংবা ইন্টারভিউ প্রক্রিয়া নিয়ে তার অনুভূতির বিষয়ে 'সত্যিই বিচ্ছিন্ন' থাকেন।
২০২২ সালে জুলি খণ্ডকালীন কপিরাইটারের চাকরির জন্য ভিডিও ইন্টারভিউ দিয়েছিলেন। সেখান থেকেই তার এ ধারণা তৈরি হয়।
জুলি জানান, প্রথম দিকে তার মনে হয়েছিল সবকিছু ঠিকঠাকই চলছে। প্রতিটি ধাপই তিনি উত্তীর্ণ হচ্ছিলেন। কিন্তু শেষের দিকে এসে ইন্টারভিউ গ্রহণকারী তাকে জিজ্ঞাসা করেন, 'আপনি আর কত বছর কাজ করতে পারবেন বলে মনে হয়?'
তখন জুলির বয়স সবেমাত্র ৬০ বছর ছুঁয়েছে। আর ওই সময়ে অবসর নেওয়ারও কোনো চিন্তা-ভাবনা তার ছিল না।
বয়সবাদই একমাত্র কুসংস্কার নয় যেটির অভিজ্ঞতা ইন্টারভিউয়ের সময় কারও কারও হতে পারে। এমন আরও বেশ কিছু নেতিবাচক বিষয় রয়েছে।
ইন্টারভিউয়ের অভিজ্ঞতা বলতে গিয়ে কন্টেন্ট মার্কেটিং ম্যানেজার পার্ল কাসিরে জানান, ইতালির মিলানের একটি ফ্যাশন ব্র্যান্ডের জন্য দূরবর্তী এক এলাকার পিআর হিসেবে চাকরির ইন্টারভিউ দিয়েছিলেন তিনি। তাকে তার ঐতিহ্য বা উত্তরাধিকার সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল।
পার্ল শৈশবে পড়াশোনা ও বসবাসের জন্য উগান্ডা থেকে ইউরোপে পাড়ি জমান। এখন তিনি লন্ডনে থাকেন।
পার্ল জানান, ইউরোপে পাড়ি জমানোর পরিপ্রেক্ষিতে নিয়োগদাতারা পার্লকে লন্ডনের মজুরি কাঠামোর পরিবর্তে উগান্ডার মজুরি কাঠামো অনুযায়ী বেতনের প্রস্তাব দেন। তিনি সে প্রস্তাব ফিরিয়ে দেন এবং চাকরির আবেদনটি বাতিল করেন।
আইটি ইঞ্জিনিয়ার টম (ছদ্মনাম) জানালেন আরেক অভিজ্ঞতার কথা। ইন্টারভিউ প্রক্রিয়া চলাকালে কথাবার্তা বলার পরিবর্তে তাকে বলা হয় গুদাম সহকারী হিসেবে চাকরির জন্য প্রশ্নোত্তর চিত্রায়ণ করতে।
টম জানান, ইন্টারভিউ গ্রহণকারীদের এমন কথা শুনে তার মনে হয়েছিল তিনি যেন যোগাযোগ ও মিথস্ক্রিয়া করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছেন।
'আপনার কি সন্তান আছে?'
বিবিসির সাথে আলাপকালে অনেকেই বলেছেন যে নিয়োগের সময় জেন্ডার সংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়েও তারা বৈষম্যের শিকার হয়েছেন।
নিয়োগ বিষয়ক প্ল্যাটফর্ম অ্যাপ্লাইডের তথ্য অনুসারে, নিয়োগ প্রক্রিয়া চলাকালীন প্রতি পাঁচজনের মধ্যে একজন নারীকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছে যে তাদের সন্তান আছে কি না কিংবা সন্তান নেওয়ার বিষয়ে তাদের পরিকল্পনা কি।
এমন অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হওয়া ব্যক্তিদের একজন অ্যাপ্লাইডের প্রধান নির্বাহী খ্যাতি সুন্দারাম। তিনি জানান, অসংখ্যবার তাকে এ প্রশ্ন শুনতে হয়েছে।
চাকরিপ্রার্থীদের বৈবাহিক অবস্থা, সন্তান, কিংবা সন্তান নেওয়ার বিষয়ে পরিকল্পনা এসব প্রশ্ন করা বেআইনি বলে মনে করেন সুন্দারাম।
অ্যাপ্লাইডের তথ্যমতে, উচ্চ পদের জন্য আবেদন করা নারীদের ক্ষেত্রে এ সমস্যা আরও বেশি খারাপ, যেখানে পাঁচজনের মধ্যে দু'জন নারী এ ধরনের প্রশ্নের মুখোমুখি হয়েছেন।
সুন্দারাম মনে করেন, নারীদের এ প্রশ্নের সম্মুখীন হওয়ার অন্যতম কারণ হলো গর্ভকালীন অবস্থা। কারণ ওই সময়ে মাতৃত্বকালীন ছুটিতে থাকার পরও তাদের বেতন দিতে হয়। তাদের কাজগুলো তখন অন্যদের দিয়ে করানো হয়। আর প্রতিষ্ঠানগুলো এসব ঝামেলা চায় না।
সুন্দারাম বলেন, শুধু যে কুসংস্কারের কারণেই তা নয়, ইন্টারভিউ নেওয়া ব্যক্তিরা কীভাবে প্রার্থীর যোগ্যতা যাচাই করবেন, প্রার্থীর মধ্যে কোন ধরনের যোগ্যতা খুঁজবেন, সেসব বিষয়ে কোনো কিছু নির্দিষ্ট না থাকার কারণেও নিয়োগ প্রক্রিয়া খারাপ হতে পারে।
তার পরামর্শ হলো- প্রত্যেক প্রার্থীকেই একই প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করা এবং 'প্রান্তিক জনগোষ্ঠী'র কথা মাথায় রেখে সেসব প্রশ্ন তৈরি করা।
ফুর সম্পর্কে সুন্দারাম বলেন, ইন্টারভিউয়ের সময় গরুর মতো হাম্বা স্বরে ডাকতে বলার মতো উদ্ভট, অযৌক্তিক কিংবা চাকরির জন্য প্রয়োজনীয় নয় এমন প্রশ্নের সম্মুখীন হওয়ার মাধ্যমে ফুর যে অভিজ্ঞতা হয়েছে, সেটি তাকে ভবিষ্যতের ইন্টারভিউগুলো সম্পর্কে আরও ভালোভাবে তৈরি হতে শিখিয়েছে।
অনুবাদ: রেদওয়ানুল হক