রাশিয়া থেকে যুদ্ধের ক্ষতিপূরণ আদায়ে ইউরোপের প্রতিশ্রুতি, বিষয়টি এত সহজ নয়

যুদ্ধবিধ্বস্ত ইউক্রেনের পুনর্গঠনে কীভাবে অর্থায়ন করা যায় তা নিয়ে কয়েকমাস ধরে চিন্তাভাবনা করছে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ। রাশিয়ার হামলায় দেশটির শহর, কারখানা এবং অবকাঠামোর ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। অনুমান করা হচ্ছে ক্ষতির অর্থমূল্য দাঁড়াবে ৫০০ বিলিয়নের বেশি। কিছু কিছু বিশেষজ্ঞের মতে তা এক ট্রিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি।
অর্থায়নের একটি প্রাথমিক সমীকরণও বেশ বুদ্ধিদীপ্ত মনে হচ্ছিল। কেমন হয় যদি যারা ধ্বংস করেছে তাদেরকেই পরিশোধ করতে দেওয়া হয়? এতে নৈতিক একটা অবস্থানও পাওয়া যাবে!
তবে আসলে অতটা সহজ নয় বিষয়টি। বাস্তবায়নের সম্ভাবনাও খুব ক্ষীণ বলে মনে হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে বলেছেন, এটি সম্ভবত আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করবে এবং অন্যের সম্পদ দখলের বিপজ্জনক নজির তৈরি করবে।
পুনর্গঠনের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ একসময় হাতের নাগালে মনে হয়েছিল। ইউক্রেন আক্রমণের পর বিদেশে থাকা রাশিয়ার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ৩৩০ বিলিয়ন ডলারের বেশি অর্থ জব্দ করেছে পশ্চিমা দেশগুলো।
বিশ্বের সবচেয়ে বড় অর্থনীতির দেশগুলোর জোট জি৭ এর নেতা এই মাসে বলেছেন, ইউক্রেনের যে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, তার ক্ষতিপূরণ না দেওয়া পর্যন্ত জব্দ সম্পদ অচল থাকবে। একই সাথে ক্ষয়ক্ষতি মূল্যায়ন ও ক্ষতিপূরণ আদায়ের জন্য আন্তর্জাতিক উদ্যোগের প্রয়োজনের কথাও বলেন তারা।
ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) রাশিয়ার ২১৭ বিলিয়ন ডলার জব্দ করেছে। ইউক্রেনের পুনর্গঠন নিয়ে আয়োজিত এক সম্মেলনে ইইউ কমিশনের প্রধান উরসুলা ভন ডার লেইন গত মাসে প্রতিশ্রুতি দিয়ে বলেছিলেন, (গ্রীষ্মের ছুটির মধ্যে) রুশ সম্পদগুলো ইউক্রেনের স্বার্থে কাজে লাগানোর একটি আইনি পন্থা উপস্থাপন করা হবে।
কিন্তু তার ঘোষণা জোটের সেসব কর্মকর্তা ও কূটনীতিকদের মধ্যে অস্বস্তি সৃষ্টি করেছে, যারা কয়েক মাস ধরে এ বিষয়ে আলোচনা করে যাচ্ছেন এবং দেখেছেন, এভাবে ক্ষতিপূরণ আদায় করা সহজ কোন কাজ নয়।
বাধা কোথায়?
বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, এভাবে রাশিয়ান রাষ্ট্রীয় সম্পদ সরাসরি বাজেয়াপ্ত করা উল্লেখযোগ্য আইনি এবং আর্থিক ঝুঁকি তৈরি করবে।
আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী, জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে ভোটের মাধ্যমে, আন্তর্জাতিক বিচারিক আদালতের রায় বা যুদ্ধোত্তর চুক্তির মাধ্যমে সম্পদ বাজেয়াপ্ত করা যেতে পারে। কিন্তু এর কোনটিই সহজ হবে না।
রাশিয়া নিরাপত্তা পরিষদের সদস্য। স্বাভাবিকভাবেই বাজেয়াপ্ত করার প্রস্তাব উঠলে দেশটি বাধা দেবে। যেহেতু এখনো যুদ্ধ চলছে, তাই চুক্তির প্রসঙ্গ আসে না। আর আন্তর্জাতিক বিচারিক আদালতেও কোন মামলা হয়নি। আর যদি মামলা হতো, আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আন্তর্জাতিক আইন রাশিয়ার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বাজেয়াপ্ত করার বিরুদ্ধে রায় দেবে। কারণ এটি সার্বভৌমত্বের লঙ্ঘন হবে।
আন্তর্জাতিক বিচারিক আদালত এক দশক আগে ইতালির অভ্যন্তরীণ আদালতের দেওয়া একটি রায়ের বিরুদ্ধে রুল জারি করে। যে রায়ে নাৎসি যুগে জোরপূর্বক শ্রমের জন্য ক্ষতিপূরণ দেওয়ার আদেশ দেওয়া হয়। বিচারিক আদালতের মূল্যায়ন ছিল, এটি আধুনকি জার্মানির সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘন করে।
ওয়াশিংটন ভিত্তিক ব্রুকিংস ইনস্টিটিউশনের সিনিয়ন ফেলো ডগলাস এ রেডিকার বলেন, একক পদক্ষেপের ঝুঁকি এড়াতে, বাজেয়াপ্ত করার বিষয়টি পশ্চিমা দেশগুলোর মধ্যে সুপরিকল্পিত, সমন্বিত ও সংগঠিত পদক্ষেপ হতে হবে। এবং (তারপরও) এটি অনেক কঠিন একটি বিষয়। কারণ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সম্পদ পবিত্র বলে মনে করা হয়। এটা রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের বিষয়।
এদিকে যুক্তরাষ্ট্রে ট্রেজারি সেক্রেটারি জ্যানেট ইয়েলেন গত মাসে কংগ্রেসকে জানান, তাদের দেশে থাকা রুশ সম্পদ বাজেয়াপ্ত করতে হলে আমেরিকান আইনে একটি পরিবর্তন আনতে হবে।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের এক গোপন নথি দেখেছে নিউ ইয়র্ক টাইমস। এতে দেখা যায়, রাশিয়ার সম্পদ বাজেয়াপ্ত করার কোন আইনি পন্থা নেই।
কি কি উপায় আছে?
খুব বেশি বিকল্প না থাকায় একটি নিরাপদ উপায় ভেবে দেখছে ইইউ কমিশন। সর্বশেষ প্রস্তাব হল, যেসব ইউরোপীয় কোম্পানিতে রুশ সম্পদ জব্দ আছে সেগুলো কাজে লাগানো। এবং সেখান থেকে আসা মুনাফা ইউক্রেনে পাঠানো। কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, এভাবে প্রতিবছর ইউক্রেনে ৩ বিলিয়ন ইউরো পাঠানো সম্ভব। এভাবে অর্থগুলোনো কোনো প্রভাব পড়বে না। কখনো রুশ সম্পদ ফিরিয়ে দিতে হলে সহজে দেওয়া যাবে।
রাশিয়ার জব্দকৃত বেশিরভাগ অর্থ আছে ইউরোক্লিয়ারের হাতে। ব্রাসেলস-ভিত্তিক এই বৃহৎ আর্থিক পরিষেবা কোম্পানি আন্তর্জাতিক লেনদেন এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সম্পদ সুরক্ষার জন্য খ্যাত। নিষেধাজ্ঞার কারণে সম্পদ থেকে অর্জিত আয় রাশিয়ায় ফের যায়নি। পরিবর্তে এসব লেনদেন থেকে আসা আয় ইউরোক্লিয়ারের ব্যালেন্স শিটে যুক্ত হয়েছে।
আবশ্যকতার কারণে, ইউরোক্লিয়ার এসব অতিরিক্ত অর্থ বিনিয়োগ করে এবং চলতি বছরের প্রথমার্ধে ১.৭ বিলিয়ন ডলার মুনাফা করেছে। সাধারণ অবস্থায় এসব অর্থ দিয়ে কি করা হবে, বিষয়টি কোম্পানি নির্ধারণ করত। কিন্তু যুদ্ধ প্রেক্ষাপট মুনাফাগুলো আলাদা করে রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে কোম্পানির বোর্ড।
ইইউ কমিশন থেকে আসা প্রস্তাবটির 'আইনি ও প্রায়োগিক জটিলতা' সম্পর্কে কোম্পানি অবগত বলে জানিয়েছে ইউরোক্লিয়ার।
বেলজিয়াম অবশ্য ইতোমধ্যে এসব অর্থের কর বাবদ কোম্পানি থেকে ১১১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার নিয়ে নিয়েছে। আর সেগুলো ইউক্রেনের পাঠানোর কথাও বলেছে। এখন ইইউর প্রস্তাব গ্রহণ করা হলে মুনাফার বড় অংশ হয়তো ইউক্রেনে চলে যাবে।
অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রে বাইডেন প্রশাসনের কাছে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে ইউক্রেনে সরাসরি অর্থ না পাঠিয়ে, কিয়েভ এসব অর্থ থেকে উপকৃত হয় এমন কৌশল গ্রহণের। যেমন- সম্পদগুলো একটি পৃথক অ্যকাউন্টে রাখা, যা ইউক্রেন নতুন বন্ডের জন্য জামানত হিসেবে ব্যবহার করতে পারে। ইউক্রেন ১০ থেকে ৩০ বছরের সময়সীমার মধ্যে যদি সফলভাবে ঋণ শোধ করতে পারে তাহলে রাশিয়া তার জব্দ হওয়া সম্পদ ফিরে পাবে।
দীর্ঘস্থায়ী উদ্বেগ কি?
সর্বশেষ প্রস্তাবকে ইইউ কমিশন কম ঝুঁকির বললেও ইউরোপীয়ান সেন্ট্রাল ব্যাংক এবং জোটের কয়েকটি দেশে এর মধ্যেও উদ্বেগ দেখিয়েছে। তারা আরো সতর্ক কোন পদক্ষেপের কথা বলছেন। কর্মকর্তারা চিন্তা করছেন, এতে ইউরোপের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হবে এবং বিদেশি বিনিয়োগকারীরা ইউরোপের নিজেদের সম্পদ নিরাপদ বলে মনে করবে না। আন্তর্জাতিক সমন্বয় না হলে বিনিয়োগকারীরা অন্য কোন অঞ্চল বা মুদ্রার প্রতি ঝুঁকে পড়তে পারেন।
ইইউ কমিশনের যুক্তি হল, রুশ সম্পদ জব্দ করার মাধ্যমেই ঝুঁকি নেওয়া হয়ে গেছে। নতুন প্রস্তাবের মাধ্যমে এসব সম্পদ অক্ষত থাকবে এবং ভবিষ্যতে প্রয়োজনে হস্তান্তর করা যাবে। এতে মস্কোর নেওয়া কোনো ধরনের আইনি পদক্ষেপ থেকেও রক্ষা পাবে ইইউ।
গোপনীয় প্রতিবেদনে ইউরোপীয় কর্মকর্তারা বলেন, সম্পদ বিনিয়োগ থেকে আসা মুনাফার উপর কর আরোপ করা 'ইউনিয়নের স্থিতিশীলতায়' প্রভাব ফেলবে না। এতে আইনি জটিলতার ঝুঁকিও কমবে।