বিশ্বের প্রথম হাইপারলুপ ট্রেন তৈরি করতে যাচ্ছে চীন, চলছে চূড়ান্ত গন্তব্য বাছাই!

চীনের শীর্ষ প্রকৌশল ও রেল ডিজাইন ইনস্টিটিউটের তথ্য অনুযায়ী, দেশটি সাংহাই থেকে হাংঝু পর্যন্ত তাদের প্রথম হাইপারলুপ ট্রেন লাইন তৈরি করবে। ১৫০ কি.মি. দীর্ঘ ইন-ভ্যাকুয়াম টানেলের মধ্য দিয়ে ম্যাগলেভ ট্রেন চলতে পারবে ঘণ্টায় ১,০০০ কি.মি. বেগে। খবর সাউথ চায়না মর্নিং পোস্টের।
'আল্ট্রা-হাই স্পিড পাইপলাইন ম্যাগলেভ সিস্টেম ডেমোনস্ট্রেশন লাইন' কোথায় নির্মাণ করা হবে তা নিয়ে বেশ কয়েকভাবে মূল্যায়ন করেছে চাইনিজ অ্যাকাডেমি অফ ইঞ্জিনিয়ারিং এবং চীনের রেল কর্তৃপক্ষ। মূল্যায়নের পর চীনের পূর্ব উপকূলের সবচেয়ে ধনী দুই শহরের মধ্যে যোগাযোগের গতি বৃদ্ধির জন্য বেছে নেওয়া হয়েছে সাংহাই-হাংঝু রুটকে। গত ১৭ এপ্রিল চীনা ভাষার জার্নাল রেলওয়ে স্ট্যান্ডার্ড ডিজাইনে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে এই সংবাদ জনসমক্ষে উঠে এসেছে।
চীন সরকারকে বৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তিগত পরামর্শ প্রদান করে চাইনিজ অ্যাকাডেমি অফ ইঞ্জিনিয়ারিং। একাডেমিটির শীর্ষস্থানীয় বিজ্ঞানী এবং প্রকৌশলীরা দেশটির বড় বড় অবকাঠামো প্রকল্পের ধারণা, নকশা এবং নির্মাণের সাথে সরাসরি জড়িত। এই মূল্যায়ন দলের নেতৃত্বে ছিলেন বেইজিং-এর রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন চায়না রেলওয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং ডিজাইন অ্যান্ড কনসাল্টিং গ্রুপের সিনিয়র ইঞ্জিনিয়ার ঝাং ইউনজিয়াও।
হাইপারলুপ নামে পরিচিত 'আল্ট্রা-হাই স্পিড পাইপলাইন ম্যাগলেভ সিস্টেম' সম্পর্কে ২০১৩ সালে প্রথম আইডিয়া দিয়েছিলেন ইলন মাস্ক। এই পরিবহন ব্যবস্থায় একটি ভ্যাকুয়াম সিলড-টিউবের মধ্য দিয়ে যাত্রী এবং মালামাল পরিবহন করা হবে।
এই ধারণাটিকেই চীন গুরুত্বসহকারে নিয়েছে। পরিবহন খাতে এক বিপ্লব ঘটাতে সক্ষম এই আইডিয়া, যা আরও দ্রুত ও কার্যকর উপায়ে মানুষ ও পণ্য পরিবহন করার ক্ষমতা রাখে।
চীন ইতিমধ্যেই বিশ্বের হাই-স্পিড রেল প্রযুক্তির দেশগুলোর মধ্যে একটি। এবং হাইপারলুপ প্রযুক্তিতে বিনিয়োগ করার পর তাদের এই অবস্থান আরও বহুদিন টিকে রাখবে বলে বিশ্বাস মূল্যায়নকারী দলের। ঝাং এবং তার সহকর্মীরা প্রতিবেদনে লিখেছেন, "হাইপারলুপ প্রকল্পটি চীনের জন্য কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ।"
২০৩৫ সালের মধ্যে হাইপারলুপ লাইনটি চালু হবে বলে আশা করা হচ্ছে।

হাইপারলুপ কোন কোন রুটে বসবে তা নিয়ে বেশ কিছু শহর প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিল। এর মধ্যে বেইজিং-শিজিয়াজুয়াং, গুয়াংজু-শেনজেন এবং চেংডু-চংকিং লাইন উল্লেখযোগ্য। ঝাং-এর দল জানিয়েছেন প্রত্যেকটি রুটেরই বেশ কিছু অনন্য সুবিধা ছিল।
যেমন: বেইজিং-শিজিয়াজুয়াং লাইন রাজধানী বেইজিংকে হেবেই প্রদেশের রাজধানী শিজিয়াজুয়াং-এর সাথে সংযুক্ত করবে, যার ফলে উত্তর চীনের দুটি প্রধান শহর সংযুক্ত হবে এবং রাজধানীর চারপাশে থাকা রুটে যানজট দূর হবে। এদিকে চেংডু-চঙকিং লাইন পশ্চিম চীনের দুটি বড় শহরকে সংযুক্ত করবে। এই দুটো শহরই বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের অংশ এবং দেশটির দ্রুত বর্ধনশীল অঞ্চলগুলোর মধ্যে একটি।
আবার, গুয়াংঝু-শেনঝেন লাইন পার্ল রিভার ডেল্টা অঞ্চলের দুটো গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক কেন্দ্রকে সংযুক্ত করবে এবং গুয়াংডং-হংকং-ম্যাকাউ গ্রেটার বে এরিয়াতে আরও উন্নয়নে সাহায্য করবে। গ্রেটার বে এরিয়া এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরের কেন্দ্রস্থলের একটি কৌশলগত অঞ্চলে অবস্থিত। এই অঞ্চলই বাইরের অন্যান্য দেশের সাথে চীনকে সংযোগ করার একটি আদর্শ স্থান।
প্রকল্প মূল্যায়ন দলের প্রতিবেদন অনুযায়ী, তারা হাইপারলুপ প্রজেক্টে বিড করা শহরগুলোর ক্ষেত্রে বেশ কয়েকটি মূল বিষয় বিবেচনা করেছে। এর মধ্যে রয়েছে, শহরগুলোর অর্থনৈতিক সম্ভাবনা, যার মধ্যে রয়েছে জনসংখ্যার ঘনত্ব, অর্থনৈতিক অবস্থা এবং বিদ্যমান পরিবহন অবকাঠামো। এছাড়াও প্রযুক্তিগত সম্ভাব্যতা, সামাজিক প্রভাব এবং তহবিলের প্রাপ্যতাকেও বিবেচনা করা হয়েছে।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, হাংঝু-সাংহাই লাইন চীনের পক্ষে সবচেয়ে সুবিধাজনক এবং লাভজনক হবে।
সাংহাই এবং হাংঝু, দুইটি শহরই চীনের অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী এবং সাংস্কৃতিক প্রাধান্য বিস্তারকারী শহর। এছাড়াও এই দুই শহরের জনসংখ্যার ঘনত্ব বেশি এবং অর্থনৈতিক কার্যক্রমও ব্যাপক। এছাড়াও এই দুইটি শহর তুলনামূলক সমতল ভূখণ্ডে হওয়ায় ট্রেন লাইনটিও সহজে নির্মাণ করা সম্ভব। এ ধরনের একটি প্রকল্প সাংহাই এবং হাংঝুকে আঞ্চলিকভাবে একত্রিত করতে পারবে, যা সমাজে একটি ইতিবাচক প্রভাবও ফেলবে বলে প্রতিবেদনে লেখা হয়েছে।
জনসংখ্যার দিক থেকে চীনের বৃহত্তম শহর সাংহাই বিশ্বের অর্থনৈতিক কার্যক্রমের অন্যতম কেন্দ্র। এছাড়া ইলন মাস্কের পরিচালিত বিশ্বের বৃহত্তম টেসলা গাড়ির কারখানাও এখানে। অন্যদিকে হাংঝু বিখ্যাত এর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্য। আলিবাবার মতো ই-কমার্স কোম্পানিগুলোর কেন্দ্রও হাংঝু শহর।
২০০ কি.মি. দূরত্বে থাকা এই দুই শহরের মধ্যে একটি থেকে অন্যটিতে গাড়িতে যেতে প্রায় তিন ঘন্টা সময় লাগে, হাই-স্পিড ট্রেনে সময় লাগে প্রায় এক ঘন্টা। তবে যদি হাইপারলুপ লাইন বাস্তবায়িত হয়, তবে এই সময় কমে আসবে ১৫ মিনিটে।
হাইপারলুপ এবং হাই-স্পিড রেল
মাত্র ১৫ বছরের মধ্যেই চীন পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করার মতো যথেষ্ট হাই -স্পিড রেল তৈরি করে ফেলেছে। কিছু প্রকৌশল বিশেষজ্ঞের মতে এই অভিজ্ঞতা হাইপারলুপ নির্মাণকে আরও সহজ ও দ্রুত করবে। চীনের হাইপারলুপ রেল নেটওয়ার্কের জন্য প্রচুর পরিমাণে গবেষণা, প্রকৌশল দক্ষতা এবং অ্যাডভান্সড ম্যানুফ্যাকচারিংয়ে ব্যাপক বিনিয়োগের প্রয়োজন রয়েছে।
হাই-স্পিড রেল নির্মাণের ফলে এসব প্রকল্পের ব্যবস্থাপনা, সরবরাহ এবং নিরাপত্তা কেমন হয় তা সম্পর্কে ভালো অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে প্রকৌশলীরা, যা হাইপারলুপ প্রকল্পগুলোতেও প্রয়োগ করা যেতে পারে বলে মন্তব্য করা হয়েছে প্রতিবেদনটিতে।

তবে যারা বিশ্বের প্রথম হাইপারলুপ প্রকল্পের সাথে জড়িত, তাদের জন্য ২০৩৫ সাল খুব বেশি দূরে বলে মনে নাও হতে পারে।
একটি হাইপারলুপ সিস্টেম তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় প্রযুক্তির বিকাশ এখনও প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে। তাই এটিকে বড় পরিসরে বাস্তবায়িত করার জন্য একে আগে প্রচণ্ড প্রযুক্তিগত চ্যালেঞ্জ অতিক্রম করতে হবে।
একটি হাইপারলুপ সিস্টেমের জন্য আগে প্রয়োজনীয় অবকাঠামো তৈরি করতে হবে, যার মধ্যে রয়েছে নিম্ন চাপের টিউব এবং বিশেষায়িত স্টেশন। এগুলো বাস্তবায়িত করতে প্রয়োজন প্রচুর বিনিয়োগ এবং দক্ষতা।
আইনি চ্যালেঞ্জও এই প্রজেক্টের সামনে রয়েছে। হাইপারলুপ সিস্টেম পরিচালনার জন্য এখনো কোনো আইনি নিয়ম নেই। হাইপারলুপের ফলে উচ্চ গতি থেকে নিরাপত্তাও একটি প্রধান সমস্যা হবে, যা কেবল অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং উন্নয়নের মাধ্যমেই সমাধান করতে হবে।