রাশিয়া কেন বরফ-সৈনিক তৈরি করছে!
রাশিয়ার দুর্গমতম অঞ্চল সাইবেরিয়ার একটি শহর- চিতা। শহরের প্রধান চত্বরে কালাশনিকভ অ্যাসল্ট রাইফেল হাতে ঠায় দাঁড়িয়ে রয়েছে এক ডজন রুশ সেনা। চারপাশের তাপাঙ্ক অতি-শীতল, মাইনাস ৩৩ ডিগ্রী সেলসিয়াস। কনকনে বাতাসে হাড় হিম হওয়ার যোগাড়। সবাই যখন কয়েক প্রস্ত পুরু পোশাক পরেও ঠকঠকিয়ে কাঁপছে তারমধ্যেও কোনো হেলদেল নেই এই অতন্দ্র প্রহরীদের। তাদের সামনে দাঁড়িয়ে সেলফিও তুলছেন অনেকে। খবর বিবিসির
সেনাদের এই নিশ্চল দাঁড়িয়ে থাকার রহস্য একটাই, তারা রক্তমাংসের মানুষ নয়, বরং বরফের তৈরি ভাস্কর্য।
মস্কো থেকে ৩ হাজার কিলোমিটার দূরে অবস্থিত-চিতা। এখানকার স্থাণীয় কর্তৃপক্ষ আসন্ন বড়দিনের উৎসবের মওসুম উপলক্ষে এসব ভাস্কর্য তৈরি করেছেন। আরো উদ্দেশ্য দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করা দেশের এই সুদূর প্রান্তের রুশ নাগরিকদের। আর তাতে বেশ খুশিই চিতা শহরবাসী। চত্বরে দাঁড়িয়ে তাদের কয়েকজনের সাথে কথা বলে এমনটাই বোঝেন বিবিসির প্রতিবেদক।
যেমন তাতিয়ানা নামের একজন তাকে বলেন, 'আমরা একটি যুদ্ধ লড়ছি। তাই বরফের তৈরি সেনাদের ভাস্কর্য থাকাটাই স্বাভাবিক। কারণ, তাদের আলোচনাই এখন প্রাসঙ্গিক'।
লুদমিলা নামের আরেক নারী বলেন, 'নতুন বছর উদযাপনের এটা অভিনব ধারা। সাধারণত আমরা বরফের তৈরি সান্তা ক্লস, খরগোশ আর কাঠবেড়ালির ভাস্কর্য দেখেই অভ্যস্ত। তবে এটা বর্তমান সময়েরই প্রতীক'।
ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে নিজের উদ্বেগের কথাও ব্যক্ত করেন লুদমিলা। বলেন, "আমাদের অনেক বন্ধু সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়েছে। তাদের সেখানে যুদ্ধ করতে পাঠানো হয়েছে। আমরা সবাই তাদের কথা ভাবি, উৎকণ্ঠাবোধ করি। ফোন করে জানতে চাই তারা ঠিকঠাক আছে কিনা। সরকার নিয়ে আমাদের আপত্তি, অভিযোগ যতই থাক; মাতৃভূমি হলো মাতৃভূমিই। আমরা যদি তাকে রক্ষা না করি, তাহলে কে আর করবে?"
গত ২৪ ফেব্রুয়ারি রাশিয়াই প্রথম ইউক্রেনে আগ্রাসন চালায়, তাই রাশিয়াকে কীসের থেকে রক্ষা করার এ লড়াই এমন প্রশ্ন রাখেন বিবিসির প্রতিবেদক।
জবাবে লুদমিলা বলেন, 'নাৎসিদের থেকে রক্ষা করার এই যুদ্ধ। তাদের অনেকে আছে আমাদের চারপাশে (রাশিয়ার প্রতিবেশী দেশগুলোতে)। রাশিয়াকে সকল ফ্রন্টে আক্রমণ করা হচ্ছে, এমনকী এলজিবিটিকিউ (নারী ও পুরুষ সমকামী, উভকামী ও রূপান্তরকামী) প্রোপাগান্ডা দিয়েও। তারা এসব ভিনদেশি চিন্তাধারা আমাদের ওপর আরোপ করতে চায়। কিন্তু, আমরা এসব প্রত্যাখ্যান করছি। আমরা শুধু রাশিয়ান মূল্যবোধকে গ্রহণ করি। এসব অনুভূতিকে সব সময় কথায় প্রকাশ করতে পারি না। শুধু হৃদয়ে অনুভব করি'।
তার কথায় দারুণ বিস্ময় ব্যক্ত করে বিবিসির প্রতিবেদক লিখেছেন, রাস্তাঘাটে সাধারণ রাশিয়ানদের আগে এভাবে কথা বলতে শুনিনি। আগে তারা কখনোই বলতো ইউক্রেনের নাৎসিরা তাদের জন্য হুমকি। আর রাশিয়ান মূল্যবোধ রক্ষায় লড়তে হবে। এই বছরে এটাই সবচেয়ে বড় পরিবর্তন যা আমার নজরে এসেছে।
তবে এতে আরো প্রমাণিত হয়, রুশ সরকারের প্রচারণা ও যুক্তিকে অনেক রাশিয়ান মনেপ্রাণে গ্রহণ করেছেন। তারা মনে করছেন, পশ্চিমাদের বিরুদ্ধে অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই করছে রাশিয়া। রাশিয়ার গণমাধ্যম ও টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর বক্তব্যই প্রতিধ্বনিত হচ্ছে দেশপ্রেমে উজ্জীবিত রাশিয়ানদের কণ্ঠে।
সাইবেরিয়ায় বিপুল গ্যাস মজুদ থাকলেও, চিতা শহরে নেই গ্যাস সংযোগ। হাড় হিম করা শীতে গ্যাস দিয়ে ঘর উষ্ণ করার ব্যবস্থা থাকলে জীবনযাত্রা আরো সহজ হতো স্থানীয়দের। বিকল্প হিসেবে অবশ্য কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র রয়েছে। আবার ঘর উষ্ণ রাখতে লাকড়িই জ্বলে কাঠ দিয়ে তৈরি বাসাবাড়িতে।
শত কষ্টের পরও চিতার কোথাও স্বদেশপ্রেমের অভাব চোখে পড়ে না। স্থানীয় কনসার্ট হলে ধাতুনির্মিত এক ভাস্কর্যের হাতে শোভা পাচ্ছে তেরঙ্গা রাশিয়ান পতাকা। আবার লেনিন চত্বরে ফার গাছ দিয়ে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে 'জেড' অক্ষর, যা কিনা রাশিয়ার ইউক্রেন অভিযানের প্রতীক।
শিশুরাও পিছিয়ে নেই, স্থানীয় টেলিভিশন চিতা টিভির পর্দায় চোখ রাখলেই দেখা যাবে, এই ক্রিসমাসে ফাদার ক্রিসমাসকে নয়, বরং ইউক্রেনে থাকা রুশ সেনাদের চিঠি লিখছে খুদে শিশুরা।
সবমিলিয়ে সুদূর প্রান্তের এ শহরেও লেগেছে যুদ্ধ ও জাতীয়তাবাদের আঁচ। এবারের ক্রিসমাসটা রাশিয়ানরা কীভাবে পালন করবে– এযেন তারই প্রতীক হয়ে উঠেছে।
