শাঁখারিবাজারের কারিগরদের হাতে যেভাবে বেঁচে আছে শোলার টোপর
আজ নন্দিনীর বিয়ে। মাস তিনেক ধরে প্রস্তুতির ব্যস্ততা—সনাতনী বিয়ে মানেই নানা আয়োজন, অসংখ্য লোকাচার আর অন্তহীন কেনাকাটা। এই সবকিছুর মাঝেও নন্দিনীর মন পড়ে ছিল একটা জিনিসেই—মুকুট বা টোপর।
বিয়ের মুকুটের জন্য শাঁখারিবাজারের জুড়ি নেই, এ কথা কনে ভালো করেই জানেন। তাই পুরো একটা দিন দোকানের পর দোকান ঘুরেছেন তিনি, পরখ করেছেন নকশার পর নকশা। শেষে মনের মতো একখানা মুকুট কিনেছেন। এখন শুধু একটাই প্রশ্ন মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে, এই শোলার মুকুটটা পরলে তাকে দেখতে ঠিক কেমন লাগবে? তবে শোলার মুকুটে যেকোনো গড়ন ও রঙের কনেকে দিব্যি মানিয়ে যায় সেইটাই হলো স্বস্তির কথা।
'আজকে বুবুর গায়ে হলুদ, কালকে বুবুর বিয়ে
বর আসবে পালকি চড়ে, টোপর মাথায় দিয়ে'
বাংলা ভাষায় প্রচলতি নানা ছড়ায় এভাবেই বারেবারে আসে টোপরের কথা। হিন্দু শাস্ত্রমতে, মাথা হলো দেবতার বাসস্থান। সেখানে মুকুট ধারণ করা মানে ঐশ্বরিক শক্তির আহ্বান। বাঙালি ঘরের মেয়েরা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে এই মুকুট বুকে আগলে রাখেন—কখনো তা মায়ের ছোঁয়া লাগা স্মৃতি, কখনো নিজের বিয়ের সেই সোনালি মুহূর্তগুলোর নীরব সাক্ষী। সময়ের সঙ্গে বাঙালি হিন্দু বিয়ের নানা রীতি রেওয়াজে অদলবদল এলেও বদলায়নি বর-কনের শোলার মুকুট পরে ছাদনাতলায় বসবার রীতি।
হিন্দু বিশ্বাস অনুযায়ী, টোপর সৌভাগ্য বয়ে আনে। আর টোপরের সাদা বর্ণ বয়ে আনে নতুন জীবনে শুভ্রতা।
হিন্দু বিয়ের টোপর বা মুকুট সাধারণত তৈরি করা হয় শোলা দিয়ে। মুকুট শব্দটি শুনলেই আমাদের মাথায় আসে সোনা বা রুপা দিয়ে বানানো মাথার অলঙ্কার। কিন্তু বিয়ের মুকুট কেন শোলা দিয়ে বানানো হয়?
হিন্দু বিয়েতে শোলার মুকুট নিয়ে নানা কিংবদন্তী প্রচলিত আছে। এরমধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয়টি হলো, নিজের বিয়ের অনুষ্ঠানে শিবঠাকুরের এক বিশেষ প্রকার মস্তক আবরণী পরবার সাধ জাগে। সে ইচ্ছা অনুযায়ী তিনি বিশ্বকর্মাকে নির্দেশ দেন হালকা এক মস্তক আবরণী প্রস্তুতের। কিন্তু দেবশিল্পী বিশ্বকর্মা ছিলেন ধাতু শিল্পী। তাই তিনি হালকা কোনো বস্তু দিয়ে এমন মস্তক আবরণী তৈরি করতে ব্যর্থ হন। শেষে মালাকার নামের এক কারিগর জলা জায়গা থেকে শোলা যোগাড় করে তৈরি করে দেন এক সুদৃশ্য মস্তক আবরণী। মহাদেব এই মালাকার কারিগরের কাজে অত্যন্ত সন্তুষ্ট হন। পরবর্তীতে তিনি তাকে ব্যক্তিগত হস্তশিল্পী হিসেবে নিয়োগ দেন। সেই থেকে হিন্দু বিয়েতে শোলার টোপরের রেওয়াজ চালু হয়।
ঢাকার শাঁখারিবাজারের শঙ্খের দোকানগুলোয় টোপর পাওয়া যায়। শুধু মুকুট বা টোপর পাওয়া যায় এমন দোকানও আছে। এছাড়াও আছে মুকুট তৈরির কারখানা। যেখানে প্রতিদিন বানানো হয় শোলা আর ককশিটের মুকুট। কীভাবে বানানো হয় এই শোলার মুকুট আর কারাই বা বানায়? এসবই দেখার জন্য আমরা পৌঁছে গিয়েছিলাম শাঁখারিবাজারই।
দুষ্প্রাপ্য শোলাই মূল কাঁচামাল
শোলা গাছ জন্মায় জলাশয়ে। এটি প্রাকৃতিকভাবেই জন্ম নেয়। বাণিজ্যিকভাবে চাষ করার কোনো উপায় নেই, কারণ শোলার বীজ হয় না। ধানক্ষেত, বিল বা আবাদ জমিতে শোলা প্রাকৃতিকভাবে জন্মায়। শোলা গাছ বিলে যত পানি পায়, তত বাড়ে ও মোটা হয়।
শোলা গাছের বৈজ্ঞানিক নাম Aeschynomene aspera। এই বৈজ্ঞানিক নাম নিয়ে আছে মজার এক গল্প। একদিন ভারতের এক চাষী জলাভূমিতে শোলা গাছ কাটছিলেন। সেসময় এক বিদেশি উদ্ভিদবিজ্ঞানী গাছটির নাম জানতে চায়। কিন্তু চাষী গাছটির নাম জানতেন না। উত্তরে বললেন, 'ইসকা নাম নেহি জানতা'। ওই উদ্ভিদবিজ্ঞানী ভাবলেন এটাই বোধহয় গাছটির আসল নাম। তিনি তখন শোলা গাছের বিজ্ঞানসম্মত নাম ল্যাটিন ভাষায় পরিবর্তন করে রাখলেন 'অ্যাস্কাইনোমিনি' (ইসকা নাম নেহি)।
শোলা একটি কাণ্ডসর্বস্ব গাছ। কাণ্ডের বাইরের আবরণটা বাদামি রঙের, কিন্তু ভেতরটা সাদা। শোলা বর্ষাকালীন জলজ সপুষ্পক উদ্ভিদ। শিম ফুলের মতো সুন্দর হলুদ রঙের ফুল ফোটে শোলা গাছে। এ গাছ সাধারণত ৫-৬ ফুট লম্বা হয় এবং কাণ্ডের ব্যাস হয় ২–৩ ইঞ্চি।
বাংলাদেশে দুই প্রকার শোলা জন্মে: কাঠশোলা ও ভাটশোলা। কাঠশোলা অপেক্ষাকৃত শক্ত, কিন্তু ভাটশোলা হালকা ও নরম। কাঠশোলার কান্ড দিয়ে বোতলের ছিপি বানানো হয়।
ভাটশোলা দিয়েই মুকুটের কাজ করা হয়। এই ধরনের শোলা গাছের কান্ডের সাদা নরম মজ্জাটি ব্যবহৃত হয় শোলা হিসেবে। ভাটশোলা দিয়ে কাজ করার সুবিধা হলো এতে আলাদা করে রং করতে হয় না। শোলার রংই দুধ সাদা। তবে এটি কাটতে বেশ ঝামেলা পোহাতে হয় বলে জানান মুকুট তৈরির কারখানার দায়িত্বে থাকা দেবেশ সুর।
এই উদ্ভিদের আদিনিবাস বাংলাদেশ, ভুটান, কম্বোডিয়া, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, লাওস, মালয়েশিয়া, মিয়ানমার, নেপাল, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনাম। গ্রামবাংলার খাল, বিল, পুকুর, ডোবা, পতিত জলাশয়ে এদের বেশি দেখা যায়।
নওগাঁ ও রাজশাহীর রক্তদহ বিল, আত্রাই বিল, দীঘলি বিল ও খলিমারা বিলে অনেক শোলা দেখা যায়। মাদারীপুর, যশোর আর খুলনাতেও পাওয়া যায় ভালো মানের শোলা। ঢাকার মানিকগঞ্জ, কেরানীগঞ্জ ও মুন্সীগঞ্জে এবং কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, জামালপুর, শেরপুর, যশোর, রংপুর, দিনাজপুর ও বরিশাল অঞ্চল শোলাশিল্পের জন্য প্রসিদ্ধ।
শোলা দিয়ে যারা শিল্প ও কারুকাজ করেন, তাদেরকে বলা হয় মালাকার। এই 'মালাকার' সম্প্রদায়ের আদি বাসস্থান হিসেবে ধরা হয় ভারতের উত্তরপ্রদেশের মথুরা। মোগল সম্রাট জাহাঙ্গীরের রাজত্বকালে তারা মথুরা থেকে বাংলায় এসেছে বলে মনে করেন অনেকে।
মালাকার সম্প্রদায়ের শোলা কাটার আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হয় দুর্গাপূজার দশমীর দিন। এই অনুষ্ঠানকে বলা হয় 'শোলা সাইত।' মালাকাররা বংশানুক্রমে শোলা দিয়ে বৈচিত্র্যময় টোপর, দেব-দেবীর অলংকার, চালচিত্র, পূজামণ্ডপের অঙ্গসজ্জার দ্রব্যাদি, মালা, গয়না, খেলনা ও গৃহসজ্জার নানা দ্রব্য তৈরি করেন।
মুকুট বাণিজ্য
শাঁখারিবাজারে শোলার তৈরি বিভিন্ন পণ্য পাওয়া যায় প্রায় অর্ধশতক ধরে। বিয়ের মুকুট এর মধ্যে অন্যতম। দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে মালাকাররা শোলার পণ্য তৈরি করে এনে বিক্রি করতেন এখানে। শঙ্খ আর শোলার তৈরি নানারকম অনুষঙ্গ পাওয়া যায় শাঁখারিবাজারের অনেক দোকানেই। প্রায় সব দোকানের নামের আগে-পরেই আছে '...শঙ্খ স্টোর' কথাটি। আর এসব শঙ্খ স্টোরেই পাওয়া যায় মুকুট।
শুধু মুকুটের জন্য নির্ধারিত কোনো দোকান নেই, তবে কারখানা আছে কয়েকটি। সেই কারখানা থেকেই সব দোকানে মুকুট সরবরাহ করা হয়। পাইকারি হারেও বিক্রি করা হয় শোলার মুকুট। সারাদেশ থেকে ব্যবসায়ীরা এসে এখান থেকে মুকুট সংগ্রহ করে নিয়ে যান।
শোলা থেকে মুকুট বানানোর দক্ষ কারিগর মাত্র ১২ থেকে ১৫ জন আছেন শাঁখারিবাজারে। আয় কম হওয়ায় অনেকেই অন্য পেশায় চলে গিয়েছেন। যারা এখনো মালাকারের কাজ করেন, তারা বাপ-দাদার পেশা বাঁচিয়ে রাখার জন্য কাজ করেন বলে জানান দেবেশ সুর। তিনি ২৫ বছর ধরে শোলা দিয়ে মুকুট বানানোর কাজ করছেন।
শোলার মুকুটের বেচা-বিক্রি সারাবছরই চলে। তবে হিন্দু বিয়ের মৌসুমে বিক্রি বেড়ে যায়। অক্টোবর থেকে এপ্রিল মাস পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি চাহিদা থাকে মুকুটের। তখন প্রতি মাসে গড়ে ৭০ থেকে ৯০ হাজার টাকার মুকুট বিক্রি হয় বলে জানান কয়েকটি শঙ্খ স্টোরের স্বত্বাধিকারী।
শোলা থেকে মুকুট
পাইকারি হারে শোলা সংগ্রহ করা হয় দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে। এই শোলা কেনা হয় আঁটি ধরে। প্রতি আঁটির দাম হয় ১০ হাজার টাকা। তারপর সেগুলো এনে সূক্ষ্ম হাতে বাইরের আবরণ কেটে ভেতরের সাদা অংশ বের করা হয়। এই সাদা অংশ দিয়েই আসল কাজ।
শুধু শোলা গাছের কাণ্ড ছেঁচে শোলা বের করা শিখতেই অনেকের সময় লেগে যায় বছরের পর বছর। যেমন—২৫ বছর ধরে শোলা দিয়ে মুকুট বানানোর কাজ করছেন দেবেশ সুর।
শুধু শোলা দিয়ে মুকুট হয় না। বোর্ড, কাগজ, পুঁতি, পাথর- এগুলোও লাগে। শোলা কেটে কেটে বানানো হয় বিভিন্ন আকৃতির ফুল। শোলার গঠন খুবই পাতলা ও ভঙ্গুর হয়। খুব সাবধানতার সাথে শোলা কেটে আকার দেওয়া হয় নানারূপে। ফুল, লতা, পাতা বা নকশা আকারে শোলা কেটে সেগুলোকে মুকুটের সৌন্দর্য বাড়ানোর জন্য লাগিয়ে দেওয়া চারপাশে। আইকা বা গ্লু-গান ব্যবহার করে নকশাগুলো জোড়া দেওয়া হয়।
একটি মুকুট বানাতে ৮ থেকে ১০টি শোলা লাগে। স্পেশাল ডিজাইন হলে লাগে আরও বেশি। দেবেশ সুরেরা ৬ জন মিলে কাজ করে প্রতিদিন ১২টির মতো মুকুট তৈরি করেন। বিশেষ কাস্টমাইজ অর্ডার থাকলে সেটি বানানোর জন্য সময় নেন ২ থেকে ৪ দিন।
মুকুটের জন্য ভারতীয় ডিজাইনই বেশি অনুসরণ করা হয় বলে জানালেন দেবেশ। তিনি বলেন, "আমাদেরকে যেই ডিজাইনই দেওয়া হয়, আমরা বানিয়ে দিতে পারি। কেউ কেউ আবার শোলার দুধ সাদা এক রঙ পছন্দ করেন না। লাল, সবুজ বিভিন্ন রঙ চান। তখন আবার রঙ লাগায়ে দিতে হয়।"
"শঙ্খ, গাছকৌটা, প্রজাপতি, লতাপাতা ডিজাইনের মুকুট আমরা বানাই। এই জিনিস কোনোদিন মেশিন দিয়ে বানানো সম্ভব না। হাতেই বানাতে হয় পুরোটা," যোগ করেন তিনি।
মুকুটের আকার বিভিন্ন হয়। সাধারণত ২১ ইঞ্চি থেকে ২৫ ইঞ্চি পর্যন্ত মুকুট বানানো থাকে। যার মাথায় যেটা লাগে, সেটা কিনে নেন। ছেলে আর মেয়েদের মুকুটে পার্থক্য আছে। মেয়েদের মুকুটের সামনে ছোট একটি চূড়ো থাকে, ছেলেদেরটায় তা থাকে না।
এছাড়াও, পূজার দেবতার মুকুট, বাচ্চাদের অন্নপ্রাশনের মুকুট, এমনকি মূর্তিও তৈরি করেন তারা শোলা দিয়ে। আগে শোলা দিয়ে বানানো খেলনাও চলতো ভালো। তবে প্লাস্টিকের সহজলভ্যতা ও কম দামের কারণে শোলার খেলনা এখন প্রায় বিলুপ্তির মুখে।
শোলার মুকুটে শোলা ছাড়াও কার্ডবোর্ড, পাথর, পুঁতি, লেইস, ভেলেভেট কাপড় ব্যবহৃত হয়। এগুলো নিউমার্কেট থেকে সংগ্রহ করা হয়। শোলার দুষ্প্রাপ্যতার জন্য এর তৈরি মুকুটের দাম হয় বেশি।
দেবেশ জানান, "হিন্দু রীতি অনুযায়ী বিয়েতে শোলার মুকুটই মাথায় দেওয়া লাগে। কিন্তু সামর্থ্যের একটা ব্যাপার তো আছে। সবাই শোলার মুকুট নিতে পারেন না। এর দাম বেশি হয়। তাই আমরা থার্মোকল বা ককশিটের মুকুটও বানাই। দেখতে প্রায় একই রকম। কিন্তু ধরলে বোঝা যায় পার্থক্য। শোলার মুকুটের মান অনেক ভালো হয়। ওজনেও হয় হালকা।"
শোলার মুকুটের দাম ১,০০০ থেকে ১,২০০ টাকার মধ্যে শুরু হয়। ৩,০০০ থেকে ৫,০০০ টাকা খরচ করলে ভালো মানের মুকুট পাওয়া যায়। আর কাস্টম অর্ডার করলে দামের কোনো ঠিক নেই। নকশার ওপর নির্ভর করে তখন দাম ঠিক করা হয়। যত নকশা বেশি, দামও তত বেশি। অনেকে বর-কনের জন্য ম্যাচিং মুকুট কেনেন।
আমাদের দেশের শোলাশিল্প দিন দিন সীমিত হয়ে আসছে। হিন্দু বিয়ের মুকুটই এখন সবচেয়ে বেশি প্রচলিত শোলাশিল্প। আমাদের দেশে তৈরি শোলার মুকুট ভারতেও রপ্তানি হয়। এই শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য কর্তৃপক্ষের যথাযথ উদ্যোগ কামনা করেন শোলাশিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মানুষেরা।
ছবি: ফাইয়াজ আহনাফ সামিন/টিবিএস