টাকা যেভাবে অসুস্থ হয়!

দেশজুড়ে নতুন এক উপদ্রব দেখা দিয়েছে। ছেলে-বুড়ো সবাই অতিষ্ঠ এর জ্বালায়। এ হলো ছেঁড়া, টুটা-ফাটা আর নরম হয়ে যাওয়া টাকার যন্ত্রণা।
"টাকা একটা ভেজাইল্যা জিনিস, না থাকলে চলে না, আবার থাকলেও যন্ত্রণা"—বলছিলেন মিরপুর ৬ নম্বর কাঁচাবাজারের মাছ বিক্রেতা ৬৫ বছরের ফোরকান মিয়া।
'মানি ইজ হানি'
বলা হয়, মানি ইজ হানি। কিন্তু সেই টাকাকেই আজ যন্ত্রণা মনে করছেন ফোরকান। কারণ জানতে চাইলে বললেন, "এটা ঘুম হারাম করে দেয়। কাল রাতে গেছি কাওরানবাজার, খুঁজে খুঁজে ২৫ হাজার টাকার মাছ আনছি। ১০ হাজার টাকা দিয়া আসছি। বাকি ১৫ হাজার আজকে না দিতে পারলে মহাজন মাছ দিবে না, উল্টা গালাগালিও করবে।"
সারাদিনে দেড়শ জনকে ডাকাডাকি করেন ফোরকান। এরমধ্যে ৪০–৫০ জন মাছ কেনেন, আবার কয়েকজন বকাঝকাও করেন। সবই সহ্য করতে হয় টাকার জন্য। অথচ হাতে আসা নোটের অবস্থা করুণ—কেমিক্যাল উঠে গিয়ে সাদা হয়ে গেছে, গুনতে গেলেই ছিঁড়ে যায়। তাই অনেক সময় ফোরকানের মনে হয়, "যদি টাকা না থাকত, তবে হয়তো ভালোই হতো।"
টাকার হাল
ছোটবেলায় এত টাকা দেখেননি ফোরকান। তখন রেজগি বা পয়সার প্রচলন বেশি ছিল। এক টাকা ২০ পয়সায় তিনি কিনেছেন এক সের চাল। এখন বাজারে টাকা প্রচুর, কিন্তু তার মূল্য কমে গেছে। পাঁচ টাকা খরচ করতেও খারাপ লাগে। এক কাপ চায়ের দাম এখন দশ টাকা—এটাই কার্যত সর্বনিম্ন মান।
বাজারে সবচেয়ে খারাপ অবস্থা ৫, ১০ আর ২০ টাকার নোটের। না ধরা যায়, না রাখা যায়।

আলু-পেঁয়াজ বিক্রেতা দীন মোহাম্মদ (৬২) বললেন, "দশ-বারো বছর আগের নোটও এখন বাজারে ঘুরছে। এই সময়ে কত মানুষের হাতে গেছে! কত জেলা ঘুরেছে! শীত–গ্রীষ্ম–বর্ষা পার করেছে। অবস্থা খারাপ না হয়ে কি উপায় আছে? তবে সবাই যদি একটু গোছগাছ করে টাকা রাখত, তাহলে টাকারও আয়ু বাড়ত।"
টাকা এসেই চলে যায়
দীনের মতে, মাছওয়ালা আর মাংসওয়ালাদের হাতেই নোট সবচেয়ে বেশি নষ্ট হয়। মাছওয়ালারা ভেজা হাতে টাকা নেন, মাংসওয়ালাদের টাকায়ও লেগে যায় চর্বি–রক্ত।
মাছ বিক্রেতা ফরিদ আহমেদও একমত। তিনি বললেন, "হ্যাঁ, টাকা আমাদের হাতেই বেশি নষ্ট হয়। ভেজা হাতে টাকা নেই, ফেরত দেই। ভিজতে ভিজতে টাকা অসুস্থ হয়ে যায়।"
মিরপুর ইনডোর স্টেডিয়ামের পেছনে ভোরে একটি বাজার বসে। সেখানে শাক–সবজি বিক্রি করেন নূরুল ইসলাম (৩০)। প্রতিদিন ১০–১২ হাজার টাকার লেনদেন করেন তিনি।
টাকা নিয়ে তার মন্তব্য, "পৃথিবীতে এমন মানুষ নাই যে টাকা ধরেনি। ধনী–গরিব সবার হাতেই টাকা যায়। ধনীরা ধরে ভদ্রভাবে, রাখে মোলায়েম জায়গায়। গরিবেরা যেখানে-সেখানে রাখে। তবে তাদের হাতে টাকা থাকে অল্প সময়। আসার কিছুক্ষণের মধ্যেই মহাজনের পাওনা, বাজার–সদাই বা কিস্তি শোধে ফুরিয়ে যায়।"

'অখাদ্য' টাকা যায় গুলিস্তানে
আপনি কেমন টাকা পান? জানতে চাইলে বাজারের সবজি বিক্রেতা নূরুল ইসলাম বললেন, "আমরা কম পুঁজির ব্যবসায়ী। কলমি শাক ১৫ টাকা আঁটি, পাট শাক দুই আঁটি ৩০ টাকা, লাউ ৫০–৬০ টাকা, চিচিঙ্গা ৬০ টাকা কেজি। তাই আমাদের হাতে ১০, ২০, ৫০ টাকার নোটই বেশি আসে। ১০০ বা ৫০০ টাকার নোট কম পাই।"
"তবে ছেঁড়া–ফাটা আর নরম নোটই বেশি মেলে। এগুলো মহাজনকে দিলে নেয়, কারণ তাদের ব্যাংকের সঙ্গে লেনদেন আছে। কিন্তু একেবারে অখাদ্য টাকা হলে গুলিস্তানে গিয়ে বদলাতে হয়। আবার টাকার ব্যবসা করা লোকেরাও এসে কিনে নেয়," বললেন তিনি।
বাজারে দেখা হলো ভৈরবের জাহানারা বেগমের সঙ্গে। সপ্তাহে তিনদিন মাসকলাইয়ের ডালের গুড়া নিয়ে আসেন তিনি। আড়াই হাজার টাকার মাল নিয়ে প্রতিদিন সকালের ট্রেনে এয়ারপোর্ট নামেন, বাসে করে মিরপুরে আসেন, সন্ধ্যায় আবার ট্রেনে ফেরেন।
জাহানারা এক দুঃখী মানুষ। চুপচাপ বসে ছিলেন বাজারের কোণে, মুখে গভীর বিষণ্ণতা। করোনাকালে স্বামী পাগল হয়ে গেছেন, নিজেদের জায়গাজমি কিছু নেই। ভৈরবে ৪,০০০ টাকা ভাড়ার ঘরে থাকেন দুই সন্তান নিয়ে। সংসার চলে তার একার রোজগারে। যেদিন বাজারে আসেন না, সেদিন করেন বাসা-বাড়ির কাজ। টাকা রাখেন ছোট্ট লাল খুতিতে, চিকন দড়ি দিয়ে গলায় বাঁধা থাকে সেটি।

কে কোথায় টাকা রাখেন
টাকা নষ্ট হওয়ার পেছনে রাখার জায়গাটিও গুরুত্বপূর্ণ। কে কোথায় টাকা রাখেন তা দেখতে গিয়েছিলাম শ্যামবাজারে। সদরঘাটের কাছে বুড়িগঙ্গার পাড়ে পাইকারি এক ঐতিহ্যবাহী কাঁচাবাজারের নাম শ্যামবাজার। এখনো এখানে বেশিরভাগ শাক–সবজি আসে নদীপথে। লালকুঠি ঘাট, মসজিদ ঘাট আর বাজার ঘাটে সকালে ট্রলার ভিড়তে দেখা যায়। শহরের বিভিন্ন প্রান্তের খুচরা বিক্রেতারা শ্যামবাজার থেকে পাইকারি দরে পণ্য নিয়ে নিজ এলাকায় বিক্রি করেন।
ক্রেতা ও বিক্রেতাদের টাকা রাখার জায়গায় কিছু পার্থক্য আছে। বিক্রেতারা যেহেতু বড় অঙ্কের লেনদেন করেন, তারা দীর্ঘ সময় টাকা হাতে রাখেন এবং ক্রেতাদের ভাংতি দেন। মানিব্যাগ ব্যবহার করেন না, কারণ হাজার হাজার টাকা মানিব্যাগে রাখা সম্ভব নয় এবং বারবার ভাংতি দেওয়া ঝামেলাও হয়। অনেকে আবার টাকা রাখেন পকেটে।
কেরামত আলী কচু ও পুঁইশাকের পাইকারি বিক্রেতা। তিনি পকেটে টাকা রাখেন। সব টাকা একসঙ্গে বের করে প্রয়োজনমতো ভাংতি বুঝিয়ে দিয়ে আবার আগের জায়গায়ই ফিরিয়ে রাখেন।
ইসলামপুরের নবাববাড়ি থেকে এক নারী ক্রেতা এসেছেন কেরামত আলীর কাছে। তিনি নবাববাড়ির গোলতালাবের ধারে ৩০ বছর ধরে কাঁচামালের ব্যবসা করেন। প্রতিদিন সকালে শ্যামবাজার থেকে পণ্য কেনেন। এদিন কেরামত আলীর কাছ থেকে নিলেন পুঁইশাক। তার হাতে ঝুলছিল একটি কালো খুঁতি। পলিথিনে মুড়িয়ে তিনি যত্ন করে খুঁতির ভেতর টাকা রাখেন।

তার পেছনে একজন মুটেকে দেখা গেল। মাথায় রাখা চাঙারিতে শাকগুলো তুলে দিয়ে তিনি তাড়াহুড়া করে চলে গেলেন, কারণ আরও অনেক কেনাকাটা বাকি।
মো. রাব্বি বিক্রি করেন দেশি ও বিলাতি ধনেপাতা। তিনি টাকা রাখেন কোমরে গুঁজে রাখা একটি পলিথিন ব্যাগে। এতে বৃষ্টি থেকেও টাকা নিরাপদ থাকে এবং লেনদেনও সহজ হয়। দেশি ধনেপাতা তিনি বিক্রি করছিলেন কেজিপ্রতি ২৫০ টাকায়।
তিনি বললেন, "যত দ্রুত সম্ভব কাঁচামাল বিক্রি করে ফেলতে হয়। সকাল আটটার পরেই এর দাম নেমে আসে ২০০ বা ২২০ টাকায়। পরের পনের মিনিটে আবার দাম কমে যায় ২৫–৩০ টাকা। তাই সবসময় তাড়াহুড়া থাকে। এই সময়ে টাকা গুছিয়ে রাখা সম্ভব হয় না। ভিজা হাতেই নিতে হয়, পরে রোদে শুকাই।"
মানিব্যাগ ব্যবহারের সুযোগ নেই
মাছবিক্রেতা ও সবজিবিক্রেতারা সাধারণত প্যান্ট পরেন না। অনেকেই লুঙ্গির কোচড়ে টাকা গুঁজে রাখেন। হাঁটা বাজারের নূরুল ইসলাম বলেছিলেন, "লুঙ্গি যারা পরে তারা মানিব্যাগ রাখবে কোথায়? অনেক সময় হারিয়ে যায়, আবার এটা অভ্যাসের ব্যাপারও। আমি একটা কাঁধ ব্যাগ ব্যবহার করি আর খুচরা টাকা রাখি পলিথিনে। আগে কোমরের বেল্ট ব্যাগ ব্যবহার করতাম, সেটিও ভালো ছিল। অনেক মহিলাকে আবার দেখেছি শাড়ির আঁচলে গিঁট দিয়ে টাকা রাখতে। এই টাকাগুলোর চেহারা বলতে কিছু থাকে না। নেওয়ার সময় সাবধান থাকতে হয়।"
৬ নম্বর বাজারে কয়েকজন তরুণ মাছ বিক্রেতার দেখা মিলল। তারা প্যান্ট পরেন, টাকা রাখেন পকেটে। ভরবাজারের সময় যেনতেনভাবে গুঁজে রাখায় টাকার বারোটা বাজে।

ঘামে টাকার ক্ষতি
তবে নূরুল ইসলামের মতে, টাকা সবচেয়ে বেশি নষ্ট হয় হাতে দীর্ঘক্ষণ ধরে রাখলে। ঘামে টাকার ক্ষতি হয় সবচেয়ে বেশি।
রিকশাওয়ালাদের হাতে টাকার অবস্থা জানতে চাইলে তিনি বললেন, "তারা দিনে ১,০০০-১,২০০ টাকার কাজ করেন। অনেকে মানিব্যাগ ব্যবহার করেন, কেউ কোমরে গুঁজে রাখেন। তবে সংখ্যাটা কমছে। অটোরিকশা আসার পর প্যান্ট পরা রিকশাওয়ালার সংখ্যা বেড়েছে, তারা পকেটে মানিব্যাগ রাখেন।"
মিরপুর ১০ নম্বরে আলোক হাসপাতালের কাছে রিকশাওয়ালা রানাকে পেলাম। তার কাছে টাকা এক মজার জিনিস—থাকলে রাজা, না থাকলে ফকির। তিনি টাকা রাখেন একটি প্লাস্টিকের বয়ামে। এতে বৃষ্টিতেও অসুবিধা হয় না। কিছু রিকশাওয়ালা টিস্যু ব্যাগে টাকা রাখেন। এতে টাকা নিরাপদ থাকে এবং লেনদেনও সহজ হয়।

টাকার জন্য দুনিয়া পাগল, অথচ যথাযথ যত্ন পাচ্ছে না এই টাকা। ফলে টাকা অসুস্থ, অখাদ্য ও নোংরা হয়ে যাচ্ছে।
আলু–পেঁয়াজের ব্যবসায়ী দীন মোহাম্মদ বললেন, "যেহেতু সবারই টাকা দরকার, তাই সবারই এর স্বাস্থ্যের দিকে খেয়াল রাখা উচিত। আরও খারাপ হওয়ার আগেই আমাদের টাকার যত্ন নেওয়া শেখা দরকার।"