সান্ডা কিন্তু আপনার পরবর্তী স্ট্রিট ফুড না!

আমরা প্রায়ই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে নতুন নতুন শব্দ ও ট্রেন্ড এত দ্রুত শিখে নিই যে তা একদিকে আমাদের অজান্তেই দৈনন্দিন জীবনের অংশ হয়ে ওঠে ঠিকই—তবে এর সুবিধা-অসুবিধা কিংবা নেতিবাচক প্রভাব নিয়ে খুব একটা ভাবার সুযোগই পাই না।
এই দ্রুত ছড়িয়ে পড়া সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ট্রেন্ডগুলো কেবল কথোপকথন নয়, প্রভাবিত করে আমাদের আচরণকেও, যার ফলে এসব ট্রেন্ডের আবহ এবং আমাদের নির্দোষ মজার আড়ালে কিছু অনিচ্ছাকৃত ক্ষতিও ঘটে থাকে।
এই যেমন বেশ কিছুদিন ধরে 'সান্ডা', 'কফিলের ছেলে'—এই দুই শব্দ ফেসবুকের রিল ও নিউজফিডে প্রায়ই চোখে পড়ছে। ঠাট্টা-মজা থেকে শুরু হওয়া এই 'সান্ডা'কে ঘিরে বাংলাদেশিদের মধ্যে নতুন এক ধরনের কৌতূহলও দেখা যাচ্ছে।
তবে 'সান্ডা'কে ঘিরে এই ট্রেন্ড আর কৌতূহলকে আমরা কীভাবে সামাল দিচ্ছি তা নিয়ে অবশ্যই এখন প্রশ্ন তোলা উচিত।
সান্ডা নিয়ে এই আলোচনার শুরু মূলত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হওয়া এক ভিডিওর মাধ্যমে। ভিডিওটিতে দেখা যায়, মধ্যপ্রাচ্যের কোনো এক জায়গায় একজন প্রবাসী বাংলাদেশি গরম ভাত দিয়ে সান্ডার মাংস বেশ জমিয়ে খাচ্ছেন। কয়েক সেকেন্ডের এই ভিডিও ধীরে ধীরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে।
অনেকে দেখেছেন কৌতূহল নিয়ে, কেউ বা ঠাট্টা করে। কিন্তু এরপর যা ঘটেছে, তা বরং আরও চিন্তার বিষয়। বাংলাদেশের কিছু মানুষ, হয় ট্রেন্ডে গা ভাসাতে গিয়ে না হয় অদ্ভুত এক সাহস দেখাতে গিয়ে, বিদেশ থেকেই সান্ডার মাংস আমদানি করার চেষ্টা করছেন। আবার কেউ কেউ স্থানীয় গুইসাপ রান্না করে সান্ডা খাওয়ার অভিজ্ঞতা নেওয়ার চেষ্টাও করেছেন!
ফল যা হওয়ার তা-ই হয়েছে—খাওয়ার পর গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েছেন কয়েকজন।
করোনার সময় ভাইরাল 'ডালগোনা কফি' কিংবা দুবাইয়ের ভাইরাল 'কুনাফা চকলেট' আর মধ্যপ্রাচ্যের ভাইরাল সান্ডার মাংসকে এক কাতারে ফেলা যদি আমাদের কাছে এতটাই স্বাভাবিক হয়, তবে এটি নিছক ট্রেন্ডের আবহে গা ভাসানোর চেয়ে আরও বড় এক সমস্যার লক্ষণ—আমরা ধীরে ধীরে প্রকৃতি ও বন্যপ্রাণী থেকে কতটা দূরে সরে যাচ্ছি, আর সেই বিচ্ছিন্নতার ফলেই সবকিছুকেই আমরা দেখছি খাবার হিসেবে!
সান্ডার বৈজ্ঞানিক নাম ইউরোমাস্টিক্স হার্ডউইকি (Uromastyx hardwickii), বর্তমানে 'সারা' (Saara) গণের প্রাণী। দক্ষিণ এশিয়া থেকে শুরু করে মধ্যপ্রাচ্য পর্যন্ত শুষ্ক ও অর্ধশুষ্ক উভয় পরিবেশই এই গুইসাপ আকৃতির প্রাণীটি টিকে থাকতে পারে।
ভারতের থর মরুভূমি থেকে শুরু করে পশ্চিমে আরবের বিস্তৃত মরুভূমি—যেদিকে তাকানো যায়, সেদিকেই ছড়িয়ে আছে এই প্রাণী। তবে অতিমাত্রায় প্রতিকূল পরিবেশে বাঁচার মতো শারীরিক গঠন থাকলেও মানুষের লোভের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার মতো শক্তি তো সান্ডার আর নেই।
আরব বিশ্বের অনেক জায়গায় এই কাঁটাযুক্ত লেজওয়ালা প্রাণীটি বন-জঙ্গল থেকে ধরা হয়, তারপর জমজমাট বেচাকেনা চলে বাজারে।
সান্ডার সবচেয়ে বেশি চাহিদা নাকি এর 'যৌনশক্তি বাড়ানোর' গুণ দেখে। এসবের কোনো বৈজ্ঞানিক প্রমাণ না থাকলেও, বাজারে তাতে খুব একটা আসে-যায় না।
কেউ খায় বিশ্বাস করে, কেউ দেখানোর জন্য। কিন্তু যেভাবেই হোক না কেন, শেষ পর্যন্ত ফলটা একটাই—এই প্রজাতির প্রাণীর সংখ্যা দিন দিন কমে যাচ্ছে।
ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অভ নেচার (আইইউসিএন) সান্ডাকে এখন 'ঝুঁকিপূর্ণ' প্রজাতি হিসেবে তালিকাভুক্ত করেছে। এমনকি কিছু গবেষণা বলছে, পুরো পৃথিবীতে টিকে আছে মাত্র ১০ হাজারেরও কম প্রাপ্তবয়স্ক সান্ডা। লাগামহীন শিকার এবং বাছবিচার ছাড়া যেকোনো প্রাণী খাওয়ার পরিণতি আর কী হতে পারে!
এক্ষেত্রে বাংলাদেশকে কতটুকুই বা ব্যতিক্রমী বলা যায়!
কোথাও বেড়াতে গেলেই যেন সেখানকার সবচেয়ে অদ্ভুত বা বিরল প্রাণীটা না খেলেই নয়। বাংলাদেশি প্রবাসীর ভাইরাল হওয়া সেই ভিডিও আর বিরল বন্যপ্রাণীর প্রতি আমাদের আগ্রহ আসলে একটা বড় সমস্যার ইঙ্গিত।
এই ধরনের বন্য প্রাণী খাওয়া তো বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় নয়, এটি কোনো ঐতিহ্যও নয়—শুধু এক ধরনের লোভ—ভোজনরসিকতার নামে পুরোনো এক পাপের আধুনিক সংস্করণ।
বিয়ে হোক বা ছুটির ভ্রমণ, পাহাড় বা হাওর—সর্বক্ষণই আমরা যেন নতুন কিছু খাওয়ার অভিজ্ঞতা খুঁজে বেড়াই, কীভাবে সবচেয়ে 'দুর্লভ' প্রাণীটা খেয়ে ফেলা যায়।
হাওরে গেলে চাই সবচেয়ে বড় মাছ। আইন-কানুনের তোয়াক্কা না করে অতিথি পাখির মাংস খাওয়ার জন্য অধীর আগ্রহে বসে থাকি। পাহাড়ে গেলে খুঁজে ফিরি বনমোরগ, আবার ট্যুর গাইডদের জোরাজুরি করে বলি বিরল প্রাণীর মাংস খাওয়াতে।
আবার সুন্দরবনে গেলেই চাই হরিণের মাংস। আর কখনো যদি কোনো নীলগাই বাংলাদেশের সীমান্তে ঢুকে পড়ে, সেটাকে তাড়া করে মেরে ফেলা হয়, রান্নাও হয়ে যায়। এমনকি শকুন থেকে শুরু করে বিপন্ন পাখিরাও নিরাপদ নয়—তারা ক্লান্ত হয়ে কোথাও নেমে বসলে ধরে এনে রান্না করে ফেলার ঘটনাও ঘটে প্রচুর।
এটা কোনো সাধারণ লোভ নয়, শুধু খাওয়ার লোভ নয়—এটা এক ধরনের অন্ধ খিদে, যেটা মানুষকে একটা বন্যপ্রাণীকে জীবন্ত একটি প্রাণী হিসেবে না ভেবে রান্নার উপকরণ হিসেবে দেখতে শেখায়।
এই লোভ একবার মাথায় চেপে বসলে তখন আর আইন, ধর্ম বা নীতি-নৈতিকতা—কিছুই কাজে আসে না। তখন আর কোনো প্রাণী 'বিরল', 'পবিত্র' বা 'প্রকৃতির জন্য জরুরি' বলে রেহাই পায় না।
এই প্রেক্ষাপটে 'সান্ডা' নিয়ে এত হইচই কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এটা আমাদের মনোভাবের প্রতিফলন—কীভাবে প্রকৃতিকে আমরা আশ্রয় হিসেবে নয়, বরং খাবারের তালিকা হিসেবে দেখি। কৌতূহল কীভাবে ধ্বংসে রূপ নেয়, এই প্রবণতা তারই প্রতিচ্ছবি।
সংরক্ষণকর্মী বা প্রকৃতিপ্রেমীরা একা এই প্রাণীগুলোকে রক্ষা করতে পারবেন না। আমাদের দরকার একটি সাংস্কৃতিক পরিবর্তন—অবিবেচক ভোগের বদলে সচেতন সহাবস্থানের চর্চা।
ছোটবেলায় আমরা ভাবসম্প্রারণে শিখেছিলাম—'বন্যেরা বনে সুন্দর শিশুরা মাতৃক্রোড়ে'। তাই ভবিষ্যতে এমন কোনো ভিডিও ভাইরাল হলে, সেই ট্রেন্ডে মেতে ওঠার আগে একটু ভাবুন।
কোথাও ঘুরতে গিয়ে নিজের কাছে একবার প্রশ্ন রাখুন—প্রত্যেকটা ভ্রমণের অভিজ্ঞতার শেষ কি মাংস-পাতে হতে হবে? নাকি কিছু বন্যপ্রাণীকে তাদের নিজের বনে বাঁচতে দেওয়াটাই ভালো?
- অনুবাদ: আয়েশা হুমায়রা ওয়ারেসা