গ্রামীণ বাংলাদেশে যেভাবে এসির বিপ্লব ঘটছে

টাঙ্গাইলের জোবায়দা খানম প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একজন শিক্ষিকা। প্রতিদিনই পায়ে হেঁটে বাড়ি ফেরেন তিনি। কিন্তু এখন যখন বাড়ি ফেরেন তখন বাড়ির ভেতর থেকে এয়ার কন্ডিশনারের (এসি) মৃদু শব্দ শুনতে পান। জোবায়দা খানম কখনও চিন্তাই করতে পারেননি যে তার বাড়িতে এসি চলবে।
'আমি তো সরকারি প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষক, একেবারে সাধারণ মধ্যবিত্ত নারী,' হাসিমুখে বলেন জোবায়দা। 'পাঁচ বছর আগেও ভাবতে পারিনি নিজের বাসায় এসি লাগাব। কিন্তু এখন সহজ কিস্তির সুবিধায় সামান্য কিছু টাকা জমা দিয়েই কিনে ফেলেছি। জীবনটা অনেক বেশি আরামদায়ক হয়েছে।'
জোবায়দার এ গল্প আসলে বাংলাদেশের বদলে যাওয়া এক গ্রামীণ পরিবারের ছবি। হয়তো এ পরিবর্তন এখনও খুব একটা আওয়াজ তোলেনি কিন্তু এটা গ্রামীণ জীবনে একটি বড় পরিবর্তন আনতে যাচ্ছে।
তাপমাত্রা বাড়ছে, আর আর্থিক সেবাগুলো পৌঁছে যাচ্ছে মানুষের দোরগোড়ায়। একসময় যেসব এসি ছিল শুধুই ধনীদের বিলাস, এখন সেগুলো জায়গা করে নিচ্ছে সাধারণ ঘরেও। উন্নত প্রযুক্তি, সহজ কিস্তির সুবিধা আর আরামের প্রতি চাহিদা—সব মিলিয়ে গ্রামবাংলার জীবনধারায় ঢুকে পড়ছে ঠান্ডা হাওয়ার এ যন্ত্রটি।
শহুরে আরাম থেকে গ্রামের স্বস্তি
২০২১ সালে বাংলাদেশের গ্রামীণ এলাকায় মাত্র শূন্য দশমিক ৪৩ শতাংশ পরিবারের ঘরে ছিল এয়ার কন্ডিশনার। তবে মাত্র দুই বছরের ব্যবধানে, ২০২৩ সালে সেই সংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ হয়ে দাঁড়িয়েছে শূন্য দশমিক ৭৯ শতাংশে—'দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড'-এর গবেষণা দলের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এমন তথ্য।
শহরেও এসি ব্যবহারের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে—৫ দশমিক ১৯ শতাংশ থেকে বেড়ে ৬ দশমিক ৯২ শতাংশ হয়েছে। তবে শহরের বাইরে ধীরে ধীরে যে হারে এসি ব্যবহারকারীর সংখ্যা বাড়ছে তা উল্লেখযোগ্য। এ থেকে বোঝা যায়, বাংলাদেশের গ্রামীণ জনপদ ধীরে ধীরে জলবায়ু পরিবর্তন ও ভোক্তা পর্যায়ে সহজলভ্যতা বৃদ্ধির প্রেক্ষাপটের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিচ্ছে।
সারাদেশের হিসাবেও এয়ার কন্ডিশনার মালিকানার হার ২০২১ সালের ১ দশমিক ৬০ শতাংশ থেকে ২০২৩ সালে বেড়ে হয়েছে ২ দশমিক ২৮ শতাংশ। সংখ্যাটা হয়তো কাগজে কলমে খুব বড় মনে না হলেও, বাংলাদেশের আর্থিক, অবকাঠামোগত ও পরিবহনগত চ্যালেঞ্জের প্রেক্ষাপটে এটি এক বিশাল অগ্রগতি।কারণ আগে নানাবিধ লজিস্টিক, আর্থিক ও অবকাঠামোগত বাধার কারণে অনেকেই এসি কেনার কথা ভাবতেই পারতেন না।
আমদানিকারক ও উৎপাদকদের ভাষ্য, চলতি মৌসুমে চাহিদা এতটাই বেড়েছে যে, সাধারণ সময়ের তুলনায় বিক্রি দ্বিগুণেরও বেশি হয়েছে। দাম ৫০০ থেকে ১,৫০০ টাকা পর্যন্ত বাড়লেও, বিক্রিতে কোনো ভাটা পড়েনি। বিক্রেতারা বলছেন, শুধু গরমই নয়, মানুষের আরামের প্রতি চাহিদাও এখন এই বৃদ্ধির অন্যতম কারণ।
বাংলাদেশজুড়ে, বিশেষ করে দিনাজপুরের মতো তীব্র গ্রীষ্মপ্রবণ এলাকাগুলোতে গরম অসহনীয় ও আরও তীব্র হওয়ায়, তা সামাল দেওয়া কঠিন হয়ে উঠেছে। দিনাজপুরের এক ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী রঞ্জন সরকার বলেন, 'আগে এসি কিনতে ভয় লাগত, কারণ ধরুন কোনোভাবে কিনেও ফেললাম, কিন্তু বিদ্যুৎ বিল চালাতে পারতাম না। এখনকার এসিগুলো এতটাই বিদ্যুৎ সাশ্রয়ী যে চালাতে খরচ পড়ে প্রায় সিলিং ফ্যানের মতোই। সেটাই আমাকে সাহস দিয়েছে।'
রঞ্জনের কথায় যে পরিবর্তনের ইঙ্গিত, তার পেছনে বড় ভূমিকা রেখেছে প্রযুক্তির উন্নতি, বিশেষ করে ইনভার্টার প্রযুক্তির বিকাশ। এই ধরনের এসি মডেলগুলো দ্রুত ঠাণ্ডা করে এবং তুলনামূলক কম বিদ্যুৎ ব্যবহার করে, যা মধ্যবিত্ত ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোর জন্য দারুণ সুবিধাজনক।
ওয়ালটন এয়ার কন্ডিশনারের ডেপুটি চিফ বিজনেস অফিসার সন্দীপ বিশ্বাস বলেন, 'এই মাসে কোম্পানির বিক্রয় অনেক বেড়েছে। মানুষ গরমের ভোগান্তি থেকে মুক্তি চায়। উন্নত বৈশিষ্ট্য ও বিদ্যুৎ সাশ্রয়ী ইনভার্টার প্রযুক্তিতে ওয়ালটনের প্রতি তাদের আস্থা রয়েছে।'
ইএমআই বা কিস্তি: দ্য গেইম চেইঞ্জার
মধ্যবিত্ত আর নিম্ন-মধ্যবিত্ত অনেক পরিবারের কাছেই এককালীন ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকা খরচ করে এসি কেনা একসময় ছিল অকল্পনীয়। কিন্তু কিস্তিতে মূল্য পরিশোধের সুবিধা—অথবা ইএমআই ব্যবস্থার আবির্ভাব—এই বাস্তবতাকেই পাল্টে দিয়েছে।
বিক্রেতারা এখন ক্রেতাদের মাত্র ১০ শতাংশ ডাউন পেমেন্ট দিয়ে একটি এসি কেনার সুযোগ করে দিচ্ছেন। এর মাধ্যমে ক্রেতারা পরবর্তী কিস্তি মাসে মাসে পরিশোধ করে এসির মালিকানা নিজের করে নিতে পারবে। ফলে একসময় শুধু ধনীদের হাতের নাগালে থাকা আরামের সামগ্রী এখন কিস্তি সুবিধায় সাধারণ মানুষের ঘরেও পৌঁছে যাচ্ছে।
নওগাঁর এক নামকরা ইলেকট্রনিক্স দোকানের মালিক আব্দুল হালিম বলেন, 'কিস্তি সুবিধা সবকিছু বদলে দিয়েছে। এখন মানুষকে আর স্বাচ্ছন্দ্য এবং সাশ্রয়ী মূল্যের মধ্যে আপস করতে হয় না, বিশেষ করে মফস্বল ও গ্রামীণ জেলাগুলোতে এর সুফল দেখা যাচ্ছে।'
জোবায়দার গল্প এই পরিবর্তনেরই প্রতিচ্ছবি। প্রযুক্তির সঙ্গে তেমন কোনো সখ্য ছিল না এমন টাঙ্গাইলের মতো জেলাতেও এখন দোকানগুলোতে শুধু এসি বিক্রি হচ্ছে না, সহজ কিস্তি সুবিধা আর বিক্রয়োত্তর সেবাও মিলছে
শিশু, স্বাস্থ্য এবং অনুভূতির ওপর প্রভাব
পাবনার ফরিদপুরে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত আমিনুল ইসলামও একটি এসি কিনেছেন। এটি কেনার পেছনের কারণ হলো তার পাঁচ বছর বয়সী ছেলে। তিনি বলেন, 'আমি এটি আমার পাঁচ বছর বয়সী ছেলের জন্য কিনছি। গরম অসহনীয়, এবং আমি শুধু নিশ্চিত হতে চাই যে সে বাড়িতে স্বাচ্ছন্দ্যে থাকবে।'
সন্তানের জন্য এ বিশেষ অনুভূতির কথা অনেক অভিভাবকই প্রকাশ করেছেন। তারা জানান, টিনের চালযুক্ত বাসা-বাড়িতে গ্রীষ্মকাল একদম অসহনীয় হয়ে ওঠে। অনেকেই এখন শুধুমাত্র অর্থনৈতিক যুক্তিতে নয়, বরং সন্তান, বয়স্ক সদস্য বা অসুস্থ পরিবারের সদস্যদের কথা ভেবেও এসি কেনার সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন।
তীব্র গরম আর স্বাস্থ্যের মধ্যে যে সরাসরি সম্পর্ক আছে, সেটাও মানুষ এখন বেশি করে উপলব্ধি করছে। দীর্ঘ সময় অতিরিক্ত তাপমাত্রার মধ্যে থাকলে হার্টের সমস্যা, শ্বাসকষ্ট কিংবা পানিশূন্যতাজনিত অসুস্থতা বেড়ে যেতে পারে। এই প্রেক্ষাপটে, এসি আর কেবল বিলাসবহুল আরামের প্রতীক নয়—এটি এখন এক ধরনের স্বাস্থ্য সুরক্ষার ব্যবস্থাও।
ছাড় আর প্রতিযোগিতায় বেড়ে চলা বাজা
চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় এসি বাজারে চলছে হাড্ডাহাড্ডি প্রতিযোগিতা। একে একে সব ব্র্যান্ডই নিয়ে আসছে ঈদ অফার, সামার সেলসহ নানা ছাড়ের ঘোষণা, যেখানে ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত মূল্যছাড় দেওয়া হচ্ছে।
একটি সংবাদ সংস্থার কর্মী টুকু মিয়া জানালেন, 'আমি ঈদ অফারে ৪০ শতাংশ ছাড়ে এসি কিনেছি। ওই ছাড়টা না পেলে হয়তো কোনোদিন কেনাই হতো না।'
ভালো বিপণন প্রচারণা, সহজ কিস্তি সুবিধা আর উন্নত প্রযুক্তির সমন্বয়ে এসির বাজার হুড়হুড় করে বাড়ছে—শুধু শহরেই নয়, ছড়িয়ে পড়ছে দেশের মফস্বল আর প্রত্যন্ত অঞ্চলেও।
পরিসংখ্যান আমাদের প্রবণতা দেখাতে পারে, তবে প্রকৃত গল্প লুকিয়ে আছে শিক্ষিকা জোবায়েদা, অভিভাবক আমিনুল কিংবা ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী রঞ্জনের মতো মানুষগুলোর মধ্যে—যাদের প্রত্যেকের কারণ আলাদা হলেও লক্ষ্য একটাই: নিজেদের ঘরে একটু বেশি আরাম নিয়ে আসা।
তারা সেই গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব করে, যারা ধীরে ধীরে হলেও আধুনিক সুযোগ-সুবিধার সাথে নিজেদের মানিয়ে নিচ্ছে। যদিও সার্বিকভাবে এসি মালিকানার হার এখনো তুলনামূলকভাবে কম, তবে এর যে গতি দেখা যাচ্ছে, তা একটি বড় সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিচ্ছে। এসি এখন আর বিলাসিতার জন্য নয় বরং প্রয়োজন, সহজলভ্যতা এবং টিকে থাকার তাগিদ থেকেই এ পরিবর্তন ঘটছে।
মূল লেখা থেকে অনুবাদ: সাদিয়া আফরিন রেনেসাঁ