পহেলা বৈশাখের আনন্দ শোভাযাত্রায় ১০০ ফুট দীর্ঘ পটচিত্র

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) চারুকলার আঙিনায় রবিবার বিকালে দেখা যায় পাঁচটি পটচিত্রে শেষ মুহূর্তের রং-তুলির আঁচরে বিভিন্ন দৃশ্য ফুটিয়ে তুলছেন শিল্পীরা। পটচিত্র আকবর, পটচিত্র বাংলাদেশ, পটচিত্র বেহুলাপটচিত্র বনবিবি ও গাজীরপট নামে ভিন্ন ভিন্ন পটচিত্র এঁকেছেন শিল্পীরা।
কথা হয় পটচিত্রের টিম লিডার পটুয়া নাজির হোসেনের সঙ্গে।
তিনি দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে (টিবিএস) বলেন, 'এবারই প্রথম ১০০ ফুট দীর্ঘ পটচিত্র থাকছে বৈশাখের আনন্দ শোভাযাত্রায়। ভিন্ন ভিন্ন নামের প্রতিটি ২০ ফুট দীর্ঘ পাঁচটি পটচিত্রে বাঙালির ঐতিহ্য ও ইতিহাস তুলে ধরা হয়েছে। এর আগে আনন্দ শোভাযাত্রায় ১০ ফুট দীর্ঘ পটচিত্র স্থান পেয়েছিল।'
তিনি আরও বলেন, 'আমি প্রায় ৩০ বছর ধরে পটচিত্র আঁকছি। দিন দিন আমাদের এই ঐতিহ্য হারিয়ে যেতে বসেছে। অনেকেই জানে না পটচিত্র আসলে কি? আমরা চাই বাঙালির হারানো ঐতিহ্য ফিরে আসুক। আমরা আমাদের নিজস্ব ঐতিহ্যে বলীয়ান হতে চাই।'
এবারের পহেলা বৈশাখের আনন্দ শোভাযাত্রায় ১০০ ফুট দীর্ঘ পটচিত্র প্রদর্শন নতুন আয়োজন এবং যা অনন্য মাত্রা যুক্ত করবে বলে প্রত্যাশা আয়োজকদের।

এবারের আনন্দ শোভাযাত্রা সকাল ৯টায় চারুকলার সামনে থেকে শুরু হয়ে জাতীয় জাদুঘর হয়ে শাহবাগের মোড় ঘুরে, টিএসসি হয়ে জাতীয় শহীদ মিনার পেরিয়ে, বায়তুল মোকারম ভবনের সামনের রাস্তা দিয়ে দোয়েল চত্ত্বর ঘুরে চারুকলায় এসে শেষ হবে।
চারুকলার প্রাঙ্গণে 'ফেইস অব ফ্যাসিজম' বা ফ্যাসিবাদের মুখাকৃতি
তৈরিতে ১০ জনের মতো শিল্পী কাজ করছিলেন।
তাদের মধ্যে কথা হয় চারুকলার প্রাক্তন শিক্ষার্থী মিসবাহ উদ্দিন আহমেদের সঙ্গে।
তিনি টিবিএসকে বলেন, 'সবার সম্মতিক্রমেই এবারে আমরা 'ফেইস অব ফ্যাসিজম' কে গুরুত্ব দিয়ে প্রধান মাসকট হিসেবে প্রস্তুত করেছিলাম। কিন্তু বিষয়টি হয়তো ফ্যাসিজমের দোসরদের পছন্দ হয়নি, ফলে আগুন দেওয়ার মতো ঘটনা ঘটিয়েছে। আমরা আগের মতো বড় আকারে প্রস্তুত করতে না পারলেও আশাকরি ছোট আকারে হলেও 'ফেইস অব ফ্যাসিজম' প্রস্তুত করতে পারব।'

তিনি বলেন, 'এই প্রতীক আগামীতে যদি কেউ ফ্যাসিস্ট হতে চায় তাদের জন্য বড় বার্তা। নির্দিষ্ট কোনো ব্যক্তি কিংবা দলের প্রতীক না এটা।'
তিনি আরও বলেন, 'আমরা চারুকলার সাবেক, বর্তমান শিক্ষার্থীদের বাইরেও অনেকেই আমাদের এ কাজে যুক্ত হয়েছেন। এবারের উৎসব মনে হচ্ছে সার্বজনীন। আগে শিল্পীদের ওপর নানা ধরনের চাপ থাকতো কোনটি করা যাবে, কোনটি যাবে না। এবারে স্বাধীনভাবে আমরা প্রস্তুতি নিতে পেরেছি।'
চারুকলার আরেক সাবেক শিক্ষার্থী শিল্পী শরীফ আহমেদ বলেন, 'আমরা আশাকরি এবারে অনেক বড় আয়োজন হবে। জুলাই আন্দোলনের মুগ্ধকে স্মরণ করে বড় করে পানির বোতল বানানো হচ্ছে। আমাদের এই আয়োজনে দেশের সব শ্রেণী-পেশা-জাতীর মিলন ঘটেছে। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী থেকে শুরু করে স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ থাকুক এই আয়োজনে সেটাই প্রত্যাশা।'
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী প্রক্টর ইসরাফিল প্রাণং টিবিএসকে বলেন, 'জনআকাঙ্খার পরিপ্রেক্ষিতে আনন্দ শোভাযাত্রায় ফ্যাসিবাদের মুখচ্ছবি রেখেছিলাম, যা পুড়িয়ে দেওয়ার পরে আবার বানানো হচ্ছে। এছাড়া র্যালিতে জাতীয় মাছ ইলিশ, জাতীয় পশু রয়েল বেঙ্গল টাইগার, শান্তির প্রতীক পায়রা, পালকি, ফোক ঘোড়া, পটচিত্র, তরমুজের ফালি, মুগ্ধের পানির বোতল, নানা ধরনের মুখোশসহ বাঙালী ঐতিহ্যের নানা উপাদান থাকবে '
তিনি বলেন, 'আমরা আশা করি এবারের আয়োজনে বিগত সময়ের চেয়ে অনেক বেশি মানুষ যুক্ত হবে।'

তিনি আরও বলেন, 'আমরা এমন একটি উৎসব করতে চাই যেখানে সবাই অংশগ্রহণ করবে। এই উৎসবকে ঘিরে বাংলাদেশের অর্থনীতির পরিবর্তন হয়েছে। ২৮ টি ভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মানুষ এখানে অংশ নেবে। এছাড়া ২০০ গিটারিস্ট, কবিতা পরিষদ, প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও এই শোভাযাত্রায় অংশ নেবে।'
শোভাযাত্রার সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের নীলক্ষেত ও পলাশী গেইট খোলা থাকবে এবং বাকি গেইটগুলো বন্ধ থাকবে বলে জানান তিনি।
আনন্দ শোভাযাত্রার বাইরেও দেশব্যাপী যত আয়োজন
এদিকে 'আমার মুক্তি আলোয় আলোয়'- এমন বার্তা নিয়ে প্রতি বছরের মত এবারও ছায়ানট রমনার বটমূলে বাংলা নববর্ষকে বরণ করে নিতে প্রস্তুতি নিয়েছে। সেখানে সম্পন্ন হয়েছে মঞ্চ বাঁধার কাজ, অন্যদিকে ছায়ানটের শিক্ষার্থীরাও পূর্ণ প্রস্তুত তাদের সাংস্কৃতিক পরিবেশনা নিয়ে। রবিবার বিকাল থেকে চলে সংগীতের মহড়া।
৭২ ফুট লম্বা ও ৩০ ফুট প্রস্থের মঞ্চে এবারে মোট পাঁচটি ধাপে অংশগ্রহণ করবে দেড় শতাধিক শিক্ষার্থী। রাত পোহালেই একক ও সমবেত কণ্ঠে মুখরিত হবে রমনার প্রান্তর।

ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের আয়োজনে গুলশান-২ এর শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ স্মৃতি পার্কে রবিবার থেকে শুরু হয়েছে 'বৈশাখী মেলা ও নগর উৎসব-১৪৩২'।
সোমবার সকাল ৯টা থেকেই এখানে শুরু হবে বৈশাখী উৎসব। থাকবে কনসার্ট। কনসার্টে গান পরিবেশন করবে জনপ্রিয় ব্যান্ড- শিরোনামহীন, ঘাস ফড়িং কয়ার, প্লাজমিক নক।
সেগুনবাগিচার শিল্পকলা একাডেমিতে ১৩ ও ১৪ এপ্রিল দুই দিনব্যাপী উৎসবের আয়োজন করেছে 'নবপ্রাণ আন্দোলন'। এতে গান, নৃত্য, নাটক, আবৃত্তি ও প্রদর্শনীতে অংশ নিচ্ছেন দেশের খ্যাতনামা শিল্পীরা।
ধানমন্ডির রবীন্দ্র সরোবরে আজ সকাল ৬টা থেকে সুরের ধারা আয়োজনে পাহাড় ও সমতলের জাতিগোষ্ঠীর অংশগ্রহণে বর্ষবরণ হবে। এই আয়োজনে থাকে মুক্তমঞ্চে গান, কবিতা ও নাচের পরিবেশনা, সঙ্গে থাকছে বাঙালি খাবারের নানা আয়োজন।

পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে জাতীয় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় থাকবে চীনা প্রযুক্তি দলের অংশগ্রহণে ব্যতিক্রমী ড্রোন শো। সঙ্গে থাকবে বৈশাখী ব্যান্ড শো এবং বর্ণাঢ্য সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।
ঘুড়ি উৎসব, লাঠিখেলা, সাপখেলা, নাগরদোলা, পুতুলনাচ—এমন নানা আয়োজনে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে হচ্ছে চৈত্রসংক্রান্তি ও বাংলা বর্ষবরণ উৎসব। গ্রামীণ ঐহিত্য আর খুলনার আঞ্চলিক বিষয়কে প্রাধান্য দিয়ে আয়োজিত ওই উৎসব হচ্ছে দীর্ঘ প্রায় পাঁচ বছর পর। ২০১৯ সালে সর্বশেষ এমন পরিপূর্ণ আয়োজন করতে পেরেছিল বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।
এছাড়া, প্রতিবছরের ন্যায় এবারেও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় এবং প্রতিষ্ঠান ও সংস্থার আয়োজনে উদযাপিত হবে বাংলা নববর্ষ।