জন্ম নিবন্ধন সংকট: অনিশ্চয়তায়, ভোগান্তিতে হাজারো মানুষ

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের উত্তরখানের ৪৪ নম্বর ওয়ার্ডে ছেলের জন্ম সনদ সংগ্রহের জন্য অফিসের বাইরে দাঁড়িয়ে ছিলেন বীথি আক্তার। কিন্তু দ্বিতীয়বারের মতো তাকে খালি হাতে বাড়ি ফিরতে হয়েছে।
হতাশার সুরে তিনি বলেন, 'তারা আমাকে কর্মকর্তা না থাকায় আরেকদিন আসতে বলল। কিন্তু কেউ আমাকে বলতে পারেনি, আমি কবে আসব।"
রেজিস্ট্রার জেনারেলের কার্যালয়, জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন অফিসের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের পাঁচ বছরের কম বয়সী অর্ধেকের বেশি শিশুর জন্ম নিবন্ধন নেই।
এটি একটি জটিল পরিস্থিতি তৈরি করেছে, কারণ সরকার ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে সকল নাগরিকের জন্য ১৮ ধরনের পাবলিক সেবা পাওয়ার শর্ত হিসেবে অনলাইন জন্ম নিবন্ধন বাধ্যতামূলক করেছে। এর মধ্যে রয়েছে– শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি, এসএসসি পরীক্ষার জন্য নিবন্ধন এবং পাসপোর্ট ও ড্রাইভিং লাইসেন্সের জন্য আবেদন।
নিয়ম অনুযায়ী, জন্মের ৪৫ দিনের মধ্যে নিবন্ধন করতে কোনো ফি নেয়া হয় না এবং ৪৫ দিন থেকে পাঁচ বছরের মধ্যে সনদ নেওয়ার জন্য ফি ২৫ টাকা। তবে, যারা নিয়মিত প্রক্রিয়া অনুসরণ করেন এবং দালালদের সাহায্য নেন না, তারা প্রায়ই সময়মতো তাদের সনদ পান না।
গ্রামীণ এলাকাতেও একই রকম সমস্যা দেখা গেছে।
ফরিদপুর উপজেলার হাদল ইউনিয়নের বাসিন্দা নাজিল আহমেদ যুক্তরাজ্যে পড়াশোনা করতে যাওয়ার পরিকল্পনা করেছিলেন। তিনি পাসপোর্টের জন্য আবেদন করার সময় পাসপোর্ট অফিসে গিয়ে তিনি জানতে পারেন, তার বর্তমান জন্ম সনদটি অকার্যকর। তারপর তিনি স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদে গিয়ে ডিজিটাল সনদ পাওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু তারা তাকে জানায়, সার্ভার ডাউন।
তিনি বলেন, 'ইউনিয়ন পরিষদের সচিব মো. শহিদুল ইসলাম আমাকে একটি ফর্ম দিয়ে বলেছিলেন, ফর্মটি পূরণ করে অন্য দিন আসতে। তারপর আমি তিনবার সেখানে গিয়েছি। কিন্তু কিছুই হয়নি।'
জন্ম সনদ পেতে নাজিলকে ৪৭ দিন অপেক্ষা করতে হয়েছে। এই দেরির কারণে তিনি একটি ভর্তির সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। ফলে তার পড়াশোনার পরিকল্পনা আরও ছয় মাস পিছিয়ে যায়।

এ বিষয়ে মো. শহিদুল ইসলাম সমস্যা স্বীকার করলেও তিনি জানান, ইউনিয়ন চেয়ারম্যান সেলিম রেজা ৫ আগস্টের পরে চলে গেছেন। ফলে, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) তার দায়িত্ব নিয়েছেন এবং এখন সমস্ত সরকারি নথিপত্র অনুমোদন দিচ্ছেন।
তিনি বলেন, 'ইউএনও সনদে সই করার জন্য সপ্তাহে একদিন আসেন। এ কারণেই দেরি হচ্ছে।'
এর সাথে প্রযুক্তিগত সমস্যা আরও জটিলতা তৈরি করছে। জন্ম নিবন্ধন সেবার সার্ভারগুলো প্রায়ই প্রযুক্তিগত সমস্যার কারণে বা অতিরিক্ত ট্রাফিকের কারণে ডাউন থাকে।
ধানমন্ডি ২৭-এর বাসিন্দা কাজী আবিদ হাসান জানান, 'এক মাস চেষ্টা করার পরও ওয়েবসাইটে ঢুকতে পারলাম না। তাই এই ঝামেলা এড়াতে আমি একজন দালালকে ২ হাজার টাকা দিয়ে আমার মেয়ের জন্ম সনদ করেছি।'
২০২৪ সালের আগস্ট মাসে জন্ম নিবন্ধন কার্যক্রম সম্পূর্ণ বন্ধ ছিল। এর ফলে এ সংক্রান্ত কার্যক্রম আরও বেশি পিছিয়ে পড়ে। আর সার্ভার সমস্যা পরিস্থিতি আরও জটিল করছে।
অনলাইন আবেদন প্রক্রিয়াতেও বিভিন্ন জটিলতা রয়েছে। ২০০১ সালের পর যারা জন্মগ্রহণ করেছে, তাদের বাবা-মায়ের জন্ম সনদও অনলাইনে নিবন্ধিত থাকতে হবে। তারপর তারা নিজের সন্তানের জন্য আবেদন করতে পারবেন।
সাভার ইউনিয়নের বাসিন্দা আবদুল হাই তার হতাশা ব্যক্ত করে বলেন, 'আমার ছেলের জন্ম এই বছরের ১২ ফেব্রুয়ারি। আমি তার জন্ম সনদ নিবন্ধনের জন্য অনলাইন পোর্টালে ঢুকেছিলাম। কিন্তু জানতে পারলাম, আগে আমার ও আমার স্ত্রীর ডিজিটাল সনদ প্রয়োজন।'
এরপর তিনি নিজের এবং স্ত্রীর জন্ম সনদের জন্য আবেদন করেন। তিনি বলেন, 'যেহেতু ইউনিয়ন চেয়ারম্যান নেই, আমাদের আবেদনগুলো অপেক্ষমাণ। আমি জানি না, কখন আমাদের সনদ পাওয়া যাবে বা কখন আমি আমার ছেলের জন্য আবেদন করতে পারব। প্রক্রিয়াটি হতাশাজনক এবং অনেক দীর্ঘ।'
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের অধ্যাপক ড. সাদিক হাসান ব্যাখ্যা করেছেন, এই সমস্যার মূল কারণ হলো ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ৩০০টির বেশি পৌরসভা এবং ১২টি সিটি করপোরেশনের স্থানীয় সরকার প্রতিনিধিদের চাকুরিচ্যুতি।
তিনি বলেন, 'এতে সিটি করপোরেশন মেয়র, কাউন্সিলর, উপজেলা চেয়ারম্যান, ইউনিয়ন চেয়ারম্যান এবং পৌরসভার মেয়র অন্তর্ভুক্ত। সরকার এই দায়িত্বগুলো পরিচালনার জন্য সিটি করপোরেশন নির্বাহী এবং বিসিএস কর্মকর্তাদের নিয়োগ দিয়েছে। তবে কাজের পরিমাণ অত্যন্ত বেশি। তারা একসাথে সব জায়গায় থাকতে পারেন না।'
তিনি আরও বলেন, 'আওয়ামী লীগের সঙ্গে সম্পর্কিত সকল নির্বাচিত প্রতিনিধিদের চাকুরিচ্যুতির পরিবর্তে বর্তমান সরকার কেবল তাদের পদচ্যুতি করা উচিত, যাদের বিরুদ্ধে মুলতবি অভিযোগ এবং মামলা রয়েছে। এতে পাবলিক সার্ভিসের মান উন্নত হবে এবং দেরি কমবে। সম্ভবত তাদের এটি পুনর্বিবেচনা করা উচিত এবং যাদের পরিষ্কার ব্যাকগ্রাউন্ড রয়েছে, তাদের পুনরায় ফিরিয়ে আনা উচিত।'

ড. সাদিক হাসান আরও পরামর্শ দেন, জন্ম সনদ সরবরাহ ব্যবস্থায় জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) সিস্টেমের মডেল অনুসরণ করা উচিত।
তিনি বলেন, 'জাতীয় পরিচয়পত্র সেবা নাগরিকদের তাদের আবেদন পরিস্থিতি অনলাইনে ট্র্যাক করতে, ডিজিটালি পরিবর্তন করতে এবং সময়মতো আপডেট পেতে সহায়তা করে। অপরদিকে, জন্ম সনদের জন্য আবেদনকারীদের সরকারি অফিসে বারবার যেতে হয়। সরকারের এনআইডি সেবার মতো একটি সিস্টেম চালু করে প্রক্রিয়াটি নিয়ন্ত্রণ করা উচিত।'
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের উপসচিব ড. মোহাম্মদ কামরুল হাসান এর সাথে একমত পোষণ করে বলেন, বর্তমানে স্থানীয় প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের কাজের চাপ অসহনীয়।
তিনি উদাহরণ দিয়ে বলেন, 'একটি উপজেলায় ১০টি ইউনিয়ন থাকতে পারে। প্রতিটি ইউনিয়নের নিজস্ব চেয়ারম্যান রয়েছে। কিন্তু এখন একমাত্র ইউএনও সব কিছুর দায়িত্বে রয়েছেন। এজন্য দেরি হচ্ছে।'
তিনি আরও বলেন, ডিজিটালাইজেশনই সমাধান।
ড. মোহাম্মদ কামরুল হাসান বলেন, 'যদি মানুষ অনলাইনে আবেদন করতে পারে, ডকুমেন্ট আপলোড করতে পারে, এবং সনদ প্রস্তুত হলে একটি নোটিফিকেশন পায় তাহলে অনেক ঝামেলা কমে যাবে। আবেদন প্রক্রিয়ায় মানুষের উপস্থিতিতে শুধু অতিরিক্ত জটিলতা এবং দেরি হয়।'
এদিকে, সরকার এই নিবন্ধন সেবা পরিচালনার জন্য একটি নতুন সিস্টেম প্রস্তাব করেছে। ২০২৫ সালের সিভিল রেজিস্ট্রেশন অর্ডিন্যান্সের খসড়া আইনে জন্ম নিবন্ধন এবং এনআইডি সেবাকে একত্রিত করে একটি 'সিভিল রেজিস্ট্রেশন কমিশন' প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব করা হয়েছে।
তবে, এই প্রস্তাবটি বিতর্ক এবং প্রতিবাদের জন্ম দিয়েছে। নির্বাচন কমিশনের কর্মচারীরা এনআইডি সেবা তাদের অধীনে রাখার দাবিতে অবস্থান কর্মসূচি পালন করেছে।