দুর্ঘটনা, নাকি বিষ প্রয়োগে হত্যা? জুবিনের মৃত্যু ঘিরে রাজনীতিতে উত্তপ্ত আসাম
গত তিন সপ্তাহ আসাম এক আবেগঘন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে গেছে। লাখো মানুষ তাদের 'শতাব্দীর সেরা তারকা'কে বিদায় জানাতে রাস্তায় নেমেছে। প্রিয় শিল্পীর মৃত্যুতে রাজ্যজুড়ে যে শোকের ছায়া নেমে এসেছে, তা এখনও কাটেনি।
তবে জুবিন গার্গের রহস্যজনক মৃত্যু ঘিরে তোলপাড় চলছে তার আসামে। এই মৃত্যুকে নিছক দুর্ঘটনা হিসেবে মানতে নারাজ তার ভক্ত ও অনুরাগীরা। আর একে ঘিরেই জন্ম নিয়েছে তীব্র বিতর্ক ও ষড়যন্ত্রের অভিযোগ।
অন্যদিকে, যে রাজনীতিকে জুবিন নিজেই ঘৃণা করতেন, তার মৃত্যুকে ঘিরে এখন সেই রাজনীতিই চরমে উঠেছে। অভিযোগ ও পাল্টা অভিযোগে পরিস্থিতি যেন আরও জটিল হচ্ছে।
আসামের 'প্রথম রকস্টার' হিসেবে পরিচিত ৫২ বছর বয়সী এই শিল্পী গত ২০ সেপ্টেম্বর সিঙ্গাপুরে একটি কনসার্টে অংশ নিতে গিয়েছিলেন। অনুষ্ঠানের আগের দিন কয়েকজন সঙ্গীর সঙ্গে একটি ইয়টে করে ভ্রমণের সময় এই মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে।
তবে প্রাথমিকভাবে সিঙ্গাপুরের হাসপাতালের ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে জুবিনের মৃত্যুর কারণ হিসেবে 'ডুবে যাওয়া' উল্লেখ করা হলেও তার স্বাস্থ্যের ইতিহাস জেনেও সঙ্গীরা কেন তাকে সমুদ্রে সাঁতার কাটতে দিলেন—এই অবহেলার অভিযোগ থেকে শুরু করে 'বিষ প্রয়োগে হত্যা'র মতো গুরুতর অভিযোগও উঠে।
হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ ওঠার পর তদন্তে নামে পুলিশ, গ্রেপ্তার করা হয়েছে তার পাঁচ সঙ্গীকে।
সিঙ্গাপুর পুলিশ প্রাথমিকভাবে কোনো ষড়যন্ত্রের প্রমাণ পায়নি বলে জানালেও, এই মৃত্যুকে ঘিরে রহস্য ঘনীভূত হতে থাকে। ভক্তদের দাবির মুখে গত ২৩ সেপ্টেম্বর আসামে জুবিনের শেষকৃত্যের আগে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মা স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে দ্বিতীয়বার ময়নাতদন্তের কথা জানান।
এই পরিস্থিতিতে নয়াদিল্লির সেন্ট্রাল ফরেনসিক সায়েন্স ল্যাবরেটরি (সিএফএসএল) থেকে আসা ভিসেরা পরীক্ষার রিপোর্টের দিকেই তাকিয়ে আছে সবাই। বিষ প্রয়োগের অভিযোগের সত্যতা এই রিপোর্টেই জানা যাবে। মুখ্যমন্ত্রী জানিয়েছেন, গেল ১০ অক্টোবর ভিসেরা রিপোর্ট হাতে পাওয়ার পরই প্রকৃত ঘটনা জানা সম্ভব হবে।
তদন্ত ও রাজনৈতিক উত্তাপ
আগামী ২০২৬ সালে আসামে বিধানসভা নির্বাচন। এখন থেকেই জুবিনের মৃত্যুকে একটি রাজনৈতিক ইস্যুতে পরিণত করেছে রাজনৈতিক দলগুলো। রাইজর দলের অখিল গগৈ এবং অসম জাতীয় পরিষদের লুরিনজ্যোতি গগৈ সিবিআই তদন্তের দাবি তুলেছেন।
তাদের অভিযোগ, অনুষ্ঠানের আয়োজক শ্যামকান্ত মোহন্তের সঙ্গে বিজেপি সরকারের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। অন্যদিকে, বিজেপির পাল্টা অভিযোগ, মোহন্ত কংগ্রেসের ঘনিষ্ঠ।
আসাম কংগ্রেসের সভাপতি গৌরব গগৈ অভিযোগ করেছেন, মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মা মোহন্তকে বাঁচানোর চেষ্টা করছেন।
এই পরিস্থিতিতে মুখ্যমন্ত্রী এক ভিডিও বার্তায় জুবিন গার্গের নাম নিয়ে আসামকে 'নেপাল' বানানোর চেষ্টা করা হচ্ছে বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। তিনি বলেন, 'কিছু লোক আসামকে নেপাল বানানোর চেষ্টা করছে। আমরা তাদের ছাড়ব না।' তার এই মন্তব্যের লক্ষ্য ছিল নেপালে সাম্প্রতিক গণ-আন্দোলন, যার জেরে সরকারের পতন ঘটেছিল।
জুবিনের বিশাল ভক্তকুল এবং তার মৃত্যুকে ঘিরে তৈরি হওয়া আবেগ আসন্ন নির্বাচনে বড় প্রভাব ফেলতে পারে, যা সব রাজনৈতিক দলই বুঝতে পারছে।
যেভাবে দানা বাঁধে রহস্য
প্রাথমিকভাবে দুর্ঘটনা মনে করা হলেও পরিস্থিতি দ্রুত পাল্টাতে থাকে। রাজ্য পুলিশ জানায়, এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত ৬০টির বেশি অভিযোগ দায়ের হয়েছে। তদন্তে নেমে পুলিশ জুবিনের ম্যানেজার, প্রোগ্রামের আয়োজক, সংগীত দলের দুই সদস্য এবং তার চাচাতো ভাইসহ মোট পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করেছে।
তাদের বিরুদ্ধে প্রথমে অবহেলা ও অপরাধমূলক ষড়যন্ত্রের অভিযোগ আনা হলেও, পরে বিশেষ তদন্ত দলের (এসআইটি) প্রধান মুন্না প্রসাদ গুপ্তা জানান, তারা এখন এটিকে হত্যাকাণ্ড হিসেবেও তদন্ত করছেন।
একটি পূর্ণাঙ্গ ও নিরপেক্ষ তদন্তের দাবি জোরালো হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এবং তাঁর মৃত্যু নিয়ে নানা প্রশ্ন ঘনীভূত হওয়ায় রাজ্য কর্তৃপক্ষ এই মৃত্যুরহস্য তদন্তে পুলিশের নয় সদস্যের এই বিশেষ তদন্ত দল (এসআইটি) গঠন করেছে। মুখ্যমন্ত্রী শর্মা তদন্ত তদারকির জন্য একজন বিচারকের নেতৃত্বে একটি বিচার বিভাগীয় কমিশনও গঠন করেছেন।
এদিকে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া কিছু ভিডিও জনরোষকে আরও উসকে দিয়েছে। ভিডিওগুলোতে জুবিনকে ক্লান্ত অবস্থায় লাইফ জ্যাকেট ছাড়া সাঁতার কাটতে দেখা যায়, একটি ভিডিওতে তাঁকে সাঁতার কাটতে গিয়ে বেশ ক্লান্ত দেখাচ্ছিল। এরপরও কেন তাঁকে সাঁতার কাটতে দেওয়া হলো, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন ভক্তরা।
রিমান্ডের আবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, 'যখন জুবিন গার্গ শ্বাস নিতে পারছিলেন না, প্রায় ডুবে যাচ্ছিলেন, সেই সংকটজনক মুহূর্তে সিদ্ধার্থ শর্মাকে 'যেতে দে, যেতে দে' বলে চিৎকার করতে শোনা যায়। সাক্ষী (গোস্বামী) জোর দিয়ে বলেছেন, জুবিন গার্গ একজন দক্ষ সাঁতারু ছিলেন... তাই তার পক্ষে ডুবে মারা যাওয়া সম্ভব নয়।'
এই প্রশ্নগুলো আরও জোরালো হয় যখন তার স্ত্রী গরিমা সাইকিয়া গার্গ জানান, জুবিনের স্বাস্থ্যগত সমস্যা ছিল এবং তিনি নিয়মিত ওষুধ খেতেন, যা তার সঙ্গীরা জানতেন।
গরিমা বলেন, 'তার সঙ্গে আসলে কী ঘটেছিল, আমরা জানি না। কীভাবে ঘটল, তা-ও রহস্য। তিনি যে অবহেলার শিকার হয়েছিলেন, তা নিশ্চিত। কিন্তু তার মতো একজন মানুষকে কেন অবহেলা করা হলো? আমরা সব উত্তর চাই। দোষী প্রমাণিত হলে তাদের কঠোরতম শাস্তি দিতে হবে।'
আসামের 'রাজা' হারানোর শোক
জুবিন গার্গের মৃত্যুতে আসামজুড়ে যে শোক, তার কারণ গভীর। ৩৩ বছরের কর্মজীবনে তিনি ছিলেন আসামের এক সাংস্কৃতিক প্রতীক, যিনি ৪০টিরও বেশি ভাষায় গান গেয়েছেন। 'গ্যাংস্টার' চলচ্চিত্রে তার 'ইয়া আলী' গানটি তাকে ভারতজুড়ে খ্যাতি এনে দেয়।
তবে শুধু গায়কই নন, আসামের মানুষের কাছে তিনি ছিলেন এক 'রাজা', যিনি সাধারণ মানুষের মাঝে বাস করতেন।
গুয়াহাটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক অখিল রঞ্জন দত্তের মতে, নব্বইয়ের দশকে সহিংসতা ও অনিশ্চয়তায় নিমজ্জিত আসামে জুবিনের সংগীত এক প্রাণবন্ত ঢেউ তৈরি করেছিল। সেই অন্ধকার সময়ের শূন্যতা তিনি একাই পূরণ করেছিলেন।
তার মরদেহ গুয়াহাটিতে আনা হলে লাখো মানুষ তাঁকে শেষ শ্রদ্ধা জানায়। রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় তার শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তাঁকে 'অসমীয়া সংস্কৃতির উজ্জ্বলতম রত্ন' হিসেবে অভিহিত করেন।
এই মৃত্যুকে ঘিরে আসামের রাজনীতিও উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। জনসমাবেশ, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে শুরু করে রাজ্যের রাজনীতি—সবখানেই ক্ষোভ দৃশ্যমান। আঞ্চলিক গণমাধ্যমে এটিই এখন সবচেয়ে বড় খবর। ভক্তরা অভিযুক্তদের একজনের বাড়িতে চড়াও হওয়ার চেষ্টা করলে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটে।
রাজ্যের প্রধান আইনজীবী সমিতি এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, তারা অভিযুক্তদের পক্ষে আইনি লড়াই চালাবে না। অন্যদিকে, গ্রেপ্তারকৃতদের একজন এই 'উদ্দেশ্যমূলক হয়রানি' থেকে সুরক্ষা চেয়ে সুপ্রিম কোর্টে আবেদন করেছেন।
আগামী বছর বিধানসভা নির্বাচন থাকায় ক্ষমতাসীন বিজেপি ও বিরোধী কংগ্রেস একে অপরকে এ নিয়ে রাজনীতি করার জন্য অভিযুক্ত করছে।
মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মা প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, তিনি বিচার নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হলে জনগণ যেন নির্বাচনে বিজেপিকে ভোট না দিয়ে তাকে শাস্তি দেয়।
তদন্তের অগ্রগতির বিষয়ে মুখ্যমন্ত্রী জানান, সিঙ্গাপুর থেকে জুবিনের ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন পুলিশের হাতে এসেছে এবং ভিসেরা নমুনার টক্সিকোলজি রিপোর্টও শিগগিরই পাওয়া যাবে। তবে তদন্ত পূর্ণ করতে সিঙ্গাপুরে ইয়টে উপস্থিত অন্য ব্যক্তিদের সাক্ষ্য জরুরি বলে তিনি উল্লেখ করেন।
এদিকে, জুবিনের ঘনিষ্ঠজনেরা বলছেন, চলমান এই বিতর্ক তাঁদের শোক পালনের সুযোগটুকুও দিচ্ছে না। পারিবারিক বন্ধু রাহুল গৌতম শর্মা বলেন, 'আমরা শুধু জানতে চাই সেদিন ঠিক কী ঘটেছিল। যখন আমরা সব প্রশ্নের উত্তর পাব, তখনই হয়তো আমাদের আসল শোক শুরু হবে।'
