পর্দায় প্রাণবন্ত, পর্দার আড়ালে নিঃসঙ্গ: প্রেম, অর্থ, উন্মাদনা ও খ্যাতির জগতে কিশোর কুমার

বেঁচে থাকলে আজ হতো ভারতের কিংবদন্তি কণ্ঠশিল্পী, অভিনেতা ও চলচ্চিত্র নির্মাতা কিশোর কুমারের ৯৬তম জন্মবার্ষিকী। গানের জগতে এক অনন্য প্রতিভা, আর সিনেমার পর্দায় এক রহস্যময় ও মায়াবী চরিত্র কিশোর কুমার শুধু একজন শিল্পীই ছিলেন না, ছিলেন এক জটিল অথচ মোহময় মানবসত্তা।
১৯৮৭ সালে হঠাৎ তার প্রয়াণ যেন থেমে যাওয়া এক অসম্পূর্ণ প্রেমগানের শেষ সুর, কিন্তু তার গাওয়া সেই সুর আজও আমাদের মনে বাজে।
কিশোর কুমারের জীবন মানেই ছিল একরকম উন্মাদনা—কখনো উচ্ছ্বাস, কখনো ভাঙন, আবার কখনো নিজেকে নতুন করে গড়ে তোলা। তিনি ছিলেন মঞ্চের সামনে যেমন প্রাণবন্ত, পর্দার পেছনে ততটাই অন্তর্মুখী ও আবেগপ্রবণ। কৌতুকপ্রবণতার আড়ালে লুকানো ছিল মানসিক ক্ষত, আত্মসংঘাত এবং নিঃসঙ্গতার দীর্ঘ ছায়া।
চারবার বিয়ে করেছিলেন কিশোর কুমার—প্রতিটি সম্পর্ক ছিল আলাদা এক গল্প। প্রথমটি ছিল প্রেমের টানে, দ্বিতীয়টি দায়িত্ববোধ থেকে, তৃতীয়টিকে তিনি নিজেই বলতেন 'রসিকতা', আর চতুর্থটি সম্ভবত একাকিত্ব ঘোচানোর প্রয়াস।
অসাধারণ প্রতিভার পাশাপাশি কিশোর কুমার ছিলেন চরম খামখেয়ালি। তার আচরণ ছিল একেবারেই অপ্রত্যাশিত—যেমন গান গাওয়ার সময়, তেমনই ব্যক্তিগত জীবনে। পরিচালক এইচএস রাওয়েল তাকে নিয়ে একবার বলেছিলেন 'চূড়ান্ত কেয়ারলেস'। এর প্রমাণ তার প্রথম স্ত্রী রূমা ঘোষকে হঠাৎ করে বিয়ে করে ফেলা। মাদ্রাজ থেকে ফিরে বোম্বেতে নামার পর পরিবারের কাছে না গিয়ে হঠাৎ গাড়ি ঘুরিয়ে তিনি চলে যান রূমার কাছে, এবং সেদিনই বিয়ে করে ফেলেন, কারোর অনুমতি ছাড়াই।

আবার আরেকদিন ভুল করে গাড়ির বিজ্ঞাপন দেখে দাম ১,০০০ টাকা ভেবে শোরুমে গিয়ে বুঝতে পারেন, আসলে ১,০০০ টাকা ছাড় ছিল। তবু লজ্জায় পিছিয়ে না গিয়ে ৪,০০০ টাকা আগাম দিয়ে গাড়িটি বুক করেন। সবুজ রঙের সেই মরিস মাইনর গাড়িটিকে তিনি 'লাকি চার্ম' মনে করতেন।
কিন্তু ১৯৫৮ সালে রূমার সঙ্গে বিচ্ছেদের পর কিশোর আর গাড়িটিকেও রাখতে চাননি। আবেগময় স্মৃতি এড়াতে গাড়িটি নিজের বাড়ি 'গৌরীকুঞ্জ'-এর উঠানে মাটিচাপা দেন। পরবর্তীতে তিনি বলেন, 'আমি চেয়েছিলাম সে আমার জন্য একটা ঘর সাজাক, আর সে চেয়েছিল নিজের ক্যারিয়ার গড়তে।'
১৯৫৬ সালে 'ঢাকে কি মালমল' ছবির সেটে কিশোর কুমার ও মধুবালার প্রথম দেখা। দিলীপ কুমারের সঙ্গে বিচ্ছেদের পর, ১৯৬০ সালে অসুস্থ অবস্থায় হঠাৎ কিশোরকে বিয়ে করেন মধুবালা। কেউ কেউ মনে করেন, এই সিদ্ধান্তে আবেগের চেয়ে বেশি ছিল দিলীপের প্রতি জেদ ও ক্ষোভ।
বিয়ের পর কিশোর মধুবালাকে নিয়ে যান লন্ডনে চিকিৎসার জন্য। চিকিৎসকেরা জানান, তার হৃদরোগ সারানো সম্ভব নয়, আয়ু আছে মাত্র দুই বছর। এই খবরে মধুবালা মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন। ভারতে ফিরে কিশোর তাকে আলাদা বাড়িতে রাখেন, যদিও নিজের উপস্থিতি সীমিত করেন। এ নিয়ে বহুদিন কিশোরের অবহেলার অভিযোগ থাকলেও পরে শোনা যায়, স্ত্রীর কথা ভেবেই এমন ব্যবস্থা করেছিলেন তিনি।
কিশোর এক সাক্ষাৎকারে বলেন 'বিয়ের আগেই আমি জানতাম মধুবালা খুব অসুস্থ। সে জন্মগত হৃদরোগে ধীরে ধীরে মারা যাচ্ছে। কিন্তু প্রতিশ্রুতি তো প্রতিশ্রুতি। তবে ফিল্মফেয়ার কে দেওয়া আরেক সাক্ষাৎকারে কিশোর বলেছিলেন, তিনি কখনো মধুবালার প্রেমে পড়েননি। এই দ্বৈত বয়ানই তাদের সম্পর্কের জটিলতাকে তুলে ধরে।
মধুবালার শেষ মুহূর্তে কিশোরই ছিলেন তার পাশে, মৃত্যুর পর তিনিই শেষকৃত্যও সম্পন্ন করেন।
১৯৭৬ সালে কিশোর কুমার তৃতীয়বারের মতো বিয়ে করেন অভিনেত্রী যোগিতা বালিকে, যিনি তখন ২৪, আর কিশোর ৪৬। বয়স ও মানসিক দূরত্ব শুরু থেকেই তাদের সম্পর্কে সমস্যা তৈরি করে। কিশোর একে 'রসিকতা' বলে অভিহিত করেন; যোগিতা বলেন, তিনি কখনো কিশোরকে ভালোবাসেননি।
মাত্র দুই বছরেই এই বিয়ে ভেঙে যায়। বিচ্ছেদের পেছনে বড় কারণ ছিল অভিনেতা মিথুন চক্রবর্তীর সঙ্গে যোগিতার ঘনিষ্ঠতা। পরের বছরই তিনি মিথুনকে বিয়ে করেন, কিশোর এতে গভীরভাবে আঘাত পান এবং মিথুনের সিনেমায় গান গাওয়া বন্ধ করে দেন।
তবু কাকতালীয়ভাবে, কিশোরের জীবনের শেষ রেকর্ডকৃত গান ছিল মিথুনেরই ছবি ওয়াক্ত কি আওয়াজ (১৯৮৮)-এর জন্য। 'গুরু গুরু' গানটি তিনি রেকর্ড করেন ১৩ অক্টোবর ১৯৮৭—সেদিনই তিনি মারা যান।

১৯৭৬ সালে স্বামী সিদ্ধার্থ বান্দোদকারের মৃত্যুতে গভীর শোকের মধ্যে ছিলেন অভিনেত্রী লীনা চাঁদবরকার। সে সময় নিয়মিত ফোন করে তাকে সান্ত্বনা দিতেন কিশোর কুমার। পরে ১৯৮০ সালে দুজনের বিয়ে হয়—তখন লীনার বয়স ৩০, কিশোরের ৫১।
বিয়ের পর লীনা অভিনয় জগত থেকে সরে এসে পুরোপুরি সংসার ও পরিবারের প্রতি মনোযোগী হয়ে ওঠেন। বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে লীনা কিশোরকে বর্ণনা করেছেন এক ভালোবাসাপূর্ণ, হাস্যরসাত্মক স্বামী হিসেবে, যিনি তার বিচিত্র স্বভাবের মাঝেও তার মনোবল ধরে রাখতেন।
১৯৮৭ সালে ৫৮ বছর বয়সে কিশোর কুমার হৃদযন্ত্রের আকস্মিক রোগে প্রয়াত হন। কিশোরের মৃত্যুর পর তিনি তাদের সন্তান সুমিতকে বড় করার পাশাপাশি কিশোরের অসম্পূর্ণ কাজগুলো দেখাশোনা করেন। আগের তিনটি বিয়ের তুলনায় লীনার সঙ্গে কিশোরের সম্পর্ক ছিল অনেক শান্তিপূর্ণ, যদিও দুঃখজনকভাবে তা খুব বেশি দিন স্থায়ী হয়নি।
কিশোর কুমারের ভেতরের যন্ত্রণা যেন প্রতিধ্বনিত হতে পারত 'আনন্দ' সিনেমার চরিত্রে—যেটির প্রস্তাব পেয়েও নিজের খামখেয়ালির কারণে হাতছাড়া করেন তিনি।
আসলে আনন্দ চরিত্রের মতোই, কিশোর ছিলেন এক বিষণ্ন মানুষ, যিনি রঙ্গ-তামাশা আর অদ্ভুত আচরণের আড়ালে লুকিয়ে রাখতেন একাকীত্ব।
একবার শুটিং চলাকালে হঠাৎ অভিনেত্রী তনুজাকে বলেন, 'তনু, আজ আমি খুব কষ্টে আছি, আমার এই দুঃখটা তোমার সঙ্গে ভাগ করে নিতে চাই।' এরপর গেয়ে ওঠেন একের পর এক হৃদয়বিদারক গান। তনুজা বলেন, তিনি এতটাই আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েছিলেন যে কিছু বলার মতো অবস্থায় ছিলেন না।

বেশিরভাগ মানুষই চিনতেন কিশোরকে একজন খামখেয়ালি মানুষ হিসেবে—যিনি কখনো নিজের 'কাল্পনিক' বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলতেন, কখনো গাছে জড়িয়ে ধরে গল্প করতেন, কুকুরদের রাগ শেখাতেন, ভৌতিক সিনেমায় ভয় পেতেন বা খেলনা দিয়ে সময় কাটাতেন।
চলচ্চিত্রের চাকচিক্য তার ভালো লাগত না। একবার বলেছিলেন, 'আমার তো একটা বন্ধুও নেই।'
মুম্বাইতে আসার সময় তার কোনো সুস্পষ্ট লক্ষ্য ছিল না, শুধু নিজের গলার ওপর বিশ্বাস ছিল। কিন্তু বড় ভাই অশোক কুমার, তখনকার সুপারস্টার, বলেছিলেন—গান গেয়ে কিছু হবে না, অভিনয় শেখো।
তার কথাতেই প্রথম ক্যামেরার সামনে দাঁড়ান কিশোর—দেব আনন্দের ছবি 'জিদ্দি'-তে, এক মালী চরিত্রে। যেখানে চুপচাপ থাকার কথা থাকলেও কিশোর মুখে চুপিসারে গালি দেন! বকুনি খেয়ে সরে যান অভিনয় থেকে। তবে এই ছবিতেই প্রথম গান গেয়েছিলেন—'মরনে কি দুআয়েঁ', যার মধ্য দিয়েই শুরু হয় তার প্লেব্যাক যাত্রা। এরপর থেকে তিনিই হয়ে ওঠেন দেব আনন্দের কণ্ঠস্বর।
গায়িকা আশা ভোঁসলে বলেছিলেন, কিশোর কুমার প্রায়ই স্টুডিওতে আসতেন এক কাল্পনিক শিশুর সঙ্গী নিয়ে, যার সঙ্গে ঘণ্টার পর ঘণ্টা গল্প করতেন, খেলতেনও শিশুসুলভ উচ্ছ্বাসে।
সলিল চৌধুরীর মতে, 'মুড' না এলে কিশোর গান গাইতেন না; একবার তো স্টুডিওর বাগানে প্রজাপতি ধরতে গিয়ে পুরো রেকর্ডিং থামিয়ে দেন।
চলচ্চিত্রজগতে কিশোর কুমারের টাকার প্রতি টান ছিল বহুলচর্চিত। আগাম পারিশ্রমিক ছাড়া তিনি গান গাইতেন না—প্রযোজকদের অনেক সময় দরজায় টাকার পুটলি নিয়ে হাজির হতে হতো।
একবার এক প্রযোজক তার বাড়িতে গিয়ে দেখেন, কিশোর বাগানে বসে আছেন এবং টাকা না পাওয়া পর্যন্ত ঘরে ঢুকবেন না। চেক দেওয়া হলে তিনি সোজা বলে দেন, 'চেক বাউন্স করে, কিন্তু আমার কণ্ঠস্বর করে না!' শেষে নগদ টাকা নিয়ে এলে শুরু হয় রেকর্ডিং।
অন্য এক ছবির জন্য পারিশ্রমিক না পেয়ে তিনি নিজেই প্রযোজকের অফিসের সামনে গাড়ি দাঁড় করিয়ে 'পয়সা দাও, গান নাও' বলে হর্ন বাজাতে থাকেন। কিছুক্ষণ পর গাড়ি নিয়ে চলে যান, রেখে যান এক শিক্ষা—কিশোর কুমারের সঙ্গে পেমেন্ট নিয়ে খেলতে নেই!
তবে এতে শুধু অর্থলিপ্সা নয়, শিল্পজগতের বকেয়ার সংস্কৃতির প্রতি তার অনাস্থাও কাজ করত। পারিশ্রমিক না পেলে মাঝেমধ্যেই প্রতিবাদে একপাশের গোঁফ বা চুল কেটে ফেলতেন—যেমনটা করেছিলেন 'ভাই ভাই' ছবির শুটিংয়ে।
অভিনেতা-গায়ক হিসেবে সর্বোচ্চ পারিশ্রমিক পাওয়া সত্ত্বেও কিশোর কুমার সবসময় সব হারানোর আশঙ্কায় ভুগতেন। লোভ নয়, বরং নিয়ন্ত্রণ আর নিরাপত্তার বোধ থেকে তিনি নিজের আয়ের হিসাব রাখতেন খুব সচেতনভাবে।
আবার যতটা কঠোর ছিলেন নিজের পারিশ্রমিক নিয়ে, ততটাই উদার ছিলেন অন্য শিল্পীদের প্রতি। তিনি প্রায়ই সংগ্রামী শিল্পীদের সাহায্য করতেন, গোপনে তাদের প্রকল্পে অর্থ দিতেন বা নিজের সিনেমায় কাজের সুযোগ দিতেন।
নিজের জনপ্রিয়তা নিয়ে কিশোরের মনোভাব ছিল বেশ ভিন্ন। বলতেন, 'লোকেরা আমার কণ্ঠস্বরকে ভালোবাসে, আমাকে নয়।'
জীবনের শেষদিকে আরও নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েন। সন্ধ্যায় সমুদ্রতটে একা হাঁটতেন, কখনো গুনগুন করতেন, কখনো ঢেউয়ের সঙ্গে কথা বলতেন। কেউ ভাবতেন তিনি রিহার্সাল করছেন, আবার কেউ বলতেন প্রকৃতির মধ্যেই তিনি খুঁজে নিতেন শান্তি।