‘মোগল-ই-আজম’ খ্যাত মুরাদ: ৫০০ ছবির অভিনেতা, তবু বৃদ্ধজীবন কেটেছে বিদ্যুৎহীন ঘরে

বলিউডের স্বর্ণযুগ ১৯৫০ থেকে ৬০-এর দশকে অগণিত দর্শকের হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছিলেন অনেক অভিনেতা। তবে ক্যামেরার ঝলকে ঢেকে গেছে তাদের জীবনের অনেক কষ্টগাথা। এমনই এক অভিনেতা ছিলেন মুরাদ, যিনি অভিনয় করেছেন মোগল-ই-আজম, দো বিঘা জমিন, আন্দাজ–এর মতো কালজয়ী সিনেমায়। এমনকি কাজ করেছেন হলিউডের টারজান গোজ ইন্ডিয়া-তেও।
তবু শেষ জীবনে তিনি ছিলেন অর্থকষ্টে। ছিল না নিজের গাড়ি, এমনকি ভোপালের বাড়িতে বিদ্যুতের সংযোগও ছিল না।
সম্প্রতি একটি সাক্ষাৎকারে অভিনেতা রেজা মুরাদ তার বাবা প্রখ্যাত অভিনেতা মুরাদের কথা তুলে ধরে এই বাস্তবতাই মনে করিয়ে দিলেন।
তার বাবা ছিলেন একজন কিংবদন্তি, যার ক্যারিয়ার শুরু হয়েছিল ভারতের স্বাধীনতার আগেই। পুরো কর্মজীবনে অভিনয় করেছেন ৫০০-র বেশি ছবিতে।
তবে এই দীর্ঘ ক্যারিয়ারের ফলশ্রুতিতে যে আরামদায়ক জীবন মিলেছিল, তা কিন্তু নয়।
অভিনেতা মুরাদের ছেলে রেজা বলেন, "আমি ছোট বেলা থেকে জীবনে অনেক কষ্ট দেখেছি। দারিদ্র্য অনুভব করেছি। আমাদের ভোপালের বাড়িতে বিদ্যুৎ ছিল না। পরীক্ষার সময় পড়াশোনা করতাম রাস্তায় ল্যাম্পপোস্টের নিচে। রাত ১২টা থেকে সকাল ৬টা পর্যন্ত পড়তাম।"
আলোচনার এক পর্যায়ে যখন উপস্থাপক বলেন যে অনেক জনপ্রিয় পুরনো দিনের অভিনেতাই শেষ বয়সে আর্থিক সংকটে ভুগেছেন, তখন রেজা মুরাদ এর কারণ হিসেবে তুলে ধরেন দায়িত্বহীনতা ও পরিকল্পনার অভাবকে।
তিনি বলেন,"আপনি যখন টাকা উপার্জন করেন, তখনই আপনাকে আপনার বার্ধক্যের কথা ভাবতে হবে। আমাদের ইন্ডাস্ট্রির অনেক টেকনিশিয়ান পর্যন্ত নিজেদের ঘর বানিয়েছেন, সঞ্চয় করেছেন। তারা জানেন, আয় যেকোনো দিন বন্ধ হয়ে যেতে পারে, বা শরীর খারাপ হতে পারে। তখন আপনি কী করবেন? কার সামনে হাত পাতবেন?"
তিনি আরও বলেন, "আমি কারও নাম নিতে চাই না, কিন্তু এমন অনেক অভিনেতা ছিলেন, যারা তাদের সময়ে খুব ব্যস্ত ছিলেন, অনেক অর্থ ও খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। কিন্তু সবটাই খরচ করে ফেলেছিলেন। যখন বুড়ো হয়ে পড়লেন, তখন তাদের দেখা গেছে ভাড়া বাড়িতে থাকতে, যারা এক সময় বিশাল বাংলোতে থাকতেন। আমি নিজ চোখে দেখেছি, তারা এখন অটোরিকশায় ঘুরে বেড়াচ্ছেন।"
এর পাশাপাশি রেজা মুরাদ জানিয়েছেন, তার বাবার জীবনে কীভাবে এক রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব তাদের জীবনধারায় আমূল পরিবর্তন এনেছিল।
"আমার বাবা রামপুরে থাকতেন। নবাব রেজা আলি খানের সঙ্গে একটা ঝামেলা হওয়ায় তাকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে শহর ছাড়তে বলা হয়। তখনই তিনি মুম্বাই চলে আসেন। তিনি মূলত লেখক হতে চেয়েছিলেন। কিন্তু পরিচালক মেহবুব খান তাকে একটি ছবিতে অভিনেতা হিসেবে কাস্ট করেন। সেখান থেকেই শুরু তার অভিনয়জীবন।"

মুরাদের অভিনয়জীবনও ছিল ব্যতিক্রমধর্মী। তিনি অভিনয় করেছেন প্রায় ৫০০ ছবিতে, এর মধ্যে ৩০০ ছবিতে তিনি ছিলেন বিচারকের ভূমিকায়। এই দিক থেকে সম্ভবত তিনি গড়ে তুলেছিলেন এক অনন্য রেকর্ড।
"তিনি রামপুরকে আন্তর্জাতিকভাবে পরিচিত করে তুলেছিলেন। সবাই তাকে বলত 'মুরাদ রামপুরি' নামে," বলেন রেজা।
নিজের অভিনয়জীবনের শুরুটা কেমন ছিল, তাও তুলে ধরেন রেজা। বলেন, "আমার বাবা তখন বয়সে অনেকটাই প্রবীন। আমি বুঝেছিলাম, পরিবার চালানোর দায়িত্ব এখন আমার। ১৯৬৮ সালে তিনি বলেছিলেন, আমি যেন উচ্চশিক্ষা শেষ করে এফটিআইআই-তে ভর্তি হই। পড়ার মাঝেই সিদ্ধান্ত নিই—অভিনয়কে পাঁচ বছর সময় দেব। যদি কাজ না হয়, তবে অন্য কিছু করব।"
আজ রেজা মুরাদ নিজেও হয়ে উঠেছেন বলিউডের একজন বড় অভিনেতা। শ'খানেক ছবিতে দিয়েছেন উল্লেখযোগ্য পারফরম্যান্স। তবে বাবার জীবন থেকে তিনি যে শিক্ষা সবচেয়ে বেশি নিয়েছেন, তা হলো পরিকল্পনা ও পরিমিত জীবনের গুরুত্ব।
মুরাদ মারা যান ১৯৯৭ সালে। তার জীবন যেন সিনেমার বাইরের এক নিঃশব্দ অধ্যায়,আলোয় মোড়া পর্দার আড়ালে এক সংগ্রামী শিল্পীর দীর্ঘ পথচলা।
অনুবাদ : নাফিসা ইসলাম মেঘা