নির্বাচনি ব্যয়ের ২৫ লাখ টাকার সীমা উঠল, কঠোর নজরদারির তাগিদ বিশেষজ্ঞদের
আসন্ন জাতীয় নির্বাচনে প্রার্থীদের নির্বাচনি প্রচারণার ব্যয় নির্ধারণে একটি নতুন কাঠামো করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। গত নির্বাচনে যেখানে সর্বোচ্চ ২৫ লাখ টাকা ব্যয়ের সুযোগ ছিল, সেখানে এখন কিছু কিছু আসনে প্রার্থীরা সর্বোচ্চ ৭০ লাখ টাকাও ব্যয় করতে পারবেন।
গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের (আরপিও) নতুন কাঠামো অনুযায়ী, একজন প্রার্থীর নির্বাচনি ব্যয়—যার মধ্যে তাকে মনোনীত করা রাজনৈতিক দলের খরচও অন্তর্ভুক্ত থাকবে—ভোটারপ্রতি ১০ টাকা বা প্রতি আসনে ২৫ লাখ টাকার মধ্যে যেটি বেশি হবে, তা অতিক্রম করতে পারবে না।
তবে নির্বাচন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই নিয়ম ধনী প্রার্থীদের বাড়তি সুবিধা দেবে। আর ব্যয়ের সীমা নির্ধারণ করে দেওয়া হলেও তা কার্যকরভাবে মনিটরিং করা না গেলে পুরো উদ্যোগই অর্থহীন হয়ে পড়বে।
তাই প্রার্থীদের নির্বাচনি ব্যয় মনিটরিংয়ে ইসিকে জোর দিতে বলেছেন তারা।
সর্বোচ্চ ব্যয়সীমা কীভাবে নির্ধারিত হয়
প্রতি আসনে ২৫ লাখ টাকা অথবা ভোটারপ্রতি ১০ টাকা—এর মধ্যে যেটি বেশি হয়, সেই পরিমাণ অর্থ একজন প্রার্থী ব্যয় করতে পারবেন। অর্থাৎ ২.৫ লাখ বা তার চেয়ে কম ভোটারের আসনে প্রার্থীর ব্যয়সীমা ২৫ লাখ টাকা।
আর আড়াই লাখের বেশি ভোটারের আসনে প্রার্থীদের ভোটারসংখ্যার অনুপাতে ব্যয়সীমা নির্ধারিত হবে। কোনো আসনে যদি ৩ লাখ ভোটার থাকেন, তবে ভোটারপ্রতি ১০ টাকা হিসেবে ব্যয়সীমা বেড়ে দাঁড়াবে ৩০ লাখ টাকা। যেমন, ঢাকা-১৯ আসনে ভোটার সংখ্যা প্রায় সাড়ে ৭ লাখ। ফলে এ আসনে একজন প্রার্থী প্রায় ৭৫ লাখ টাকা পর্যন্ত খরচ করতে পারবেন।
নজরদারি নিয়ে উদ্বেগ
নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান ও সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার টিবিএসকে বলেন, নির্বাচনি ব্যয়ের অনিয়ম প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করতে একাধিক আসনের জন্য নির্বাচনি ব্যয় মনিটরিং কমিটি গঠন ও ব্যয় নজরদারির বিষয়ে কোনো উদ্যোগ নেয়নি ইসি। তিনি জোর দিয়ে বলেন, ঘোষিত ব্যয় যাচাই-বাছাই করার ব্যবস্থা না থাকলে শুধু সীমা নির্ধারণ করা অর্থহীন।
তিনি আরও বলেন, 'প্রার্থীরা প্রায়ই তাদের ব্যয়ের হিসাব যথাযথভাবে দেন না। প্রার্থীরা যে ব্যয় করছেন, তার ওপর কোনো নিয়ন্ত্রণ বা স্ক্রুটিনাইজেশন নেই ইসির। যদি যথাযথ নজরদারি এবং নির্বাচন পরবর্তী অডিট বা নিরীক্ষা থাকত, তবে এই ব্যয় অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে থাকত।'
তিনি বলেন, এই যাচাই ব্যবস্থা না থাকায় নির্বাচনি ব্যয় অতীতের নির্বাচনগুলোর মতোই অবাধে চলতে থাকে।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর একটি গবেষণা প্রকাশ করে। এতে বলা হয়, নির্বাচনে প্রার্থীরা গড়ে ১ কোটি ৫৬ লাখ ৮৩ হাজার ৭৭৭ টাকা খরচ করেছেন, যা অফিশিয়াল ব্যয়সীমার ছয়গুণ। সবচেয়ে বেশি ব্যয় করেছেন আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা, গড় সীমার ১১.৪৫ গুণ বেশি। নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগেই আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা গড়ে ১ কোটি ৬৭ লাখ ৮০ হাজার ১০২ টাকা ব্যয় করেছিলেন।
টিআইবির গবেষণায় আরও দেখা গেছে, ২০১৮ সালের একাদশ সংসদ নির্বাচনে প্রার্থীরা গড়ে ৭৯ লাখ ৭২ হাজার ৮৭৬ টাকা ব্যয় করেছিলেন।
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, 'ব্যয়ের ঊর্ধ্বসীমা কার্যত উন্মুক্ত করে দেওয়ার পেছনে যুক্তি হলো, দেশের বিভিন্ন আসনে ভোটার সংখ্যার তারতম্য বিবেচনায় এক ধরনের সমতা বা ন্যায্যতা নিশ্চিত করা।'
তবে তিনি সতর্ক করে বলেন, 'নির্বাচনি ব্যয়সীমা নির্ধারণের বিষয়টি যতটা জটিল, এতে ধনী বা প্রভাবশালী প্রার্থীদের জন্য একটি সহজাত সুবিধাও রয়েছে। যারা স্বচ্ছ বা অস্বচ্ছ—যেকোনো উপায়ে বেশি সম্পদ ব্যবহারের সক্ষমতা রাখেন, তারা এর মাধ্যমে লাভবান হতে পারেন।'
