কখনোই বন্ধ করা যাবে না ইন্টারনেট, ফিরল বিটিআরসির স্বায়ত্তশাসন; টেলিযোগাযোগ অধ্যাদেশ সংশোধন
ইন্টারনেট ও টেলিযোগাযোগ সেবা কখনোই বন্ধ করা যাবে না—এমন বিধান রেখে গতকাল (২৪ ডিসেম্বর) বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ (সংশোধন) অধ্যাদেশ ২০২৫-এর খসড়া অনুমোদন করেছে উপদেষ্টা পরিষদ। পাশাপাশি নাগরিকদের গোপনীয়তা সুরক্ষা জোরদার এবং বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) নিয়ন্ত্রক স্বাধীনতা ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে।
সংশোধিত আইনের আওতায়, এখন থেকে কোনো পরিস্থিতিতেই আর ইন্টারনেট ও টেলিযোগাযোগ সেবা বন্ধ রাখা যাবে না। আইনের ৯৭ ধারায় এই বিধানটি যুক্ত করার ফলে ভবিষ্যতে প্রশাসনিক আদেশে দেশজুড়ে বা স্থানীয় পর্যায়ে ইন্টারনেট শাটডাউনের সুযোগ কার্যত বন্ধ হয়ে গেল।
সরকার জানিয়েছে, এসব সংস্কারের লক্ষ্য হলো টেলিযোগাযোগ সেবার 'মানবাধিকার মানদণ্ড' উন্নত করা, নিয়ন্ত্রক কাঠামো সংস্কার এবং রাষ্ট্রীয় নজরদারির ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা। জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক টেলিযোগাযোগ ইউনিয়নের (আইটিইউ) নির্ধারিত আন্তর্জাতিক সর্বোত্তম চর্চার সঙ্গে বাংলাদেশের টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থাকে সামঞ্জস্যপূর্ণ করতেই এই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
এনটিএমসি বিলুপ্ত, নজরদারিতে জবাবদিহিমূলক নতুন কাঠামো
এই অধ্যাদেশের মাধ্যমে ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টার (এনটিএমসি) বিলুপ্ত করা হয়েছে। এর পরিবর্তে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে সেন্টার ফর ইনফরমেশন সাপোর্ট (সিআইএস) নামে একটি নতুন সংস্থা গঠন করা হয়েছে।
সিআইএস নিজে সরাসরি কোনো নজরদারি করবে না। এর পরিবর্তে সংস্থাটি কেবল অনুমোদিত সংস্থাগুলোকে কারিগরি সহায়তা দেবে এবং তাদের তথ্য ব্যবহারের সুযোগ হবে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত। এখন থেকে আইনানুগভাবে আড়িপাতার জন্য নবগঠিত একটি আধা-বিচারিক কাউন্সিলের অনুমোদনের প্রয়োজন হবে এবং এর ওপর বাধ্যতামূলক সংসদীয় নজরদারি থাকবে।
আইনে আড়িপাতার পরিধি ও শর্তসমূহ স্পষ্টভাবে নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। জাতীয় নিরাপত্তা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষা, জীবন রক্ষাকারী জরুরি কার্যক্রম, বিচারিক বা তদন্তের উদ্দেশ্য এবং আন্তঃসীমান্ত বিষয়গুলোর মধ্যেই এটি সীমাবদ্ধ থাকবে। এসব ক্ষেত্রে যথাযথ আইনি প্রক্রিয়া কঠোরভাবে অনুসরণ করতে হবে।
আধা-বিচারিক কাউন্সিল ও সংসদীয় প্রতিবেদন
জবাবদিহি নিশ্চিত করতে আইনানুগ আড়িপাতা কার্যক্রম তদারকির জন্য একটি আধা-বিচারিক কাউন্সিল গঠন করা হয়েছে। অবৈধভাবে আড়িপাতার বিরুদ্ধে এই কাউন্সিলে অভিযোগ দায়ের করা যাবে। আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী এই কাউন্সিলের সভাপতিত্ব করবেন। সদস্য হিসেবে থাকবেন প্রধানমন্ত্রীর প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার ও স্বরাষ্ট্র সচিব।
এছাড়া ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি আইনানুগ আড়িপাতার বিষয়ে প্রতি বছর একটি জাতীয় প্রতিবেদন প্রকাশ করবে। এই প্রতিবেদনে নজরদারির ব্যাপ্তি, বাজেট ও প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতার তথ্য অন্তর্ভুক্ত থাকবে। এছাড়া ছবি ও কণ্ঠস্বর সুরক্ষা এবং সিম ও ডিভাইসের তথ্যের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার বিধানও রাখা হয়েছে।
গোপনীয়তা রক্ষা ও বাকস্বাধীনতা-সংক্রান্ত সংস্কার
সংশোধিত অধ্যাদেশে নাগরিকদের ব্যক্তিগত গোপনীয়তা রক্ষার ওপর সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। কোনো ব্যক্তির সিম বা ডিভাইসের তথ্য অপব্যবহার করে তাকে হয়রানি বা নজরদারি করা এখন থেকে আইনের ৭১ ধারার আওতায় দণ্ডনীয় অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে।
বহুল আলোচিত 'বাকস্বাধীনতা-সংক্রান্ত অপরাধ'-এর বিধানগুলোও সংশোধন করা হয়েছে। সাইবার নিরাপত্তা অধ্যাদেশ ২০২৫-এর সঙ্গে সংগতি রেখে এখন শুধু সহিংসতায় সরাসরি উসকানি দেওয়াকে ফৌজদারি অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হবে।
বিটিআরসির স্বাধীনতা পুনর্বহাল
২০১০ সালের বিতর্কিত সংশোধনী কাঠামো থেকে সরে এসে নতুন অধ্যাদেশে বিটিআরসির স্বায়ত্তশাসন ও জবাবদিহি ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে। এর মাধ্যমে মন্ত্রণালয় ও নিয়ন্ত্রক সংস্থার ক্ষমতার মধ্যে স্পষ্ট ভারসাম্য প্রতিষ্ঠিত হবে।
স্বতন্ত্র সমীক্ষার ভিত্তিতে জাতীয়ভাবে গুরুত্বপূর্ণ কিছু লাইসেন্স মন্ত্রণালয় অনুমোদন করবে, তবে অন্যান্য সব লাইসেন্স প্রদানের ক্ষমতা বিটিআরসিকে ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে। এছাড়া নিয়ন্ত্রক সংস্থার কার্যক্রম তদারকির জন্য সংশ্লিষ্ট সংসদীয় স্থায়ী কমিটির প্রধানের নেতৃত্বে একটি নতুন জবাবদিহি কমিটি গঠনের বিধান রাখা হয়েছে।
বিনিয়োগবান্ধব সংস্কার
এই অধ্যাদেশে লাইসেন্স প্রক্রিয়াকরণের সময়সীমা কমানো হয়েছে। আগের আইনে বিদ্যমান চড়া ও বারবার জরিমানার বিধান শিথিল করা হয়েছে। সরকার মনে করছে, এই পদক্ষেপগুলো টেলিযোগাযোগ খাতে বিনিয়োগ বাড়াতে সহায়তা করবে।
এছাড়া আইনের ৮২(ক) ধারার অধীনে আপিল ও সালিশের ব্যবস্থা চালু করা হয়েছে। এর মাধ্যমে গ্রাহক ও অপারেটর উভয়ই যেকোনো বিরোধের ক্ষেত্রে আইনি প্রতিকার চাওয়ার সুযোগ পাবেন।
