লক্ষ্য মহাকাশ অর্থনীতি: রকেট, স্যাটেলাইট ও স্পেস ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক গড়ার পরিকল্পনা বাংলাদেশের
বৈশ্বিক মহাকাশ অর্থনীতিতে প্রবেশের পথে এক ধাপ এগিয়ে যাওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ। দেশে প্রথমবারের মতো রকেট ও স্যাটেলাইট উৎপাদন, রকেট উৎক্ষেপণ কেন্দ্র এবং স্পেস ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ মহাকাশ গবেষণা ও দূর অনুধাবন সংস্থা (স্পারসো)। এ লক্ষ্যে ইতিমধ্যে সম্ভাব্যতা সমীক্ষা প্রকল্পও হাতে নেওয়া হয়েছে।
স্পারসো সূত্রে জানা গেছে, এই সমীক্ষা পরিচালনার জন্য গত মাসে ডেভেলপমেন্ট ডিজাইন কনসালট্যান্টস লিমিটেড-এর সঙ্গে চুক্তি সই হয়েছে। এ সমীক্ষা বাবদ ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ১.৩৫ কোটি টাকা।
স্পারসোর কর্মকর্তারা জানান, পরামর্শক প্রতিষ্ঠানটি ২০২৬ সালের জুনের মধ্যে প্রকল্পের প্রাথমিক নকশাসহ পূর্ণাঙ্গ সম্ভাব্যতা প্রতিবেদন জমা দেবে। এ সমীক্ষায় মূলত তিনটি প্রধান বিষয়ের ওপর আলোকপাত করা হবে—রকেট উৎপাদন ও উৎক্ষেপণ কেন্দ্র; স্যাটেলাইট উৎপাদন শিল্প ও অ্যাসেম্বলি, ইন্টিগ্রেশন অ্যান্ড টেস্ট (এআইটি) ল্যাবরেটরি; আর স্পেস ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক।
কর্মকর্তারা বলেন, এসব উদ্যোগের লক্ষ্য দীর্ঘমেয়াদি মহাকাশ সক্ষমতা অর্জন, স্বনির্ভরতা জোরদার করা, বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের পথ তৈরি ও দক্ষ জনশক্তি গড়ে তোলা, বৈশ্বিক মহাকাশ বিজ্ঞানে বাংলাদেশের অবস্থান সুদৃঢ় করা এবং উদীয়মান ট্রিলিয়ন ডলারের মহাকাশ অর্থনীতিতে যুক্ত হওয়া।
স্পারসোর প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মোহাম্মদ শহিদুল ইসলাম বলেন, প্রাথমিক উদ্দেশ্য হলো অন্যান্য দেশ থেকে রকেটের যন্ত্রপাতি এনে স্থানীয়ভাবে সংযোজন করা। 'পরে দক্ষতা তৈরি হলে এখানে নতুন রকেট তৈরি হতে পারে।'
তিনি আরও বলেন, 'আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতেরও রকেট লঞ্চিং স্টেশন রয়েছে, যার মাধ্যমে তারা অন্য দেশের রকেট উৎক্ষেপণ করে বৈদেশিক মুদ্রা আয় করছে। আমরা যদি উৎক্ষেপণ স্টেশন করতে পারি, তাহলে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের সুযোগ তৈরি হবে।'
শহিদুল ইসলাম বলেন, এ প্রকল্পে চীন, জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার মতো দেশ থেকে বিনিয়োগ আসার সম্ভাবনা রয়েছে। ইতিমধ্যে চীনের একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আলোচনাও শুরু হয়েছে। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান স্পারসোর সঙ্গে স্পেস শিল্প সচেতনা বৃদ্ধির বিষয়ে কাজ করতে সম্মত হয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক সুব্রত কুমার আদিত্য বলেন, প্রকল্পটি অত্যন্ত উচ্চাভিলাষী হলেও অসম্ভব নয়।
তিনি বলেন, 'এই প্রকল্পের জন্য অনেক অর্থের প্রয়োজন হবে। বিদেশি বিনিয়োগ লাগবে। তবে শুধু বিদেশি বিনিয়োগ হলেই হবে না, বিদেশ থেকে প্রযুক্তিরও প্রয়োজন হবে। আমি যতদূর জানি এ বিষয়ে স্পারসো চীনের সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করতে যাচ্ছে। চীন বা অন্য কোনো দেশ যদি এগিয়ে আসে, সেক্ষেত্রে এটি বাস্তবায়ন করা সম্ভব।'
রকেট ও উৎক্ষেপণ কেন্দ্র
স্পারসোর কর্মকর্তারা জানান, জাতীয় পর্যায়ে রকেট তৈরি ও একটি উৎক্ষেপণ কেন্দ্র বা লঞ্চ স্টেশন স্থাপনের জন্য সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের কাজ চলছে। এর মূল লক্ষ্য হলো নিজস্ব প্রযুক্তিতে এমন উৎক্ষেপণ যান তৈরি করা, যা কম খরচে দেশি-বিদেশি স্যাটেলাইট কক্ষপথে স্থাপন করতে পারবে।
দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড-এর দেখা চুক্তিপত্র অনুযায়ী, পরামর্শক প্রতিষ্ঠানটি জানিয়েছে যে এই সমীক্ষা পরিচালনার জন্য তাদের প্রয়োজনীয় দক্ষতা, জনবল ও কারিগরি সম্পদ রয়েছে।
বিষয়টি নিশ্চিত করে স্পারসোর কর্মকর্তা শহিদুল ইসলাম বলেন, উৎক্ষেপণ স্টেশনের জন্য পটুয়াখালীর কলাপাড়া, চট্টগ্রামের আনোয়ারা ও সুন্দরবনের উপকূলীয় এলাকা প্রাথমিকভাবে বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে। 'তবে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে সম্ভাব্য সমীক্ষার পর। এছাড়া প্রকল্পের মোট ব্যয়ও জানা যাবে সমীক্ষা প্রতিবেদনে। এসব তথ্যের ভিত্তিতে একটি বিনিয়োগ প্রস্তাব তৈরি করা হবে সরকারের চূড়ান্ত অনুমোদের জন্য।'
কর্মকর্তারা মনে করেন, এই স্থাপনা প্রযুক্তিগত স্বায়ত্তশাসন বাড়াবে, জাতীয় মহাকাশ নিরাপত্তা জোরদার করবে এবং অরবিটাল স্লটে বাংলাদেশের সার্বভৌম দাবি প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করবে। এটি চালু হলে বাণিজ্যিক উৎক্ষেপণের মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা আয় করা এবং বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক অভিযানে সহায়তা করা সম্ভব হবে।
স্যাটেলাইট শিল্প ও ল্যাবরেটরি
বাংলাদেশের স্যাটেলাইট সক্ষমতার আধুনিকায়ন করার লক্ষ্যে স্পারসো একটি স্যাটেলাইট নির্মাণ শিল্প গড়ে তোলার পরিকল্পনা করছে। এই কেন্দ্রে বিভিন্ন শ্রেণির স্যাটেলাইটের নকশা প্রণয়ন, ফ্যাব্রিকেশন, ইন্টিগ্রেশন, টেস্টিং ও ভ্যালিডেশনের কাজ করা হবে।
এই উদ্যোগের উদ্দেশ্য হলো বিদেশি সরবরাহকারীদের ওপর নির্ভরতা কমানো, কেনাকাটার ব্যয় হ্রাস ও স্পেস-গ্রেড যন্ত্রাংশ রপ্তানিমুখী উৎপাদনের সুযোগ তৈরি করা। এখানকার অ্যাসেম্বলি, ইন্টিগ্রেশন ও টেস্ট (এআইটি) ল্যাবরেটরিটি টেলিযোগাযোগ, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, কৃষি, সুনীল অর্থনীতি, বনায়ন ও মহাকাশ আবহাওয়া গবেষণার মতো খাতে সেবা দেবে।
পাশাপাশি এই ল্যাব দক্ষ জনশক্তি গড়ে তুলবে, বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোতে উদ্ভাবনকে উৎসাহিত করবে এবং ট্রিলিয়ন ডলারের বৈশ্বিক মহাকাশ বাজারে বাংলাদেশকে একটি শক্ত অবস্থানে নিয়ে যাবে।
স্পেস ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক
গবেষণা, প্রকৌশল ও বাণিজ্যিক মহাকাশ অ্যাপ্লিকেশনে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে স্পারসো একটি হাইটেক স্পেস ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক গড়ে তোলার লক্ষ্য নিয়েছে। এ পার্ক মহাকাশযান উৎপাদন, যন্ত্রাংশ সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান, পরীক্ষাগার ও স্টার্ট-আপগুলোর জন্য উদ্ভাবনী কেন্দ্র হিসেবে কাজ করবে।
আশা করা হচ্ছে, এর ফলে বিপুল কর্মসংস্থান তৈরি হবে এবং যৌথ উদ্যোগ ও আরএনডি কর্মসূচির মাধ্যমে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা বাড়বে। পার্কটি স্যাটেলাইট ডেটা, নেভিগেশন, জ্বালানি ব্যবস্থাপনা, সামুদ্রিক ট্র্যাকিং, বিমান চলাচল নিরাপত্তা, টেলিযোগাযোগ ও টেকসই নগর পরিকল্পনার মতো ক্ষেত্রে সেবা দেবে।
শহিদুল ইসলাম জানান, যেসব স্থানে ভালো যোগাযোগ ব্যবস্থা, লজিস্টিকস, গ্যাস ও পানির সুবিধা রয়েছে—সেগুলোকে বিবেচনা করা হচ্ছে। এর মধ্যে মিরসরাই অর্থনৈতিক অঞ্চল ও টাঙ্গাইলের মধুপুর যাচাই-বাছাইয়ের তালিকায় রয়েছে।
বাংলাদেশের কেন মহাকাশ শিল্প প্রয়োজন
স্পারসোর কর্মকর্তারা বলেন, বিশ্বজুড়ে মহাকাশ শিল্প এখন ট্রিলিয়ন ডলারের বাজারে পরিণত হয়েছে। বিশ্বে এখন ১১ হাজারের বেশি স্যাটেলাইট কক্ষপথে পাঠানো হয়েছে। এ শিল্পে বাংলাদেশেরও বড় সম্ভাবনা রয়েছে। বর্তমান বিশ্বে স্পেস শিল্প ছাড়া টেকসই উন্নয়ন সম্ভব নয়।
তারা আরও বলেন, স্পেস ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক স্থাপনে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। এর প্রথমটি হলো দক্ষ লোকবল, দ্বিতীয়টি তহবিল এবং বিদেশী বিনিয়োগ। তবে স্পেস ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক চ্যালেঞ্জিং হলেও অসম্ভব নয়। দেশে যেহেতু বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্র্যাজুয়েটদের একটি বড় অংশ রয়েছে, তাই স্যাটেলাইট ও এর যন্ত্রাংশ তৈরির জন্য এই পার্ক বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করতে পারবে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, স্যাটেলাইট এখন আধুনিক বিশ্বের তথ্য, যোগাযোগ, নিরাপত্তা ও গবেষণার অপরিহার্য অংশ। পৃথিবীর কক্ষপথে ঘুরে স্যাটেলাইট বিভিন্ন ধরনের সংকেত, ছবি ও তথ্য সংগ্রহ করে পৃথিবীতে পাঠায়, যা নানা ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়। স্যাটেলাইটের প্রধান কাজ হলো যোগাযোগ, আবহাওয়া পূর্বাভাস, কৃষি পর্যবেক্ষণ, নেভিগেশন, বৈজ্ঞানিক গবেষণা ও জাতীয় নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।
২০১৮ সালের ১১ মে উৎক্ষেপণ করা বাংলাদেশ স্যাটেলাইট-১ বর্তমানে টেলিভিশন সম্প্রচারের কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে।
স্পারসোর প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা নূর হোসেন শরীফী বলেন, বর্তমানে কৃষি, দুর্যোগ, বন্যা, যানবাহন ও বিমান চলাচল এবং বন, নদী ও ভূমির পরিবর্তন পর্যবেক্ষণের জন্য বাংলাদেশকে বৈশ্বিক স্যাটেলাইটগুলোর ওপর নির্ভর করতে হয়।
তিনি বলেন, 'এসব স্যাটেলাইটের ফ্রি ডাটা ব্যবহার করা হয়, কারণ আমাদের বাজেট খুবই সীমিত। ফলে মানসম্মত ডাটা পাওয়া যায় না। অল্প খরচে রিয়েল-টাইম ডাটা পাওয়া যায় না। ফলে দুর্যোগের আগাম প্রস্তুতি নেওয়া যায় না। যেমন দুযোর্গ সম্পর্কিত বিস্তারিত তথ্য পেতে ৭ থেকে ১৫ দিন অপেক্ষা করতে হয়। এ কারণে নিজেদের ব্যবহারের পাশপাশি বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে স্যাটেলাইন উৎক্ষেপণ করা জরুরি।'
শরীফী আরও বলেন, 'উচ্চ রেজুলেশনের এক সেট ডাটার দাম পড়ে প্রায় ৪০ কোটি টাকা প্রয়োজন হয়। আবহাওয়া-সংক্রান্ত উচ্চ রেজুলেশনের ডাটা রিয়েল টাইমে পাওয়ার কারণে অনেক সময় আমাদের ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়। নিজেদের এই ধরনের স্যাটেলাইট থাকলে কম খরচে সহজে ডাটা পাওয়া যাবে।'
স্পারসোর একজন কর্মকর্তা জানান, ইউরোপ থেকে একটি স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ করতে প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা খরচ হয়। অথচ দেশে তৈরি ও উৎক্ষেপণ করা গেলে খরচ অর্ধেকেরও কম হবে। স্যাটেলাইট কক্ষপথে স্থাপনের জন্য রকেট প্রয়োজন। প্রাথমিকভাবে বিদেশ থেকে যন্ত্রাংশ আমদানি করে স্থানীয়ভাবে সংযোজনের মাধ্যমে এই উৎক্ষেপণ যান তৈরি করা হবে।
বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, ফ্রান্স, জাপান, চীন, যুক্তরাজ্য, ভারত, ইসরায়েল, ইরান, কানাডা, ইতালি, দক্ষিণ কোরিয়া ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের রকেট ও স্যাটেলাইট—উভয়ই তৈরির সক্ষমতা রয়েছে।
কর্মকর্তারা জানান, স্পারসোর বর্তমান চেয়ারম্যান মো. রাশেদুল ইসলাম প্রথম এই উদ্যোগের প্রস্তাব দেন। পরবর্তীতে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. আশরাফ উদ্দিন এ বিষয়ে আগ্রহ ও সমর্থন দিলে প্রকল্পটি সামনের দিকে এগিয়ে যায়।
তারা আরও বলেন, সম্ভাব্যতা সমীক্ষার কাজটি ডেভেলপমেন্ট ডিজাইন কনসালট্যান্টস লিমিটেডকে দেওয়া হয়েছে। মহাকাশ গবেষণায় এই প্রতিষ্ঠানটির অভিজ্ঞ আন্তর্জাতিক উপদেষ্টা রয়েছে। সাতটি দরদাতা প্রতিষ্ঠানের মধ্য থেকে এই প্রতিষ্ঠানটিকে নির্বাচন করা হয়েছে বলে জানান তারা।
