তৃতীয় টার্মিনাল: রাজস্ব বিতর্কে অচলাবস্থা, সমাধান ছাড়াই ভেস্তে গেল বেবিচক–জাপানি কনসোর্টিয়ামের বৈঠক
ঢাকা বিমানবন্দরের ২১ হাজার কোটি টাকার তৃতীয় টার্মিনাল পরিচালনা নিয়ে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক) ও নির্বাচিত জাপানি কনসোর্টিয়ামের মধ্যে আলোচনায় আবারও অচলাবস্থা দেখা দিয়েছে। রাজস্ব বণ্টন এবং আয়–ব্যয়ের কাঠামো নিয়ে কয়েক দফা আলোচনার পরও দুই পক্ষ কোনো সমঝোতায় পৌঁছাতে ব্যর্থ হয়েছে।
আলোচনা প্রক্রিয়ার সঙ্গে সরাসরি যুক্ত একাধিক কর্মকর্তা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানান, ২৪–২৫ নভেম্বর অনুষ্ঠিত সর্বশেষ দুই দিনের আলোচনাও কোনো অগ্রগতি ছাড়াই শেষ হয়, কারণ রাজস্ব ভাগাভাগি ও আয়-ব্যয়ের মডেল নিয়ে মূল মতপার্থক্য এখনো দূর হয়নি।
কনসোর্টিয়ামের প্রতিনিধিরা বলেন, বেবিচক প্রধান আয়ের উৎসগুলো থেকে রাজস্ব ভাগাভাগি করতে রাজি নয় এবং বরং "ভারতীয় ধাঁচের আয়–ব্যয় মডেল চাইছে, যা কনসোর্টিয়ামের আন্তর্জাতিক মানের প্রস্তাবের সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ।"
টার্মিনালটি ২০২৩ সালের অক্টোবর মাসে সফট লঞ্চ হয়েছিল। পূর্ণাঙ্গ কার্যক্রম শুরু হওয়ার কথা ছিল ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে। তবে যন্ত্রপাতি আমদানির বিলম্ব, নেতৃত্বে বারবার পরিবর্তন এবং রাজনৈতিক পালাবদলের কারণে সময়সীমা পিছিয়ে এখন ২০২৫ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত গড়িয়েছে। বেবিচক এখন বলছে তারা আর কোনো চূড়ান্ত সময়সীমা দিতে পারছে না।
আন্তর্জাতিক টেন্ডার ফের আলোচনায়
আলোচনা স্থবির হয়ে পড়ায় সরকার এখন নতুন অপারেটর বাছাইয়ের জন্য আন্তর্জাতিক টেন্ডার আহ্বানের কথা ভাবছে বলে জানান কর্মকর্তারা। দীর্ঘসূত্রতা বাড়লে ১৫ হাজার কোটি টাকার জাইকার ঋণের কিস্তি পরিশোধ শুরু হলেও টার্মিনাল কার্যত নিষ্ক্রিয় থাকবে—ফলে করদাতাদের ওপর বাড়তি চাপ সৃষ্টি হবে।
বেবিচক–এর মুখপাত্র মোহাম্মদ কাউছার মাহমুদ টিবিএস–কে বলেন, "আমরা বেসামরিক বিমান চলাচল মন্ত্রণালয় এবং পিপিপি কর্তৃপক্ষকে আনুষ্ঠানিকভাবে এ পরিস্থিতি সম্পর্কে জানিয়েছি।"
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বেবিচক–এর এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বলেন, "মূল বাধা হলো আর্থিক সামঞ্জস্য। আমরা সব নথি পর্যালোচনার জন্য পাঠিয়েছি, আর ২ ডিসেম্বর কনসোর্টিয়াম তাদের আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া দিয়েছে। কিন্তু, তাদের প্রস্তাব আমাদের জন্য কার্যকর নয়।"
তিনি বলেন, চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত বেসামরিক বিমান চলাচল মন্ত্রণালয় ও পিপিপি কর্তৃপক্ষ নেবে, আন্তর্জাতিক উন্মুক্ত টেন্ডারই এখন বাস্তবসম্মত একটি বিকল্প।
জাপানের এই কনসোর্টিয়ামটিকে আগের সরকার নির্বাচিত করেছিল, যা মূলত প্রকল্পে জাপানের অর্থায়নের সঙ্গে যুক্ত বলে মনে করা হয়। ২০২৪ সালের আগস্টে সরকার পরিবর্তনের পর থেকে রাজস্ব, ব্যয় এবং পরিচালন ব্যবস্থাপনায় উভয় পক্ষ সমঝোতায় আসতে ব্যর্থ হচ্ছে।
পিপিপি কর্তৃপক্ষের সিইও চৌধুরী আশিক মাহমুদ বিন হারুন নিশ্চিত করেছেন যে আলোচনা চলছে, তবে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।
নভেম্বরের বৈঠকের পর কনসোর্টিয়ামের এক কর্মকর্তা টিবিএস–কে বলেছিলেন, "এখনো উল্লেখযোগ্য কোনো অগ্রগতি হয়নি।" ২ ডিসেম্বর বেবিচিক–এ প্রতিক্রিয়া জমা দেওয়ার পর থেকে কনসোর্টিয়াম ফোনকল, ম্যাসেজ বা ইমেইলে কোনো সাড়া দেয়নি।
বেবিচক–এর কর্মকর্তারা স্বীকার করেন যে অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদের মধ্যেই টার্মিনাল পুরোপুরি চালু করা হয়তো সম্ভব নয়। অপারেটর নিয়োগ পেলেও কমপক্ষে ছয় মাস প্রস্তুতির সময় লাগবে।
এর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন সিস্টেমেরসহ আমদানি করা অনেক যন্ত্রপাতির ওয়্যারেন্টি শেষ হয়ে গেছে বা শেষ হওয়ার পথে—যা আর্থিক ক্ষতির ঝুঁকি আরও বাড়াচ্ছে।
পরবর্তী পদক্ষেপ সম্পর্কে জানতে বেসামরিক বিমান পরিবহন উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন ও মন্ত্রণালয়ের সচিব নাসরীন জাহানকে একাধিকবার ফোনকল বা ম্যাসেজ করা হলেও তারা এতে সাড়া দেননি।
সেপ্টেম্বরে চূড়ান্ত পর্যায়ের আলোচনার আগে উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন বলেছিলেন, শর্তে কনসোর্টিয়াম রাজি না হলে সরকার বিকল্প আন্তর্জাতিক অপারেটর খুঁজবে। তবে ১২ নভেম্বর তাঁর সঙ্গে সাক্ষাতের পর জাপানের রাষ্ট্রদূত সাইদা শিনইচি বলেন, কনসোর্টিয়াম এখনো টার্মিনাল পরিচালনায় আগ্রহী।
এই কনসোর্টিয়ামে রয়েছে: জাপান এয়ারপোর্ট টার্মিনাল কোম্পানি, সুমিতোমো, নিপ্পন কোয়েই ও নেইরা ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট কর্পোরেশন। তাদের প্রস্তাব অনুযায়ী, বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন দুই বছর গ্রাউন্ড সার্ভিস পরিচালনা করবে কনসোর্টিয়ামের তত্ত্বাবধানে, আর ডেটা সিকিউরিটির দায়িত্বে থাকবে বেবিচক।
বেবিচক ও কনসোর্টিয়ামের বক্তব্য
বেবিচক–এর কর্মকর্তারা স্বীকার করেন, রাজস্ব বণ্টনই প্রধান সমস্যা এবং কনসোর্টিয়ামের আশঙ্কা হচ্ছে, সরকারি কাঠামোর অধীনে প্রকল্পটি আর্থিকভাবে অকার্যকর হয়ে পড়তে পারে।
কনসোর্টিয়ামের সূত্র জানায়, বিমানবন্দরের দুটি সবচেয়ে লাভজনক আয়ের উৎস—প্যাসেঞ্জার সেফটি ফি ও এয়ারপোর্ট উন্নয়ন ফি—এগুলো থেকে বেবিচক রাজস্ব ভাগ করতে চায় না। ২০২০ সালের আগস্ট থেকে অভ্যন্তরীণ, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক ফ্লাইটের সব যাত্রীর কাছ থেকে এ দুটি ফি আদায় করা হচ্ছে।
কনসোর্টিয়ামের এক প্রতিনিধি বলেন, "এই ফি-গুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এগুলো ছাড়া গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং রয়্যালটি বা বাণিজ্যিক স্পেসের মতো গৌণ আয় দিয়ে ব্যয় সামাল দেওয়া সম্ভব নয়।"
তিনি আরও বলেন, প্রস্তাবিত ব্যবসায়িক মডেলটি আন্তর্জাতিক মান বজায় রাখার লক্ষ্য নিয়ে তৈরি। "বেবিচক তাদের পরামর্শকের মাধ্যমে ভারতের মডেলের ওপর ভিত্তি করে ব্যয়–আয় বিশ্লেষণ করেছে। কিন্তু, তৃতীয় টার্মিনালের অগ্রসর ও ভবিষ্যতকেন্দ্রিক পরিকাঠামোর ব্যয় আঞ্চলিক মানদণ্ড দিয়ে সমন্বয় করা সম্ভব নয়।"
আরও বিলম্ব হলে কী ঘটবে
বেবিচক–এর একজন কর্মকর্তা নিশ্চিত করেছেন, ব্যয়বহুল আমদানি–নির্ভর অনেক যন্ত্রপাতির ওয়্যারেন্টি ইতোমধ্যে শেষ হয়ে গেছে বা শেষের পথে। ফলে ক্ষতি কমাতে আংশিক কার্যক্রম শুরু করার চাপ বাড়ছে।
জাপানের সহায়তায় নির্মিত ২১ হাজার কোটি টাকার এই টার্মিনাল—যার ১৫ হাজার কোটি দিয়েছে জাইকা—প্রতি বছর ২ কোটি ৪০ লাখ যাত্রী সেবা দেওয়ার জন্য নকশা করা হয়েছিল।
এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ এবং বাংলাদেশ বিমানের সাবেক বোর্ড সদস্য কাজী ওয়াহিদুল আলম বলেন, সময়মতো অপারেটর নিয়োগ দিতে না পারায় পুরো প্রকল্পই ঝুঁকিতে পড়েছে। তিনি বলেন, "বিভিন্ন সরঞ্জামের ওয়্যারেন্টি শেষ হচ্ছে, ঝুঁকি বাড়ছে, আর এক বছরের মধ্যেই ঋণ পরিশোধ শুরু হবে—কিন্তু এখন কোনো রাজস্ব নেই। পৃথিবীর কোথাও এমন বিশাল স্থাপনা এভাবে অচল পড়ে থাকে না।"
তিনি অপারেটর বাছাই প্রক্রিয়া নিয়েও প্রশ্ন তোলেন। বলেন, "সরকার উন্মুক্ত দরপত্র চায় নাকি লিমিটেড ইনভাইটেশন—তা স্পষ্ট নয়। আগে জাপানি কনসোর্টিয়ামের ওপর নির্ভরশীলতা এত বেশি ছিল যে বিকল্প ভাবাই হয়নি। এখন সেই একই কনসোর্টিয়াম শর্ত চাপিয়ে দিচ্ছে, আর কর্তৃপক্ষের প্রস্তুতির ঘাটতি তার সুযোগ করে দিচ্ছে।"
পূর্ণাঙ্গ কার্যক্রম চালুর পথে দীর্ঘ বিলম্ব
গত ৪ আগস্ট বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের একটি ফ্লাইট প্রথমবারের মতো টার্মিনালের বোর্ডিং ব্রিজ ও ভিজ্যুয়াল ডকিং গাইডেন্স সিস্টেম ব্যবহার করে—যা টার্মিনাল চালুর প্রস্তুতির একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ।
ট্রায়াল রান, বিশেষ করে বোর্ডিং ব্রিজের পরীক্ষা—চলমান আছে। এটি পূর্ণাঙ্গভাবে পরিচালনার জন্য কমপক্ষে ৬,০০০ কর্মীর প্রয়োজন হবে, যার মধ্যে ৪,০০০ জন নিরাপত্তা কর্মী।
থার্ড টার্মিনাল পুরোপুরি চালু হলে বিমানবন্দরের বার্ষিক যাত্রী ধারণক্ষমতা তিনগুণ এবং কার্গো হ্যান্ডলিং সক্ষমতা দ্বিগুণ বাড়বে। এতে রয়েছে ২৬টি বোর্ডিং ব্রিজ, সম্পূর্ণ স্বয়ংক্রিয় ব্যাগেজ সিস্টেম এবং উন্নত যাত্রীসেবার নানান সুবিধা।
