আজানের শব্দ ঠেকাতে আয়নাঘরে চলত এগজস্ট ফ্যান, ২৫ বন্দীর জন্য একটি টুথব্রাশ-গামছা: চিফ প্রসিকিউটর
প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদপ্তরের (ডিজিএফআই) সদর দপ্তরের জয়েন্ট ইন্টারগেশন সেলে (আয়নাঘর) সংঘটিত গুম ও নির্যাতনের ভয়াবহ চিত্র আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে তুলে ধরেছেন ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম।
বর্ণনায় তিনি বলেন, 'এখানে ছিল না কোনো আলো-বাতাস কিংবা জানালা। শুধু ছিল বিকট শব্দ আর ভয়ানক অন্ধকার। আজানের মতো পবিত্র ধ্বনি কানে পৌঁছানো ঠেকাতে চালানো হতো এগজস্ট ফ্যান। কখনো আবার সাউন্ড বক্সে বাজানো হতো গান। এমনকি ২৫ জন বন্দিকে একটি টুথব্রাশ ব্যবহারে বাধ্য করা হতো। মুখ মুছতে হতো নোংরা গামছায়।'
রোববার (৭ ডিসেম্বর) আয়নাঘরে গুম-নির্যাতনের ঘটনায় মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ সাবেক ও বর্তমান ১৩ সেনা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠনের শুনানির দিন ধার্য ছিল। এদিন ট্রাইব্যুনাল-১ এ শুনানি করেন চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম। শুনানিতে বন্দীদের দেওয়া এসব বিবরণ তুলে ধরেন তিনি।
পরে প্রেস ব্রিফিংয়ে চিফ প্রসিকিউটর বলেন, 'ডিজিএফআইয়ের সদর দপ্তরের দক্ষিণ পাশে মেস-বি এর মাঝে একটি দোতলা ভবনে ছোট ছোট খোপের মতো বন্দিশালা ছিল। এতে ছিল মোটা রডের গ্রিল ও বাইরে ছিল ঢাকনা। ভেতরে কোনো আলোর ব্যবস্থা ছিল না। প্রত্যেকটা সেলের ভেতরে সিসি ক্যামেরা লাগানো থাকত। ছোট ভেন্টিলেটর ছিল।'
তাজুল ইসলাম বলেন, 'সেলের ভেতরে থাকা এগজস্ট ফ্যান চালিয়ে দেওয়া হতো। ফলে অসহ্য শব্দে অনেকেই বধির হয়েছেন। তারা বাইরের কোনো আওয়াজ শুনতে পেতেন না। কখনো কখনো কোনো বন্দি এগজস্ট ফ্যান চালানোর আগেই হয়তো মসজিদের মাইক থেকে আজানের শব্দ শুনেছেন। কখনো জুমার খুতবা শুনেছেন। কখনো ঘোষণা শুনেছেন যে এই এলাকার অমুক ব্যক্তি ইন্তেকাল করেছেন।'
শেখ হাসিনার পতনের পর তদন্ত সংস্থার সঙ্গে বন্দিশালা পরিদর্শনে যান ২৬ ভুক্তভোগী। তখন তারা এসব সেল চিহ্নিত করেন। দেয়ালের কোনায় কেউ কেউ নাম লিখে এসেছিলেন। এছাড়া অন্যান্য আলামত দেখে গুমের সময় রাখা স্থানগুলো শনাক্ত করেছেন। এসব বন্দিশালা ভিডিও করে নিয়ে আসা হয়েছে বলে শুনানিতে জানিয়েছেন চিফ প্রসিকিউটর, যা ট্রায়ালে তুলে ধরার কথা জানিয়েছেন তিনি।
চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম বলেন, 'বন্দিশালায় সবসময় ২০-২৫ জন বন্দি থাকতেন। সবার ব্যবহারের জন্য বাথরুমের সামনে একটা নোংরা গামছা টানিয়ে রাখা হতো। এ একটা গামছা দিয়েই হাত-মুখ মুছতেন সবাই। গোসলের সময়ও ব্যবহার করতে হতো। ফলে অ্যালার্জিসহ নানা চুলকানি রোগে আক্রান্ত হতেন বন্দিরা। নোংরা গামছায় মুখ মোছার কারণে প্রায় সবারই চোখ উঠত। এ ছাড়া টুথব্রাশ রাখা হতো একটি। সেই ব্রাশই ২৫ জনকে ব্যবহার করতে বলা হতো। একজন মানুষকে কতটা অমানবিক পরিবেশে রাখা যায়, তার ব্যবস্থা ছিল এই সেলে।'
তিনি জানান, এমন জায়গায় গত ১৫ বছর বিরোধী মতাদর্শের লোকদের গুম করে রাখা হয়েছিল। আর এসব কারণে আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ এনেছে প্রসিকিউশন।
এ মামলায় ১৩ জনের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠনের ওপর শুনানি শেষ করেছে প্রসিকিউশন। স্টেট ডিফেন্স ও আসামিপক্ষে শুনানির জন্য আগামী মঙ্গলবার (৯ ডিসেম্বর) দিন ধার্য করেছেন ট্রাইব্যুনাল।
এদিন সকালে ঢাকার সেনানিবাসের বিশেষ কারাগার থেকে কড়া নিরাপত্তায় গ্রেপ্তার হওয়া তিন সেনা কর্মকর্তাকে হাজির করে পুলিশ। তারা হলেন– ডিজিএফআইয়ের সাবেক পরিচালক মেজর জেনারেল শেখ মো. সরওয়ার হোসেন, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাহবুবুর রহমান সিদ্দিকী ও ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আহমেদ তানভির মাজাহার সিদ্দিকী।
শেখ হাসিনাসহ পলাতক অন্য আসামিরা হলেন– শেখ হাসিনার প্রতিরক্ষা বিষয়ক সাবেক উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অব.) তারিক আহমেদ সিদ্দিক, ডিজিএফআইয়ের সাবেক মহাপরিচালক (ডিজি) লে. জেনারেল (অব.) মোহাম্মদ আকবর হোসেন, সাবেক ডিজি মেজর জেনারেল (অব.) সাইফুল আবেদিন, লে. জেনারেল (অব.) মো. সাইফুল আলম, সাবেক ডিজি লে. জেনারেল তাবরেজ শামস চৌধুরী, সাবেক ডিজি মেজর জেনারেল (অব.) হামিদুল হক, মেজর জেনারেল তৌহিদুল ইসলাম, মেজর জেনারেল কবির আহাম্মদ ও লে. কর্নেল (অব.) মখসুরুল হক।
